রাঙামাটি জেলার প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নেই। শিক্ষার মানোন্নয়ন ও বিস্তারে নতুন পদ সৃষ্টি জরুরি।
সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান’র (সুপ্র) প্রাথমিক শিক্ষার ওপর এক সামাজিক নিরীক্ষায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
নিরীক্ষায় অংশ নেওয়া ৮৫ দশমিক ৭ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, বিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই এবং শতভাগ অংশগ্রহণকারী মনে করেন পাহাড়ে প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের জন্য নতুন পদ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সাতজনের ওপর নিরীক্ষা চালিয়ে এ তথ্য পাওয়া যায়।
শতভাগ অংশগ্রহণকারী মনে করেন- দারিদ্র্য শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার মূল কারণ। এছাড়া, শিক্ষার মান্নোয়নে উপবৃত্তি কার্যকর এবং বিদ্যালয়ে দুপুরের খাবার দেওয়া হয় না বলে উল্লেখ করেছেন শতভাগ উত্তরদাতা।
জরিপে ৫৭ দশমিক ১ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভা নিয়মিত হয় না এবং শতভাগ জরিপকারী শিক্ষার মানোন্নয়নে ম্যানেজমেন্ট কমিটি বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য সহায়ক বলে মন্তব্য করেন।
প্রতিবেদনে রাঙামাটি জেলার ৪০ শিক্ষার্থীর সাক্ষাতকার নেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মতামতে দেখা যায়, ৪০ ভাগ শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা, সব বিদ্যালয়ে টয়লেট, মাত্র ২৫ ভাগ স্কুলে ছেলে ও মেয়েদের পৃথক টয়লেটের ব্যবস্থা এবং সব বিদ্যালয়ে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে বলে মন্তব্য করেন।
সব শিক্ষার্থী উল্লেখ করেছে- স্কুলে নিয়মিত সমাবেশ ও জাতীয় সঙ্গীত হয়। শতভাগ শিক্ষার্থী জানায়, বিদ্যালয়ে বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠিত হয়। ৯৮ ভাগ শিক্ষার্থী বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দিবস পালিত হয় বলে জানায় এবং মাত্র ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছে দিবস উদযাপনের জন্য তাদের চাঁদা দিতে হয়।
শিক্ষা প্রতিবেদনে রাঙামাটি জেলার ১২ শিক্ষকের সাক্ষাতকার গ্রহণ করা হয়। তাদের মধ্যে ৫ জনের শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক। জরিপকারীদের মধ্যে ৩৩ শতাংশ প্রধান শিক্ষক। সামাজিক মূল্যায়নে মাত্র ১৭ শতাংশ শিক্ষক বলেছেন, তাদের ডিজিটাল পরিচয়পত্র রয়েছে এবং তারা স্কুলের নোটিশ বোর্ডে এটি ঝুলিয়ে রাখেন।
শতভাগ শিক্ষক বলেছেন, তারা ক্লাস নেওয়ার পূর্বে পাঠ পরিকল্পনা করেন এবং এটি সংরক্ষণ করেন। সব শিক্ষক শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করেন বলেও জানান। শিক্ষকরা আরো জানান, শতভাগ শিক্ষক চার এর অধিক ক্লাস নেন। ৩৩ শতাংশ শিক্ষক বলেছেন, তারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষার্থীদের সামনের আসনে বসতে দেন। সব শিক্ষক জানান, তারা স্কুলের ক্লাসের সহায়ক কোচিং করান এবং প্রায় সবাই মনে করেন কোচিং শিক্ষার্থীদের জন্য ভালো।
সামাজিক এই নিরীক্ষায় ১৬ অভিভাবকের মতামত নেওয়া হয়। এতে ৬৩ শতাংশ অভিভাবক বলেছেন, তারা তাদের সন্তানদের জন্য নোট বই কিনেন এবং তাদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ অভিভাবক বলেছেন, শিক্ষার্থীরা তাদের নোট বই কিনতে উৎসাহী করেছেন। এছাড়া ৯৪ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন, নোট বই পড়াশুনা ও ভালো ফলাফলের জন্য প্রয়োজন।
নিরীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় সবাই ঠিক সময়ে বই পায়। নোট বই কেনার প্রবণতা রয়েছে। অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সবাই মনে করে, নোট বই শিক্ষার ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন আনতে পারে। বাবা-মা শিশুদের নোট বই কিনে দিতে আগ্রহী হন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই।
স্কুলে কোচিং’র ব্যবস্থা আছে এবং শিশুরা এবং তাদের অভিভাবকরা কোচিং এ আগ্রহী। বেশির ভাগ শিশুই উপবৃত্তি পেয়ে থাকে। বেশিরভাগ বিদ্যালয়েই পাঠ্য বইয়ের বাইরে চারু কারু ও অন্যান্য বিষয়ে পড়ানো হয় না। স্কুলগুলোতে খাবার পানি ও আলো বাতাসের ব্যবস্থা মোটামুটি হলেও শৌচাগার গুলো মানসম্মত নয়। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের সেবা দিতে বেশিরভাগ স্কুলেই কোনো ব্যবস্থা নেই। শিক্ষকেরা নিয়মিত ক্লাস নিয়ে থাকলেও পাঠ পরিকল্পনার ব্যাপারে বেশিরভাগ শিক্ষকই অমনোযোগী।
সুপ্র’র রাঙামাটি জেলার সম্পাদক ও জাতীয় পরিষদের সদস্য ললিত সি. চাকমা জানান, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা এবং মিলিনিয়াম ডিক্লারেশন (Millennium Declaration) এ স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০১৫ সাল এর মধ্যে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দিনদিন কমছে, আবার যে বরাদ্দ দেওয়া হয় তার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনারও অভাব রয়েছে। প্রাপ্ত বরাদ্দ যদি সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করা হয় তাহলে বাংলাদেশে শিক্ষার মান বৃদ্ধির পাশাপাশি স্বাক্ষরতার ও শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাবে।
তিনি বলেন, প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত ও সংখ্যাগত অবস্থা, শিক্ষা সমাপনী, উপবৃত্তি, মিড-ডে মিল, বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, ম্যানেজিং কমিটির ভূমিকা, জনবল, স্কুল পর্যায়ে সরকারের বাজেট বরাদ্দ, স্কুল পর্যায়ে বরাদ্দকৃত বাজেটের সঠিক বাস্তবায়ন, প্রাথমিক শিক্ষা পরিচালনা কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে সামাজিক নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে, রাঙামাটি শিক্ষা বিভাগের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন কর্মকর্তার বক্তব্য নেওয়া হয়েছে।
রিপোর্টে শিক্ষকের সংখ্যা বৃদ্ধি ও সকলের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করার সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা জানান, প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার মান্নোয়নে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। দুর্গম বিবেচনায় কিছু কিছু বিদ্যালয়ে দুপুরের খাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া, শূন্য পদে শিক্ষক নিয়োগের জন্য ৩৮৩ জন নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে পত্রিকার মাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। দ্রুত তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়াও শেষ করা হবে বলে তিনি জানান।
সৌজন্যেঃ বাংলানিউজ
Leave a Reply