প্রাচীন ভারতের নালন্দা থেকে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের লাইসিয়াম হলো আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বসূরি। আজ একুশ শতকে এসে অনেক কিছুর সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে সেই উচ্চশিক্ষার প্রথাগত ধারণা। দ্য ইকোনমিস্ট অবলম্বনে এ নিয়ে চার পর্বের ধারাবাহিকের আজ পড়ুন তৃতীয় পর্ব।
অক্সফোর্ড, কেমব্রিজের মতো নাম করা অনেক বিশ্ববিদ্যালয় মুকসের মতো নতুন এই ধারণা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় ও চাকরিদাতারা এখনো অনলাইন কোর্সকে প্রথাগত বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রির সরাসরি বিকল্প ভাবতে পারছে না। তারা মনে করছে এটি একটি অতিরিক্ত ডিগ্রি মাত্র।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা শুধু পড়ালেখাই শেখেন না, তাঁরা যুক্তি দিয়ে, বিতর্ক করে, নিজেদের বিষয়গুলোও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিখতে পারেন। অনলাইনে কি এসব শেখা সম্ভব?
এ ক্ষেত্রে এডেক্সের অনন্ত আগরওয়াল একটি বিকল্প প্রস্তাব করেছেন। তিনি বলছেন, চার বছরের ডিগ্রির ক্ষেত্রে হতে পারে প্রথম বছর হবে শিক্ষার্থীরা মুকসের মাধ্যমে শিক্ষার ‘ইন্ট্রোডাকটরি ইয়ার’, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বছর তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পাঠ নেবেন এবং চতুর্থ বছর খণ্ডকালীন চাকরির পাশাপাশি অনলাইনে পাঠ নেবেন।
প্রথাগত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা এবং অনলাইনে শিক্ষার নতুন ধারণার এই সংমিশ্রণ অনেক বেশি আকর্ষণীয় হতে পারে। অনলাইনে উচ্চশিক্ষার আরও কিছু খুঁত আছে বলে মনে করা হচ্ছে। ক্যালিফোর্নিয়ার সান জোসে স্টেট ইউনিভার্সিটি পরীক্ষামূলকভাবে গণিত ও পরিসংখ্যান কোর্স Udacity-এর মাধ্যমে অফার করেছিল। গত বছর তা তারা বাতিল করেছে। কারণ, দেখা গেছে, প্রাথমিক স্তরের বীজগণিতে ক্যাম্পাসের ছাত্রদের ৩০ শতাংশ যেখানে পাস করেছে, সেখানে অনলাইনের শিক্ষার্থীদের পাসের হার ছিল মাত্র ১৮ শতাংশ, অনলাইন ম্যাটেরিয়াল জটিল হওয়ায় এই ব্যবধান বেড়েছে। Udacityও স্বীকার করেছে তাদের শিক্ষাদান দ্রুত আরও উন্নত করতে হবে।
আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে প্রতারণার সুযোগ। অনলাইনের পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা নিজের বদলে অন্য কাউকে পরীক্ষায় বসিয়ে প্রতারণা করতে পারেন। জার্মানিতে একটি অনলাইনভিত্তিক কলেজ এ প্রমাণ পেয়েছে।
সান জোসে স্টেট ইউনিভার্সিটি: পরীক্ষামূলকভাবে গণিত ও পরিসংখ্যান কোর্স Udacity-এর মাধ্যমে চালু করেও পরে বাতিল করে।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, অনলাইনে যাঁরা ডিগ্রি নিচ্ছেন তাঁদের ৭০ ভাগেরই আগে কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি আছে। অনলাইন শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হারও অনেক বেশি। প্রথমবার মাত্র ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী শেষ পর্যন্ত টিকে ছিলেন।
অনলাইনের এই ডিগ্রি আসলেই ডিগ্রি হিসেবে গ্রহণযোগ্য কি না তা নিয়ে অনেকে সংশয়ে আছেন। তবে এ পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছে। এমআইটির সাড়ে চার হাজার শিক্ষার্থীর অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী তাঁদের কোর্সের অংশ হিসেবে মক নিয়েছেন। জন এফ কেনেডি বিশ্ববিদ্যালয়, যেসব প্রতিষ্ঠান মূলত বয়স্কদের ডিগ্রি দিয়ে থাকে, তারাও এডেক্সের মক ক্রেডিট গ্রহণ করা শুরু করেছে। কিন্তু বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় এখনো তা করছে না।
জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি এবং Udacity বিখ্যাত মার্কিন প্রতিষ্ঠান এটিঅ্যান্ডটির সঙ্গে কম্পিউটারের ওপর একটি অনলাইন মাস্টার্স ডিগ্রি দিচ্ছে। অনলাইনে এ ডিগ্রির পেছনে খরচ পড়বে সাত হাজার ডলার। ক্যাম্পাসভিত্তিক প্রতিষ্ঠান থেকে এ ধরনের একটি ডিগ্রির জন্য খরচ পড়ে ২৫ হাজার ডলার।
তাহলে কি পুরোনো ধাঁচের শিক্ষাব্যবস্থা টিকিয়ে রাখাটাই যুক্তিযুক্ত হবে? অনেকেই মনে করেন, সরকারের উচিত হবে নতুন পদ্ধতিকে কার্যকর করানোর চেষ্টা করা। এ ক্ষেত্রে কোর্সগুলোকে একটা নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে এনে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ব্রাজিলের উদাহরণ টানা যায় আবারও। ব্রাজিলে যাঁরা অনলাইনে কোর্স করছেন, সরকারিভাবে তাঁদের আবারও পরীক্ষায় বসতে হয়। বেশির ভাগ পশ্চিমা দেশে স্বাধীন, স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান মুকস ও কোর্স করা ছাত্রছাত্রীদের মান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিতে পারে।
১৮৫৮ সালে জন হেনরি নিউম্যান এনলাইটেনমেন্ট পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপটি কেমন হবে সে নিয়ে ‘দি আইডিয়া অব ইউনিভার্সিটি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। ওই রচনায় তিনি যা বলেছেন, তার সারমর্ম অনেকটা এ রকম—বিশ্ববিদ্যালয় তা-ই, যেখানে একটি বিশদ প্রেক্ষাপটের ওপর দাঁড়িয়ে একজন ব্যক্তি অন্যের সঙ্গে কথা বলেন, যোগাযোগ ও চিন্তার বিকাশ ও বিস্তার ঘটান।’ নিউম্যান তাঁর রচনায় একটি সতর্কবার্তাও উচ্চারণ করেন, তা হলো—প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কহীন উচ্চশিক্ষা বরফখণ্ড, পাথর বা লোহার মতো জড়, প্রাণহীন। হাইটেক অনলাইন কোর্সের যে নতুন ধারা প্রবর্তিত হতে যাচ্ছে, এই ধারাকে নিউম্যানের সতর্কবার্তা মনে রাখতে হবে। তবে দীর্ঘমেয়াদ, ব্যয়বহুল শিক্ষাব্যবস্থার তুলনায় নতুন এই ধারার বিকাশ ঘটবে বলেই মনে হয়, মিলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা কম।
পূর্বে প্রকাশিতঃ প্রথম আলো ডট কম এ
Leave a Reply