বিকেএসপির খেলোয়াড়দের দাপট এখন জাতীয় দলের সব খেলাতেই। জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম, সাবেক অধিনায়ক নাইমুর রহমান দুর্জয়, বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান, ফুটবলার এমিলি, হাসান আল মামুন, মাসুদ রানা, হকি খেলোয়াড় জিমি, শ্যুটার আসিফ হোসেন, শারমীন আক্তার—তাঁরা সবাই বিকেএসপির আবিষ্কার।
‘পড়াশোনা আর খেলাধুলা—একটা যেন আরেকটার ঘোর শত্রু। দালিলিক কোনো প্রমাণ না থাকলেও অভিভাবকদের মুখ দেখলেই সেটা বোঝা যায়। খেলার নেশায় পেয়ে বসলে সন্তান নাকি বখে যায়। কিন্তু বখে গিয়ে যদি তৈরি হয় একজন সাকিব, একজন মুশফিক, একজন এমিলি, একজন জিমি। ক্ষতি কী? তা ছাড়া এরা তো পড়াশোনা আর খেলার ভেতরে কোনো বিরোধ দেখে না। পড়াশোনার পাশাপাশি আপনার সন্তান হতে পারে একজন তারকা খেলোয়াড়।’
বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) মহাপরিচালক মো. এমাদুল হকের এসব কথা যেন সব খেলাপ্রিয় ছেলেমেয়ের কথা। দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রের তারকা খেলোয়াড়দের অধিকাংশই তৈরি হয় বিকেএসপি থেকে। কি ক্রিকেট, কি ফুটবল, হকি, অ্যাথলেটিকস বা সাঁতার—সবখানেই তারকা খেলোয়াড়ের বেশির ভাগই বিকেএসপির শিক্ষার্থী।
পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলার প্রশিক্ষণ নেওয়ার একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান বিকেএসপি। দেশের খেলাপাগল শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পাশাপাশি খেলার প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে তারা। আন্তর্জাতিক মানের অনেক খেলোয়াড় তৈরি হচ্ছে তাদের হাত ধরেই। ঢাকার সাভারের জিরাবোতে ১১৫ একর জমির ওপর বিকেএসপি প্রতিষ্ঠিত। আনুষ্ঠানিকভাবে এর পথচলা শুরু হয় ১৯৮৬ সালের ১৪ এপ্রিল। বর্তমানে দেশের চারটি স্থানে রয়েছে বিকেএসপির আঞ্চলিক কেন্দ্র। খুলনা, দিনাজপুর, বরিশাল ও চট্টগ্রামের এসব আঞ্চলিক কেন্দ্রে পড়াশোনা ও খেলাধুলা করার সুযোগ রয়েছে। সাভারের মূল কেন্দ্র এবং আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলো মিলিয়ে মোট ১৭টি খেলা শেখার সুযোগ রয়েছে এখানে। সাধারণত ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীতে প্রতিবছর আসন খালি হওয়া সাপেক্ষে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। সম্পূর্ণ আবাসিক ব্যবস্থায় চলে পড়াশোনা ও খেলাধুলার নিবিড় পরিচর্যা। আঞ্চলিক কেন্দ্রসহ বর্তমানে বিকেএসপিতে ৭৩৫ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। মহাপরিচালক এমাদুল হকের মতে, ‘সারা দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা পড়ছে এখানে। প্রশিক্ষণ নিচ্ছে নিজের পছন্দের খেলাধুলার। আর প্রতিষ্ঠানটিতে পড়াশোনা ও খেলাধুলাচর্চার শিক্ষকেরা কিন্তু যথেষ্ট মেধাবী। তাই দুটোই চালিয়ে নিতে পারে শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া ডিসিপ্লিনের মাধ্যমে এখানে তারা সারাক্ষণ নিজেদের কাজ করে।’ মোট ১৭টি খেলার মধ্যে ঢাকা মূল কেন্দ্রে শেখানো হয় ১২টি বিষয়ে। খেলাধুলার এসব বিষয় হচ্ছে ক্রিকেট, ফুটবল, হকি, অ্যাথলেটিকস, সাঁতার, আর্চারি, বাস্কেটবল, বক্সিং, জুডো, জিমনেসটিকস, শ্যুটিং ও টেনিস। এসব খেলার কিছু অংশ ছাড়াও আঞ্চলিক কেন্দ্রে নতুন খেলা হিসেবে আছে তায়কোয়ান্দো, টেবিল টেনিস, উশু, কারাতে ও ভলিবল। মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, খুব তাড়াতাড়ি চালু করতে চান কাবাডি ও গলফ খেলা।
