যারা বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দিতে ইচ্ছুক, তারা এর মাঝেই ভর্তির মানবণ্টন নিয়ে পর্যাপ্ত ধারণা পেয়ে গেছ৷ তার পরও আরেকবার মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য বলি।
গতবার অর্থাৎ ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা হয়েছিল তিনটি বিষয়ের ওপর। গণিত, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নবিজ্ঞান। ৩০০ নম্বরের লিখিত ও ৩০০ নম্বরের এমসিকিউ (চারটি সম্ভাব্য উত্তরের মধ্যে সঠিক উত্তর বাছাই)। লিখিত পরীক্ষায় তিন বিষয় থেকে মোট ১০টি করে সর্বমোট ৩০টি প্রশ্নের এবং এমসিকিউ প্রশ্নে প্রতি বিষয় থেকে মোট ৪০টি করে ১২০টি প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়।
উল্লেখ্য, এখানে চারটি ভুল উত্তরের জন্য একটি করে সঠিক উত্তর কেটে দেওয়ার কঠিন বিধানও আছে। সুতরাং সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে বৃত্ত ভরাট করা উচিত। লিখিত ও এমসিকিউ পরীক্ষার জন্য এক ঘণ্টা ৩০ মিনিট করে মোট ৩ ঘন্টা সময় বরাদ্দ থাকে। যেহেতু সব বিষয় থেকে সমানসংখ্যক প্রশ্ন আসে, তাই সব বিষয়ই সমান গুরুত্ব দিয়ে পড়া উচিত।
রসায়নবিজ্ঞান: প্রথমে আসি রসায়নবিজ্ঞানের কথায়। রসায়নবিজ্ঞানে আমি ব্যক্তিগতভাবে কিছুটা সমস্যা বোধ করতাম। এ ক্ষেত্রে প্রথম পত্রের পদার্থবিজ্ঞানের অবস্থা, রাসায়নিক গণনা, জারণ-বিজারণ, সাম্যাবস্থা, গতিবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ক অঙ্কগুলোয় একটু বাড়তি জোর দেওয়া উচিত। এ ছাড়া পরমাণুর গঠন, পর্যায়সারণি আর ইলেকট্রন বিন্যাসে গাফিলতি করলে চলবে না।
আর দ্বিতীয় পত্র অনেকের কাছেই পাহাড়সম লাগে। এই বিষয়ে আমার পরামর্শ হলো, ইউপ্যাক নামকরণ, রাসায়নিক বিক্রিয়া, নাম বিক্রিয়া, শনাক্তকরণ আর ব্যতিক্রমী বিক্রিয়াগুলো বারবার করে অনুশীলন করো। গাণিতিক সমস্যার পাশাপাশি এই বিক্রিয়াগুলো থেকেও অনেক প্রশ্ন আসে।
পদার্থবিজ্ঞান: পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম ও দ্বিতীয়, দুটো পত্রই সমান গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে তত্ত্বীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে সম্পূর্ণ পরিষ্কার ধারণা রাখতে হবে। প্রথম পত্রে প্রবাহী পদার্থ, শব্দের গতিবেগ, গতি ও ঘর্ষণের অঙ্কগুলোয় কোনো ধরনের অস্পষ্টতা থাকলে এক্ষুনি সেগুলো বুঝে নেওয়ার সময়।
আর দ্বিতীয় পত্রে চলবিদ্যুতের বর্তনীর অঙ্ক, আলোর প্রতিসরণ বা আপেক্ষিকতার মারপ্যাঁচে যাতে সহজে আটকে না পড়ো, সেই চেষ্টা করো। পদার্থবিজ্ঞান থেকে তত্ত্বীয় পরীক্ষার জন্য অনেক বেশি গাণিতিক সমস্যা অনুশীলনের কোনো বিকল্প নেই। তবে অবশ্যই বিষয়গুলোর ওপর তোমার যথেষ্ট দখল থাকতে হবে।
গণিত: বীজগণিতের জন্য বিন্যাস সমাবেশের ধারণা পরিষ্কার করে রাখা ভালো। অনেক বেশি জোর দিতে হবে দ্বিপদী ও ধারার যোগফলে। জ্যামিতিতে বৃত্ত ও কনিকের সমস্যাগুলোতে যাতে কোনো অস্পষ্টতা না থাকে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। আর ত্রিকোণমিতির ক্ষেত্রে বোর্ডের অঙ্কগুলো ঠিকঠাক চর্চার মধ্যে থাকতে হবে।
