শিক্ষা নিয়ে বিতর্ক চলুক

দেশের শিক্ষার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয়েছে। গত কয়েক দশকে এমন জোরালো বিতর্ক আর কখনো হয়েছে বলে মনে পড়ে না। এই বিতর্ক অবশ্যই একটি শুভ লক্ষণ। আমরা শিক্ষাবিতর্ককে স্বাগত জানাই। লক্ষণীয়, সমাজের প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ যার যার অবস্থা থেকে এই বিতর্কে অংশ নিচ্ছে।বিতর্ক

তার মধ্যে খুবই অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদেরা যেমন আছেন, তেমনি আছে আজকের তরুণ সমাজও, যারা আগামী দিনের বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে। একাডেমিক আলোচনা যেমন আছে, তেমনি আছে যুক্তিবহির্ভূত কথাবার্তাও। রাজনৈতিক কাদা-ছোড়াছুড়ির বিপরীতে আমাদের জনগণের এই অবস্থান পরিবর্তন, শিক্ষাবিতর্কে অংশগ্রহণ আমাদের আশান্বিত করেছে। আশা করি, এই বিতর্ক জারি থাকবে এবং গুণীজনের অংশগ্রহণ আরও বাড়বে।

শিক্ষা যেমন জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া, তেমনি তার উৎকর্ষের জন্য লাগাতার কাজ করতে হয়। জ্ঞান সাধনায় শীর্ষবিন্দু বলে কিছু নেই। তাই ‘সব অর্জিত হয়েছে’ বলে দুনিয়ার কোনো জাতি আত্মতুষ্টিতে আক্রান্ত না হয়ে লাগাতার গবেষণা করে অধিকতর উৎকর্ষের জন্য।

 

শিক্ষা কেমন হওয়া উচিত, এ বিতর্ক কখনোই শেষ হবে না। শিক্ষা ও সভ্যতার মধ্যকার দৌড়বাজিতে শিক্ষা যদি পিছিয়ে পড়ে, তাহলে সভ্যতারই পতন ঘটে। অন্য যেকোনো সম্পদের চেয়ে মানবসম্পদকে সবচেয়ে মূল্যবান বলে গণ্য করা হয়। মানবসম্পদ উন্নয়নের মূল সূত্র হলো শিক্ষা। তাই মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করার তাগিদ এখন বিশ্বব্যাপী। প্রায় তিন দশকের যুদ্ধে বিধ্বস্ত ভিয়েতনাম শিক্ষা খাতে জিডিপির ৬ দশমিক ৬ শতাংশ বিনিয়োগ করে প্রতিযোগিতাময় বিশ্বে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে, যেখানে আমাদের বিনিয়োগ দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন, মাত্র ২ দশমিক ২ শতাংশ। জিডিপির অন্তত ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করতে পারলে আমরা সার্কভুক্ত দেশের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারতাম।

 

হালের শিক্ষাবিতর্কে একটি প্রশ্ন প্রধান হয়ে উঠেছে। সংখ্যাগত সাফল্য গুণগত মানকে নিম্নগামী করছে কি না। শিক্ষার স্তরভেদে শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারিত হয়। আমরা যে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছি, তা প্রায় সবার সমর্থন লাভ করলেও বাস্তবায়নে আমাদের অর্জন বা অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক নয়। ২০১০ সালে শিক্ষানীতি গৃহীত হলেও একই সরকার কেন তা দ্রুত বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে পারছে না, তা অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখতে হবে। ইতিমধ্যে প্রায় পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। আজকের দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে বছর দশেক পরই আরও আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা জরুরি হয়ে পড়বে।

 

