বরগুনার গ্রামের স্কুলে শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটছে

বরগুনার গ্রাম পর্যায়ের বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট যেকোনো বিষয়ে মানের উন্নয়ন ঘটেছে। আগের চেয়ে শিক্ষক-অভিভাবক ও স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের সচেতনতাও বেড়েছে।

এছাড়া দরিদ্র শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি দেওয়ায় বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়ছে। এতে প্রাথমিক সমাপনীসহ সব পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা অংশ নিচ্ছে ও ভালো ফলাফল করছে।

সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান (সুপ্র) এর উদ্যোগে বরগুনায় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা পরিস্থিতি বিষয়ক সামাজিক এক জরিপ প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
Borguna
সম্প্রতি বরগুনায় উপজেলা পর্যায়ে ২টি স্কুল ও ইউনিয়ন পর্যায়ের ২টি স্কুলসহ মোট ৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওপর এ জরিপ চালানো হয়।

২০১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে ২০১৪ সালের ১ অক্টোবর জরিপের প্রথম পর্বের কাজ শেষ হয়। জরিপের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় একই বছরের ৩০ অক্টোবর। পরে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দ্বিতীয় ধাপে জরিপের ফলোআপ মনিটরিং স¤পন্ন হয়।

সুপ্রর এ জরিপকালে যে বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করেছে সেগুলো হলো, প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত ও সংখ্যাগত অবস্থা, শিক্ষা সমাপনী, উপবৃত্তি, মিড-ডে মিল, বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, ম্যানেজিং কমিটির ভূমিকা, জনবল, স্কুল পর্যায়ে সরকারের বাজেট বরাদ্দ, স্কুল পর্যায়ে বরাদ্দকৃত বাজেটের সঠিক বাস্তবায়ন ও প্রাথমিক শিক্ষা পরিচালনা কাঠামো।

এ জরিপের জন্য বরগুনা সদর উপজেলার জিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ক্রোক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ২নং গৌরিচন্না ইউনিয়নের মনসাতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও খাজুরতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে বাছাই করা হয়।

প্রতিটি বিদ্যালয় থেকে ৫ ছাত্র, ৫ ছাত্রী, ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও ১ জন সদস্য, অভিভাবক ৫ জন, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এবং ১ জন নারী ও ১ জন পুরুষ শিক্ষকসহ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, উপজেলা শিক্ষা অফিসার, সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। পরে দ্বিতীয় ধাপে ফলোআপ মনিটরিংয়ের জন্য এসব বিদ্যালয়ের ৪০ শিক্ষার্থীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।

দুই ধাপে এসব শিক্ষার্থীদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে সামাজিক জরিপের প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।

সুপ্রর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিদ্যালয়ের নিয়মিত বিষয়ের পাশাপাশি সহপাঠ্য যেমন, চার-কারু ও শারীরিক শিক্ষা ক্লাস নেওয়া হয় মাত্র ৪৫ ভাগ বিদ্যালয়ে। বাকী ৫৫ ভাগ বিদ্যালয়ে এসব বিষয়ে পাঠদানের ব্যবস্থা নেই।

শতভাগ বিদ্যালয়ে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা রয়েছে। শতকরা ৯৭ দশমকি ৫ ভাগ বিদ্যালয়ে শৌচাগার রয়েছে,  এর মধ্যে শতকরা ৮৫ ভাগ বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আলাদা শৌচাগার রয়েছে। তবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন  শিশুদের জন্য বিদ্যালয়ে কোনো বিশেষ ব্যবস্থা নেই।

শতকরা ৩৫ ভাগ বিদ্যালয়ে নিয়মিত সমাবেশ ও জাতীয় সংগীত হলেও ৬৫ ভাগ বিদ্যালয়ে কোনো সমাবেশ ও জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় না।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, শতকরা ২৫ ভাগ বিদ্যালয়ে কম্পিউটার থাকলে কোনো ক্লাস হয় না। শতকরা ৯৭ ভাগ স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিবস পালিত হয়। তবে শতকরা ১৫ ভাগ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এ দিবস ও অনুষ্ঠান উদযাপনের জন্য চাঁদা দিতে হয়।

