পিএসসি ও জেএসসিঃ টেক্সট বই বনাম টেস্ট পেপারস

সম্প্রতি আমার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর একটি ‘টেস্ট পেপারস’ দেখার সুযোগ ঘটে। টেস্ট পেপারসটি আমি আবিষ্কার করি একটি পড়ার টেবিলে, একাধিক বইয়ের সঙ্গে আরেকটি বই হিসেবে। তাই একে টেস্ট বুক বলা সমীচীন। তা ছাড়া ‘চূড়ান্ত সাজেশন্স, মডেল প্রশ্ন ও উত্তরমালা’ সংবলিত বই আকারে মুদ্রিত ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে বিশাল গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটিকে বই বলাই শ্রেয়। যার যা মর্যাদা। আবার এটির এতই ক্ষমতা যে শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সবাই টেক্সট বইয়ের পরিবর্তে টেস্ট বইকে গুরুত্ব দিচ্ছে। যে টেক্সট বই লেখা হয় প্রতিটি বিষয়ের জন্য নির্ধারিত শ্রেণিভিত্তিক প্রত্যাশিত অর্জন-উপযোগী যোগ্যতাকে থেকে পাওয়া শিখন ফলের ভিত্তিতে। যাতে যোগ্যতার শতভাগ যেন অর্জিত হয়, সে চেষ্টা করা হয়। প্রতিটি বিষয়ের জন্য নির্ধারিত শ্রেণিভিত্তিক প্রত্যাশিত অর্জন- উপযোগী যোগ্যতা অর্জনের অবলম্বন টেক্সটবুকের পাঠ ও অনুশীলনী বা পাঠশিখির কর্মতৎপরতাগুলো। যার সব পাঠ ও অনুশীলনী বা পাঠশিখির কর্মতৎপরতাগুলো শিশুর ওই শ্রেণিতে পঠন-পাঠন-চর্চার মাধ্যমে অর্জন হওয়া জরুরি। তাই, এনসিটিবির টেক্সট বই শিক্ষার্থীদের পঠন-পাঠন-চর্চা করা অপরিহার্য কর্তব্য। সেখানে টেক্সট বই এড়িয়ে এমনকি বাদ দিয়ে টেস্ট পেপারস বা টেস্টবই তুলে নিয়েছে ছাত্রছাত্রীরা।

আমি বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য মাধ্যম থেকে শুনে আসছিলাম। তাই খুবই কৌতূহলী হয়ে বিশেষ জায়গায় রাখা জিনিসটি গোপনে দেখে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। টেস্ট পেপারসে দেখলাম- NAPE প্রদত্ত চূড়ান্ত প্রশ্নকাঠামো ও নম্বর বিভাজন, NAPE প্রদত্ত চূড়ান্ত প্রশ্নকাঠামো ও নম্বর বিভাজনের আলোকে চূড়ান্ত সাজেশন্স উত্তরমালা, NAPE-প্রদত্ত চূড়ান্ত প্রশ্নকাঠামো ও নম্বর বিভাজনের আলোকে চূড়ান্ত মডেল টেস্ট ও উত্তরমালা, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ইত্যাদি শিরোনামে সাজেশন্স উত্তরমালা, চূড়ান্ত মডেল টেস্ট ও উত্তরমালা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র।

টেস্ট পেপার পড়ার উদ্দেশ্য– প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী তথা পিএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল পাওয়া।

অন্যদিকে টেক্সট বইয়ের উদ্দেশ্য-শিক্ষাক্রমে নির্ধারিত প্রান্তিক/ শ্রেণিভিত্তিক যোগ্যতা অর্জন। যা টেক্সট বই পড়া ও নানা কর্মতৎপরতা বা অ্যাক্টিভিটির মাধ্যমে শিখন শেখানো কার্যাবলির মাধ্যমে অর্জিত হয়।

সহজ করে বললে ‘শিক্ষা’র উদ্দেশ্যভিত্তিক যোগ্যতা অর্জন। ‘শিক্ষা’র উদ্দেশ্যভিত্তিক যোগ্যতা অর্জন বনাম পরীক্ষায় ভালো ফল অর্জন– দুয়ের মধ্যে পরীক্ষায় ভালো ফল করা বেছে নিয়েছে শিক্ষার্থী-অভিভাবক-শিক্ষকরা। তবে তারা পরীক্ষায় ভালো ফল করাকে পুরোপুরি স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে বেছে নেয়নি। পিএসসি, জেএসসির চাপাচাপিতে বাধ্য হয়েছে। আসলে জেএসসি ও পিএসসি চালু করার পর ‘শিক্ষা’ বনাম ‘পরীক্ষা’ (তথা পরীক্ষাপ্রস্তুতি) মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেল। হেরে গেল ‘শিক্ষা’ (সাময়িকভাবে)। শক্তি ও ক্ষমতার জোরে জয়ী হলো ‘পরীক্ষা’ (সাময়িকভাবে)। এটা যে সাময়িক হবে, এটা আমরা সবাই বলেছি। ধোপে টেকেনি। কেউ শোনেনি। এখন বলতে পারে, কই কখন তোমরা বলেছ? শুনিনি তো।