দ্বিতীয় পত্রে ক্যালকুলাসে ইন্টিগ্রেশন (সমাকলন) নিয়ে অনেকেরই সমস্যা থাকে। এগুলো যত দ্রুত সম্ভব সমাধান করে নতুন নতুন অঙ্ক চর্চা করতে হবে। আর বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর সমস্যা দেখা যায় বলবিদ্যার অঙ্কগুলো উচ্চমাধ্যমিকে না করে আসায়। এ ক্ষেত্রে আমার পরামর্শ হলো, উপপাদ্য যেগুলো শিখেছ, সেগুলো প্রয়োগ করে বোর্ডের সমস্যাগুলোর সমাধান করো। নতুন কিছু টেকনিক নিজে তৈরি করো। আর অবশ্যই ক্যালকুলেটর ব্যবহার ভালোভাবে শিখে রাখো। বুয়েট ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে যেসব ক্যালকুলেটর অনুমোদন করা হয়, পরীক্ষায় তার মধ্যে থেকে যেকোনোটিই ব্যবহার করা শ্রেয়।
কিছু সতর্কতা
ভর্তি পরীক্ষার সময় আমার মাথায়ও অনেক প্রশ্ন আসত, যেগুলো পরবর্তী সময়ে আমাকে অসংখ্যবার অনেকের কাছ থেকে শুনতে হয়েছে। এই প্রশ্নগুলো ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের মৌলিক প্রশ্ন। অনেকেই জানতে চায়, বুয়েটে চান্স পেতে হলে দিনে মোট কত ঘণ্টা পড়াশোনা করা উচিত। আসলে সত্যি বলতে ঘণ্টা দিয়ে এই সময়ের পড়াশোনা বিচার করা যায় না। কারও ঘণ্টা তিন-চারেক পড়লেই হয়ে যায়, কারও বা দিনে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টাও যথেষ্ট মনে হয় না। যতক্ষণ কোনো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ধারণা পরিষ্কার না হয়, ততক্ষণ পড়তে থাকো। শিক্ষকদের সাহায্য নাও। বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করো। কিন্তু অস্পষ্টতা রেখো না। কোনো ধরনের জড়তা বা লজ্জা না রেখে যেদিনের পড়া সেদিনই সম্পূর্ণ পড়ে রাখলে পড়া জমে থাকে না। এতে স্পষ্ট ধারণাও পাওয়া যাবে। পড়ার চাপও কমবে। বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষায় বিগত বছরের প্রশ্ন আসে কি না, এমন প্রশ্নও অনেকের মুখে শোনা যায়। সাধারণত আসে না। তবে একই ধাঁচের ভিন্ন ডিজিট দিয়ে অথবা কিছু অংশ ঘুরিয়ে প্রশ্ন আসতে পারে।
উল্লেখ্য, বিভিন্ন গাইডবই ও লেকচার শিট তোমার জন্য একটা গাইডলাইন হিসেবে কাজ করতে পারে, কিন্তু কখনোই তা মূল বইকে ছাপিয়ে নয়। সব থেকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া উচিত বোর্ড অনুমোদিত বইগুলোর ওপর। কারণ প্রশ্ন এই বইয়ের আলোকেই হবে। তবে সময় থাকলে নিজের অনুশীলনের জন্য এবং অভিজ্ঞতা বাড়ানোর জন্য গাইডবই, লেকচার শিট ছাড়াও বুয়েটসহ অন্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিগত বছরে আসা প্রশ্নগুলোর সমন্বয়ে তৈরি প্রশ্নব্যাংক সমাধান করা উচিত। বুয়েটে সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে তোমার মেধা, পরীক্ষার হলে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে নিজের সেরাটা ঢেলে দিতে পারছ কি না, এই জিনিসগুলোই সব থেকে বেশি ভূমিকা রাখে।
বুয়েটে সুযোগ পাওয়ার জন্য ন্যূনতম কত নম্বর দরকার হয়, এটা কমবেশি সব শিক্ষার্থীর মনেই ঘুরতে থাকা আরেকটি অতি সাধারণ প্রশ্ন। এটা পরিবর্তনশীল। এর কোনো নির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই। প্রাপ্ত নম্বর আজ পর্যন্ত কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ পায়নি। তাই বলা যায়, প্রশ্ন কতটা কঠিন অথবা সহজ হলো, তার ওপর এটা নির্ভর করে। তবে আমি বিশ্বাস করি, তুমি যদি ঠিকঠাকমতো প্রস্তুতি নাও এবং পরীক্ষায় জানা জিনিস ভুল করে না আসো, তোমার ভর্তির সুযোগ বাড়বে।
সুতরাং, আর দেরি না করে আর মাস খানেক সময় নিজের সর্বোচ্চ পরিশ্রমটুকু করে যাও। এখন থেকে যখনই সময় পাওয়া যায়, তার সদ্ব্যবহার করবে। জানা জিনিসগুলো বারবার অনুশীলন করো আর অস্পষ্ট থেকে যাওয়া বিষয়গুলোর প্রতি আরও যত্নবান হও। তোমাদের মেধাবী মুখগুলো দ্বারা আমাদের বুয়েট ক্যাম্পাস মুখরিত হবে, সেই প্রত্যশা রইল। শুভকামনা তোমাদের জন্য।
Leave a Reply