জরিপকালে মোট ১২ শিক্ষকের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এদের মধ্যে ২ জনের শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতকোত্তর।

সাক্ষাৎকারে শতভাগ শিক্ষক বলেছেন তারা ক্লাসে শিক্ষা উপকরণ ব্যবহার করেন। তাদের সবাই মনে করেন শিক্ষার মানোন্নয়নে উপবৃত্তি ভুমিকার রাখছে, তাই এর পরিধি বাড়ানো দরকার।

শতকরা ৯২ ভাগ শিক্ষক বলেছেন ক্লাস নেওয়ার আগে তারা পাঠ পরিকল্পনা করেন এবং তা সংরক্ষণ করেন। ৯২ ভাগ শিক্ষকের মতে তাদের ডিজিটাল পরিচয়পত্র আছে এবং এটা স্কুলের নোটিশ বোর্ডে ঝুলিয়ে রাখেন।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, শতকরা ৭৫ ভাগ শিক্ষক স্কুলের বাইরে কোচিং করান। তারা মনে করেন কোচিং শিক্ষার্থীদের মানের উন্নয়নে সহায়তা করে। তবে ৯২ ভাগ শিক্ষক জানান, ক্লাসে অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষার্থীদের সামনের বেঞ্চে বসতে দেন তারা। আর ৮৩ ভাগ শিক্ষক ৪টির বেশি ক্লাস নেন বলে জানিয়েছেন।

জরিপে উঠে এসেছে, শতকরা ৯৬ ভাগ অভিভাবক তাদের ছেলে-মেয়েদের জন্য নোটবই কিনে দেন ও ৬৭ ভাগ শিক্ষক শিক্ষার্থীদের নোটবই কিনতে উৎসাহ দেন।

এছাড়া ৬৩ ভাগ অভিভাবক মনে করেন নোটবই ভালো ফলাফলের জন্য প্রয়োজন। ৫৮ ভাগ অভিভাবক জানান, তাদের সন্তানরা উপবৃত্তি পায়। তবে তাদের অভিযোগ, কোনো বিদ্যালয়েই ফিডিং কার্যক্রম নেই।

জরিপকালে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির ৮ সদস্যের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এর মধ্যে ২ জন শিক্ষার্থীর বাবা, ১ জন মা ও অপর ৫ জন স্থানীয় বাসিন্দা।

ম্যানেজিং কমিটির ৭৫ ভাগ সদস্য জানান, বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। ৩৭ ভাগ বলেছেন গড়ে ৩ জন শিক্ষক প্রয়োজন। শতকরা ৮৭ ভাগের দাবি বিদ্যালয়গুলোতে বই বিতরণে কোনো অভিযোগ নেই। এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিয়মিত স্কুলে আসেন বলে মনে করেন ৮৭ ভাগ সদস্য।

ম্যানেজিং কমিটির শতকরা ৭৫ ভাগ মনে করেন উপবৃত্তি শিক্ষার মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখে। তাই এর পরিধি বাড়ানো দরকার। শতভাগ সদস্য মনে করেন ম্যানেজিং কমিটি বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য সহায়ক। তবে ৭৫ ভাগ উত্তরদাতা স্বীকার করেন ব্যবস্থাপনা কমিটির মিটিং নিয়মিত হয় না।

প্রথম পর্যায়ে পরিচালিত জরিপ প্রতিবেদনে বিভিন্ন বিষয়ে সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম ছিল শিক্ষকদের সংখ্যা এবং গুণগতমান বৃদ্ধি, সবার জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা, বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটিকে শক্তিশালী ও সক্রিয় করা, মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার, চাহিদা ও সময়োপযোগী বিদ্যালয় অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষা উপকরণের ব্যয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্রয়সীমার মধ্যে রাখা, ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থী রোধ, প্রতিবন্ধী শিশুর শিক্ষা নিশ্চিতকরণে উদ্যোগ, আধুনিক পদ্ধতিতে শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, বাজেটের সঠিক বরাদ্দ ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।