শিক্ষা ও শিক্ষাক্রমের প্রতিভূ টেক্সট বই এড়িয়ে এমনকি বাদ দিয়ে পরীক্ষায় ভালো ফল করার অবলম্বন টেস্ট পেপারস বা টেস্ট বই অনেকটা ‘বাটা’র নকল ‘রাটা’র মতো। বাটার পরিবর্তে রাটা কিনলে যা হয়, টেক্সট বই বাদ দিয়ে টেস্ট বই পড়ে পিএসসি-জেএসসি এসসসি-এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো করার পরিণাম একই রকম যে, তা ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। মাঝখানে টেস্ট পেপার, নোট বই,
গাইড ব্যবসায়ীরা কামিয়ে নিয়েছে। আফসোস, এখনো তা বন্ধ হয়নি। আমাদের নাম-করা জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোও পিছিয়ে নেই। তারাও পিএসসি, জেএসসি ইত্যাদির জন্য প্রস্তুতিমূলক পাতা বের করছে। উদ্দেশ্য, ছাত্রছাত্রী- অভিভাবকরা পত্রিকা কিনবে, নিয়মিত চমৎকার বাণিজ্য হবে। তা-ই হচ্ছে। বাজারের নোট বই, টেস্ট পেপার (টেস্ট বুক), গাইডের মতোই তাদের বিজ্ঞাপনের ভাষাও একই- ‘প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি, (NAPE)- এর সর্বশেষ প্রশ্নকাঠামো অনুসারে এ পাতার প্রতিটি লেখা সাজানো হয়েছে, যা প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার্থীদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’ সৃজনশীলতার শীর্ষের দাবিদার অনুপম প্রকাশনীর টেস্ট পেপারে লেখা ‘NAPE-এর চূড়ান্ত প্রশ্নকাঠামো ও নম্বর বিভাজনের আলোকে চূড়ান্ত সাজেশন্স/মডেল টেস্ট ও উত্তরমালা।’ আসলে কি কোনো পার্থক্য আছে? পঞ্চম শ্রেণিতে এসে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার্থী হয়ে পুরোপুরি, বহাল তবিয়তে। তাদের জন্য টেস্ট পেপার, নোট বই, গাইড অনুসরণে প্রশ্ন, উত্তর সাজেশনসহ প্রতিদিন পাতা বের করছে পত্রিকাগুলো। আবার একটি নামকরা পত্রিকার নিচে উদ্ভাসের পক্ষে লেখা হয়েছে, ‘নোট বই বা গাইড কখনোই মূল বইয়ের বিকল্প হতে পারে না।’ অনেকটা সিগারেটের প্যাকেটে যেমন সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ হিসেবে লেখা থাকে, ‘ধূমপানের কারণে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা হয়’, তাই নয় কি? প্রকাশ্যে চলছে সবই, যেন দেখার কেউ নেই। চারদিকে শুধু বাণিজ্য। বাণিজ্যের লক্ষ্যে লক্ষ্মীর পূজা; সরস্বতীর প্রয়োজন নেই। শিক্ষা, সামাজিক দায়বদ্ধতা, ইতিহাস সবই ছাড়তে পারি যেমন রবীন্দ্রনাথ  বলেছেন, ‘ন্যায় অন্যায় জানিনে জানিনে, শুধু তোমারে জানি ওগো সুন্দরী।’ এখানে এসব পুরোনো ও নব্য বেনিয়াদের জন্য প্রযোজ্য হবে, ‘ন্যায় অন্যায় জানিনে জানিনে, শুধু বেনিয়াগিরি জানি শুধু বেনিয়াগিরি।’