আমাদের শিক্ষা বহুধাবিভক্ত। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্য। গ্রাম-শহরের শিক্ষায় দৃষ্টিকটু বৈষম্য, বৈষম্য ধনী-দরিদ্রের শিক্ষালাভের সুযোগে। দুই দশক আগে বেসরকারি খাতে শিক্ষার দায়িত্ব অর্পণ করার ফলে শিক্ষা পরিণত হয়েছে দামি পণ্যে এবং শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গ্রামীণ, দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। যে শিক্ষা তাদের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে, তা রুটি-রুজির কোনোটারই নিশ্চয়তা দিতে পারছে না, মর্যাদার প্রশ্ন সেখানে একেবারে অবান্তর।

শিক্ষার মৌল ধারণাগুলো যেন আমরা বিস্মৃত না হই। মানবসম্পদ উন্নয়নে শিশুকে তিনটি মৌলিক বিষয়ে পারদর্শী করে তুলতে হয়। এক. ভাষাজ্ঞান, দুই. গাণিতিক জ্ঞান এবং তিন. সমাজ ও প্রকৃতি–সম্পর্কিত জ্ঞান। ভাষা হলো চিন্তার বাহন। তাই শিশুর ভাষাশিক্ষার ভিত মজবুত না হলে চিন্তার ক্ষেত্রে সে বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে। চিন্তাজড়তা জ্ঞান অর্জনের পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

গণিতকে বলা হয় জ্ঞানের জননী। দুনিয়ার তাবৎ বিজ্ঞান গণিতের অধীনে। গাণিতিক জ্ঞান ছাড়া যৌক্তিক চিন্তা অসম্ভব। যৌক্তিক চিন্তা করতে ব্যর্থ হলে সে ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। তাই শিশুকে গাণিতিক জ্ঞানে ঋদ্ধ করে তোলা জরুরি। এর সঙ্গে যুক্ত হতে হয় সামাজিক ও নাগরিক নিয়ম–রীতি, আচার-আচরণ, শৃঙ্খলা, মূল্যবোধ, নৈতিকতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় পরিচয় ও নান্দনিকতা। ১১ বছর বয়সের মধ্যে শিশুমনে এসব বিষয়ে দৃঢ় ভিত্তি তৈরি না হলে পরবর্তী জীবনে তার চিন্তার জগতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটানো যায় না। শিশু মনোবিজ্ঞানীরা তাই প্রাথমিক শিক্ষার ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দেন। এই ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে অনুসন্ধিৎসু শিশু মাধ্যমিক স্তরের জ্ঞানালোকে বিশ্ব, সমাজ, প্রকৃতিকে উপলব্ধি করতে শেখে। সারা পৃথিবীতে তাই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়।

 

আমরা প্রাথমিক শিক্ষাকে (অবশ্যই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত) বলতে পারি বুনিয়াদি শিক্ষা, যা শিশুর ভবিষ্যৎ জীবনের গতিমুখ নির্ধারণ করে দেয়। প্রত্যেক শিশুকে এই বুনিয়াদি শিক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। আমাদের সংবিধানেও সেই স্বীকৃতি আছে। মাধ্যমিক শিক্ষা (দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত) হতে হবে জীবিকার জন্য শিক্ষা। শিক্ষাব্যবস্থাকে তাই এমনভাবে ঢেলে সাজানো দরকার, যাতে মাধ্যমিক স্তর অতিক্রম করে একজন তরুণ কর্মজীবনে প্রবেশ করার মতো জ্ঞান ও কর্মদক্ষতা অর্জন করতে পারে।

উচ্চশিক্ষা হবে সেই সব মেধাবীর জন্য, যাঁরা গবেষণা করবেন, পরিকল্পনা প্রণয়ন করবেন, নতুন নতুন জ্ঞানের বিকাশ ঘটাবেন। এর জন্য তাঁরা নিরন্তর গবেষণায় নিয়োজিত থাকবেন। মাঝারি বা নিম্ন মেধার মানুষের জন্য উচ্চশিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত রাখার অর্থ মানবসম্পদের অবচয়।

 