এদিকে, প্রথম ধাপের জরিপ শেষে কর্ম-পরিকল্পনার ফলোআপ মনিটরিং করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিলো কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী অগ্রগতি চিহ্নিত করা।

এরই ধারাবাহিকতায় গত ৪ ফেব্রুয়ারি মধ্যে বিদ্যালয়ভিত্তিক শিক্ষক, অভিভাবক ও বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সঙ্গে সামাজিক নিরীক্ষার তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন, পরবর্তী সুপারিশসমূহ নিয়ে আলোচনা, বিদ্যালয়ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা কমিটির দায়িত্ব ও কর্তব্য বিষয়ে মতবিনিময় ও আলোচনা, নিয়মিত বিদ্যালয় তত্ত্বাবধায়ন ও পরিবীক্ষণ শীর্ষক উপজেলা শিক্ষা অফিসার ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মতবিনিময়, বিদ্যালয়ভিত্তিক বই বিতরণ কর্মসূচি পরিদর্শন এবং বিদ্যালয়ভিত্তিক কোচিং ও শিক্ষার্থী বিষয়ক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।

ফলোআপ মনিটরিং শেষে শিক্ষক-অভিভাবক ও ম্যানেজিং কমিটির সদস্যের দেওয়া তথ্যে অনুযায়ী জানা যায়, প্রতিটি বিদ্যালয়ে আগের বছরের চেয়ে চলতি বছর বই বিতরণ কর্মসূচি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

বিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত সমাবেশ ও জাতীয় সংগীত পরিবশেন হচ্ছে। চারু ও কারু কলার ক্লাস নিয়মিত নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া প্রতিটি বিদ্যালয়ে জানুয়ারি মাসের মধ্যেই শ্রেণি নেতা নির্বাচন করা হয়েছে।

ফলোআপ মনিটরিংয়ে আরো উঠে আসে, বিদ্যালয়গুলোতে প্রধান শিক্ষকরা ক্লাসে  শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য উপকরণ ব্যবহারের বিষয়টি মনিটরিং করছেন।

এছাড়া অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি আশানুরুপ, নির্দিষ্ট পোশাক পরিধান শতভাগে উন্নীত ও দুর্বল শিক্ষার্থীদের ক্রমান্বয়ে অগ্রগতি হচ্ছে।

তাই ভবিষ্যতে ছুটিকালীন বিনা পারিশ্রমিকে কোচিং করানো, দুর্বল শিক্ষার্থীদের আলাদা যত্ন ও ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে পরিকল্পনা গ্রহণের সুপারিশ ও বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়নের সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে।

এসব বিষয়ে সুপ্র সামাজিক নিরীক্ষা পর্যবেক্ষণ কমিটির সদস্য মো. হাসানুর রহমান ঝন্টু বাংলানিউজকে বলেন, সরকারিভাবে বরাদ্দ অর্থের সঠিক বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না তা ফলোআপ করা। এছাড়া প্রাথমিক শিক্ষার হার শতভাগ নিশ্চিত করতে শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য শিক্ষা মন্ত্রনালয়, স্থানীয় শিক্ষা কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট মহল, স্থানীয় মানুষের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন।

এ জরিপের দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলা প্রচারাভিযান সহায়ক মো. মামুন বাংলানিউজকে বলেন, জরিপের পর মনিটরিংয়ের ফলে অধিকাংশ বিদ্যালয়েই এখন সমাবেশ ও জাতীয় সংগীত সঠিভাবে হচ্ছে। শিক্ষকরা আরো বেশি সময় দিলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার বাড়বে।

বরগুনা সুপ্রর স¤পাদক হোসনেয়ারা হাসি বাংলানিউজকে বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা শিক্ষার প্রথম স্তর। তাই এ বিষয়ে গবেষণা করা দরকার। একটি শিক্ষিত জাতি গড়ে তুলতে প্রাথমিক শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।





About লেখাপড়া বিডি ডেস্ক 1519 Articles
লেখাপড়া বিডি বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা বিষয়ক বাংলা কমিউনিটি ব্লগ।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*