যারা পড়তে চাও
মূলত খেলাধুলা ও পড়াশোনাটা একসঙ্গে চলে এখানে। তাই যারা পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলায় নিজের ক্যারিয়ার গড়তে চায়, তারা ভর্তি হতে পারে বিকেএসপিতে। প্রতিবছরের শেষ দিকে পত্রিকা ও টিভিতে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এরপর আবেদন ফরম নিয়ে পূরণ করে জমা দিতে হয়। সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি করা হয়। তবে কিছু খেলায় তৃতীয় শ্রেণী থেকে ভর্তি নেওয়া হয়। এরপর আবেদনপত্র থেকে বাছাই করা শিক্ষার্থীদের ডাকা হয় নির্ধারিত দিনে। মূলত দেখা হয় তার খেলার যোগ্যতা। ভালো শিক্ষার্থীদের বাছাই করে মেডিকেল চেকআপের পর ভর্তি করিয়ে নেওয়া হয় বিকেএসপিতে। ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সের শিক্ষার্থীরা আবেদন করতে পারে। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও ডিগ্রি পড়ার সুযোগ রয়েছে এখানে। মূলধারার পাঠ্যবই পড়েই একাডেমিক পরীক্ষায় বসতে হয় শিক্ষার্থীদের। সম্পূর্ণ আবাসিক এই প্রতিষ্ঠানে ছেলেদের জন্য চারটি হোস্টেল ও মেয়েদের জন্য রয়েছে একটি হোস্টেল। ভর্তি হতে সর্বমোট ২০ হাজার টাকার মতো লাগে। আছে মাসিক বেতন। তবে এটা নির্ভর করে অভিভাবকের আয়ের ওপর।
প্রতিবছর একেকটি খেলায় যে কয়টি আসন খালি হয়, তার বিপরীতেই শিক্ষার্থী ভর্তি নেওয়া হয়।
পড়াশোনা ও খেলাধুলার রুটিন
বিকেএসপির প্রশিক্ষণ বিভাগের উপপরিচালক শামীমা সাত্তার বলেন, ‘সপ্তাহে ছয় দিন প্র্যাকটিস ও একাডেমিক পড়াশোনা চলে এখানে। সপ্তাহে তিন দিন সকালে এক ঘণ্টা খেলার প্র্যাকটিস শেষে ক্লাসে ছুটতে হয় বইপত্র নিয়ে। সকাল ১০টা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত চলে একাডেমিক পড়াশোনা। এরপর রুমে গিয়ে বিশ্রাম এবং খাওয়াদাওয়া। বিকেল সাড়ে তিনটা থেকে আবার মাঠে প্র্যাকটিস।’ রাতে আবার ক্লাসে বসেই চলে পরের দিনের প্রিপারেশন পিরিয়ডের পড়াশোনা। তবে সকাল ও বিকেলের প্র্যাকটিসের সময় শীত ও গ্রীষ্মভেদে কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে। শুক্রবার ছুটি থাকে।
ট্যালেন্ট হান্ট প্রতিযোগিতা
বছরজুড়ে বিকেএসপি আয়োজন করে প্রতিভা অন্বেষণের। বিভিন্ন খেলায় যারা খুব ভালো, জেলা পর্যায়ে বাছাই করা হয় তাদের। এরপর তাদের এক মাস, দুই মাস, তিন মাস নানা ধরনের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের মাধ্যমে বাছাই করা হয়। এরপর এদের ভর্তি করে নেওয়া হয় বিকেএসপিতে।
এছাড়া বিকেএসপি সম্পর্কে জানা যাবে তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট www.bksp-bd.org থেকে।
মূল লেখকঃ হাসান ইমাম
প্রথম আলোর স্বপ্ন নিয়েতে পূর্বে প্রকাশিত
Leave a Reply