আজকের আলোচনা প্রাথমিক শিক্ষায় সীমাবদ্ধ রাখতে চাই। দেখা যাক, শিক্ষার মৌলিক বিষয়গুলোকে আমরা কীভাবে ধারণ ও লালন করছি। প্রথমে আমরা আমাদের সাফল্যগুলো চিহ্নিত করতে পারি। বাংলাদেশে ৯৮ শতাংশ শিশু এখন স্কুলগামী। তারা বছরের প্রথম দিনেই পাঠ্যবই হাতে পায়। স্কুলগামী ছেলেমেয়ের সমানুপাত প্রশংসনীয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়নও চোখে পড়ার মতো। সেখানে এখন গড়ে তিনজন শিক্ষক কর্মরত। তঁাদের ৫০ শতাংশের বেশি আবার সি-ইন-এড, অনেকেই বিএড বা এমএড প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। দেশের সব রেজিস্টার্ড প্রাইমারি স্কুলকে সরকারি করার মাধ্যমে শিক্ষকদের বেতন ও অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। ক্লাস্টার পদ্ধতির মাধ্যমে শ্রেণি পাঠদানে নজরদারি ও দক্ষতা বিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

 

কিন্তু এত সাফল্যের পরও কয়েকটি মৌলিক সমস্যা সমাধানে আমাদের সাফল্য অনুজ্জ্বল। প্রধান ব্যর্থতা হলো ভালো কারিকুলাম প্রণয়ন এবং শিশুদের জন্য ভালো পাঠ্যপুস্তক রচনায়। উত্তম শিক্ষার জন্য উত্তম পাঠ্যপুস্তক এবং প্রশিক্ষিত, দক্ষ ও উদ্ভাবনীÿ ক্ষমতাসম্পন্ন শিক্ষক প্রয়োজন। ভাষাশিক্ষায়, বিশেষ করে মাতৃভাষা বাংলা শিক্ষাদানে আমাদের ব্যর্থতা সীমাহীন। ভাষাশিক্ষাদানে বহুকাল ধরে প্রচলিত ব্যবস্থাকে ছাঁটাই করে আমরা মূলত ভাষাশিক্ষার শিকড়টাই উপড়ে ফেলেছি; বিকল্পে উন্নত কোনো ব্যবস্থার উদ্ভাবন ঘটাতে পারিনি। মাতৃভাষার সঙ্গে বিদেশি ভাষা হিসেবে ইংরেজি এবং ধর্মীয় ভাষা আরবি, সংস্কৃত, পালি ভাষাশিক্ষার অবস্থা চরম হতাশাজনক।

 

গাণিতিক শিক্ষার দুর্বলতা সীমাহীন। শিশুকে প্রতিনিয়ত এই ধারণাই দেওয়া হয় যে গণিত অত্যন্ত কঠিন একটি বিষয়। গণিতভীতি গণিতশিক্ষার প্রধান অন্তরায়। আনন্দের মধ্য দিয়েই ভাষা ও গণিতশিক্ষাদান নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু আমরা আমাদের শিক্ষকদের সেভাবে প্রশিক্ষিত করে তুলতে পারিনি। আর সামাজিক, নৈতিক ও প্রকৃতি বিষয়ে আমাদের বইপুস্তক যেমন অপ্রতুল ও নিম্নমানের, তেমনি শিক্ষাদানে ব্যর্থতা জাতির বৃহদাংশকে অদক্ষ, অকর্মণ্য, মানবতাবোধহীন, আত্মপরায়ণ ও দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলছে।

 

সর্বোপরি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ ও ব্যবস্থাপনায় চরম দলীয়করণ ও দুর্নীতি শিক্ষার মূলোৎপাটনে শেষ কোপ বসিয়ে দিয়েছে। অব্যাহত বিতর্কের মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এসব সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে।

 

আমিরুল আলম খান : শিক্ষাবিদ।

Amirulkhan7@gmail.com





Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*