উল্লেখ্য, অর্থের জন্য এসব অপকর্ম- টেস্ট পেপার, নোট বই গাইড পুরোনো ঘটনা, নতুন করে (তাও অনেক বছর হয়ে গেল) যুক্ত হলো পত্রিকা- বেনেদের পত্রিকায় পরীক্ষাপ্রস্তুতিমূলক পাতা। এটি একটি সাহসী পদক্ষেপ। কারণ কী? তারা মিডিয়ার লোক বলে? এটা ঠিক, এসব অপকর্মের প্রতিটি ক্ষেত্রে কোনো-না- কোনো শিক্ষক জড়িত। তারাও বেনিয়ার টানে টু-পাইস কামাতে বেনিয়াদের ডাকে সাড়া দেন কিন্তু অপকর্ম করেন তা বুক ফুলিয়ে ছাতি উঁচিয়ে নাম দিয়ে বলেন না। এই টেস্ট পেপার, নোট বই, গাইড লিখে লেখক হিসেবে দাবি করেন না। কিন্তু পত্রিকার বেনিয়ারা প্রকাশ্যে শিক্ষকদের এতে লেখক স্বীকৃতি দিয়ে হাজির করেছেন। যা-ই হোক, এসব
বেনিয়াগোষ্ঠী তাদের বেনিয়াকর্ম করবে- এটাই স্বাভাবিক। তাদের কারো কানেই ধর্মের বাণী, নৈতিকতার বচন, সামাজিক দায়বদ্ধতার আপ্তবাক্য শুনিয়ে ফল হবে না। তাদের কাছে তাদের বাণিজ্যিক অপকর্ম বন্ধ রাখার কথা বলা বাতুলতা। পুরোনো বেনেরা তো কিছু বলবে না। নব্য বেনিয়ারা বরং নিজেদের অপকর্মের পক্ষে সাফাই যুক্তি তুলে ধরতে মিডিয়াকে ব্যবহার করতে ছাড়বে না। অতীতে বেনিয়াদের পক্ষে কোনো কোনো মিডিয়া ও মিডিয়া ব্যক্তির অবস্থান দেখেছি। কোনো কোনো (আগের) সম্মানিত ব্যক্তিকেও দাঁড়াতে দেখেছি। তাদের বর্তমানে সম্মান করা সম্ভব নয়। অনেক (আগের) সম্মানিতরা বর্তমানে যা করছেন, তাদের বেনিয়া বলে অতীতে চিনতে ভুল করার জন্য অনুশোচনা হয়। যা-ই হোক, আমাদের যখন বেনিয়া- চরিত্র প্রাধান্য পেয়ে যায়, তখন আমরা ধর্ম, নৈতিকতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা সব বিসর্জন দিতে দেখি হাসিমুখে। তাই বেনিয়াদের প্রতি আর ক্ষোভ ঝাড়া নয়। বরং যাদের দায়িত্ব বিরত থাকার– শিক্ষক, শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ– যাদের এসব অপকর্ম বিরত রাখা কর্তব্য– তাদের উচিত পিএসসি, জেএসসিরনামে আমাদের  শিশু ‘শিক্ষার্থীদের’ আর ‘পরীক্ষার্থী’তে রূপান্তরের চেষ্টা বন্ধ করা– তথা দুটি পাবলিক পরীক্ষা বন্ধ করা। তাহলে এই দুটি পরীক্ষার সঙ্গে অপজাতকর্ম- শিক্ষাবাণিজ্য– টেস্ট পেপার, নোট, গাইড, পত্রিকায় পরীক্ষাপ্রস্তুতিমূলকপাতা– বন্ধ হয়ে যাবে। এই যে পাবলিক প্রতিযোগিতামূলক পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষা, এসবের কুফল-পচা জল কোথায় কতদূর গড়িয়ে গেছে তা ভুক্তভোগী ও সন্তানের তথা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষা নিয়ে যারা চিন্তা ভাবনা করে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত তারা জানেন। এই পাবলিক প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রভাবে প্রাইমারির নিচের স্তরের ক্লাস, (সৃজনশীল পদ্ধতির প্রভাবে এনসিটিবির বইয়ের অনুশীলনী পর্যন্ত) এবং কোনো কোনো প্রাইভেট স্কুলে (যত দূর জেনেছি) নিচের শ্রেণি থেকে কয়েক বছর ধরে এরিয়াভিত্তিক বৃত্তি পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। যেন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জয় জয়কার। দ্বিতীয় শ্রেণির শিশু এরিয়াভিত্তিক প্রতিযোগিতামূলক বৃত্তি পরীক্ষার জন্য রাত-দিন প্রশ্ন- উত্তর সমাধান করছে তথা মুখস্থ করছে। টেক্সট বই পড়ার সময় পায় না। নিচের ক্লাস থেকেই শিশুকে পিএসসির আদলে মজবুত ভিতের ওপর পরীক্ষার্থী বানানোর যে চেষ্টা চলছে, পাঠ্যবই সরিয়ে রেখে প্রশ্নের সেট থেকে উত্তর মুখস্থ করানোর যে প্রবণতা তা দেখে আতঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই।





About অরণ্য সৌরভ 47 Articles
আমি অরণ্য সৌরভ, লেখাপড়া করছি সরকারী সফর আলী কলেজ আড়াইহাজার, নারায়নগঞ্জ। পাশাপাশি কবি ও সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছি মাসিক "হাতেখড়ি"তে showrov2500@gmail.com

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*