‘দুর্নীতির চেয়েও বড় অপরাধ প্রশ্ন ফাঁস’

অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রধান সৈয়দ মিজানুর রহমান রাজু মনে করেন দুর্নীতির চাইতেও বড় অপরাধ হচ্ছে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস।

ওএনবি প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে মানুষ। কিন্তু সেই মানুষ যদি মানুষই না হয়ে অমানুষ হয় এবং ছোট থাকতেই যদি নকলে হাতেখড়ি হয় তাহলে সে মানুষগুলোর দ্বারা দেশের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। আমাদের ভূখণ্ডের তুলনায় জনসংখ্যা বেশি। আর এসব জনসংখ্যা সারা পৃথিবীতে যখন ছড়িয়ে যাবে তখন তারা নিয়ম মানার আনন্দ পাবে না। কারণ বাংলাদেশের জনগণ শিশু বয়স থেকেই অনিয়ম শিখে যাচ্ছে, প্রশ্ন ফাঁস করে পরীক্ষা দিচ্ছে, এর ফলে এরা নিয়ম ভাঙ্গার কৌশল রপ্ত করছে।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে শিক্ষার্থীরা জড়িত নয়, এর সাথে জড়িত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তাহলে শিশু বয়সে কীভাবে এরা নিয়ম ভাঙছেন এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, যখন একটা শিশু শিক্ষার্থী দেখবে যে প্রশ্নপত্র এরকম সচরাচর ফাঁস হচ্ছে, তখন সে শিশুর কাছে মনে হবে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়াটাই বোধহয় সঠিক নিয়ম। তার মানে শিক্ষার্থীরা মন্দকে মন্দ হিসেবে না জেনে মন্দকে ভালো হিসেবে জানবে।

প্রশ্ন ফাঁস হওয়াতে ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতিতে কেমন প্রভাব পড়বে জানতে চাইলে এই অর্থনীতি বিশ্লেষক বলেন, প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার ফলে দেশের শুধু অর্থনীতিই নয়, সমাজ ও রাজনীতিতেও এর প্রভাব পড়বে। কারণ মানুষ লেখাপড়া করে জ্ঞান অর্জনের জন্য, রেজাল্টের জন্য নয়। যদি এভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের রীতি ধরে রাখা হয়, তাহলে প্রকৃত শিক্ষা হারিয়ে যাবে, জ্ঞানের চর্চা হবে না। সবাই রেজাল্টের পেছনে ছুটবে। আর একটা মানুষ যখন লেখাপড়া করে জ্ঞান অর্জন করবে, তখন সে জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে দেশ ও বিদেশ থেকে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে দেশের জিডিপি, জিএনপি বাড়ায়। কিন্তু যখন তার জ্ঞানই না থাকবে, তখন সে কীসের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করবে? কাজেই প্রকৃত শিক্ষা না পেলে কেউ ভালো অর্থ উপার্জন করতে পারবে না। আর ভালো অর্থ উপার্জন না করতে পারলে তখন দেশের জিডিপি, জিএসপিতে ধস নামবে। এছাড়া এমনিতেই আমাদের দেশে দুর্নীতির প্রলেপ রয়েছে। তাই প্রশ্নপত্র ফাঁস রুখতে না পারলে দেশের অর্থনীতির অবস্থা তলিয়ে যাবে।

প্রশ্নপত্র ফাঁস রোখার উপায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রশ্নপত্র তৈরি থেকে শুরু করে পরীক্ষার হল পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার সকল কাজ যদি একটা কমিটিকে দিয়ে করা হয়, আর কমিটি করার পরেও যদি প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়, তখন সে কমিটিকে ভয়াবহ কোনো শাস্তি অথবা জরিমানা করা হলে শাস্তি ও জরিমানার ভয়ে তারা যথেষ্ট সতর্ক থাকবে। এতে সহজে প্রশ্ন ফাঁস হবে না বলে আমি মনে করি। আর প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ না করতে পারলে আমাদের শিক্ষার সাথে যুক্ত থাকাই উচিত না, কারণ এমন শিক্ষার দরকার নেই।

বর্তমানে পরীক্ষার হলে হলে গিয়ে বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকরা উত্তরপত্র দিয়ে আসছেন এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণেই অসুস্থ কাজ হচ্ছে। আমরা কেন লেখাপড়া করি এটার উত্তর বোধহয় কারো জানা নেই। আর এই বিষয়ে কোন ন্যাশনাল গাইডলাইন নেই। ন্যাশনাল গাইডলাইন না থাকার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিযোগিতায় নেমেছে কে কার চেয়ে বেশি জিপিএ ৫ পাবে। কিন্তু এটা কেউ বোঝে না যে, সব মানুষ সমান নয়। আর সবার পক্ষে জিপিএ ৫ পাওয়াও সম্ভব নয়। কেউ ফেল করলে যে সে খারাপ ছাত্র, এই প্রবাদ আমাদের সমাজ থেকে আগে দূর করতে হবে।

অন্যদিকে শিক্ষকরা হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর, আর সে শিক্ষকরাই যদি শিক্ষার্থীদের অমানুষ হিসেবে তৈরি করেন তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ খোঁড়া হয়ে যবে। আব্রাহাম লিঙ্কন বলেছিলেন, পরীক্ষায় নকল করার চাইতে অকৃতকার্য হওয়া অনেক সম্মানের। কিন্তু আমাদের দেশে সেই সম্মানবোধটা কোথায়? একটা ছোট্ট শিশুর ভেতরে সম্মানবোধ থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যদি শিক্ষকরা সে শিশুর সম্মানবোধ জাগিয়ে না তুলতে পারেন, তাহলে কে তুলবে? আসলে তারা যে শিক্ষক সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। তাদের নিজেদের সম্মান নাই আর দেশকেও সম্মান দিতে জানেন না। আর এই বিষয়ে আলোচনা করাটাও নোংরামি মনে হয়।

বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, আমাদের দেশে শিক্ষা ব্যবস্থার কোন নিয়ন্ত্রণ এবং নিয়ম কানুন নেই। হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির চাইতে ভয়াবহ দুর্নীতি হচ্ছে প্রশ্নপত্র ফাঁস। আর এটাকে রুখতে না পারলে ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতি, সামাজিক মূল্যবোধ সব কিছুই বিপর্যয়ে পড়বে বলে মনে করেন তিনি।

খবরের উৎসঃ Onb24.com

‘দুর্নীতির চেয়েও বড় অপরাধ প্রশ্ন ফাঁস’





Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*