বিষয় : শুধুমাত্র জি.পি.এ’র ভিত্তিতে অনার্স ১ম বর্ষের ভর্তি না নেওয়া প্রসঙ্গে।
জনাব,
যথাবিহীত সম্মান পূর্বক বিণীত নিবেদন এই যে, আমরা ২০১৫-১৬ সেশনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী। আমাদের মত দেশের অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের অন্যতম প্রধান বিদ্যাপিঠ হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। সম্প্রতী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক গৃহীত বেশকিছু সিদ্ধান্ত সমাজের সর্বস্তরে প্রশংসিত হয়েছে। আপনাদের বিবিধ সাহসী পদক্ষেপ ও যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে আজ আমরা সহ অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী নতুন করে উচ্চশিক্ষা লাভের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে এবং সমাজের সকল স্তরেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে একটি ইতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে সময় মতো পরীক্ষা গ্রহণ ও ফলাফল প্রদানের ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধিত হয়েছে এবং সেশন জট কমানোর কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও সাদরে সকল সহলে সমাদৃত হচ্ছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালেয়র এতগুলো ভালো পদক্ষেপ গ্রহণের মাঝে একটি সিদ্ধান্ত যথেষ্টই বিতর্কের সৃস্টি করেছে। সেটি হচ্ছে ২০১৫-১৬ সেশন থেকে কোনরূপ ভর্তি পরীক্ষা না নিয়ে শুধুমাত্র এসএসসি ও এইচএসসি এর জি.পি.এ’র ভিত্তিতে অনার্স ১ম বর্ষে ভর্তি নেওয়া হবে। এই ঘোষণাটি শোনার পর অন্যান্য ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের মত আমরাও আশাহত হয়েছি। আমরা মনে করি শুধুমাত্র জি.পি.এ’র ভিত্তিতে ভর্তি করলে মেধার সঠিক মূল্যায়ন কখোনই সম্ভবপর হবে না। কারণ আমরা যারা গ্রামের বা মফস্বলের ছাত্রছাত্রী তারা নানাবিধ সীমাবদ্ধতা ও সুযোগ-সুবিধার অভাবে শহরের ছাত্র ছাত্রীদের তুলনায় অনেকাংশেই পিছিয়ে পড়ি। এর মধ্যে অন্যতম কারণ ভালোমানের কলেজ ও শিক্ষকের অভাব এবং অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা।
পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পেরেছি যে মেডিকেল কলেজ ও ইন্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জিপিএ’র মাধ্যমে ভর্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেও বাস্ববসম্মত নয় বলে সেই পথ থেকে সরে এসেছে। এসম্পর্কে সুধীজনদের মতামত হচ্ছে শুধুমাত্র জিপিএ’র মাধ্যমে ভর্তি করলে মেধার চরম অবমূল্যায়ন ঘটবে এবং আমাদের দেশে প্রচলিত বহুকেন্দ্রীক শিক্ষা ব্যবস্থায় এই পদ্ধতি মোটেই বাস্তব সম্মত নয়।
আপনার সদয় অবগতির জন্য নিচে মেধা অবমূল্যায়নকারী শুধুমাত্র জিপিএ’র মাধমে ভর্তির সীমাবদ্ধতাসমূহ আংশিক তুলে ধরা হলো।
বিশেষজ্ঞগণের মতামত:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকী মানবজমিনকে বলেন, এটি জাতীয়বিশ্ববিদ্যালয়ের একান্ত সিদ্ধান্ত। তারা কেন করেছেন তারাই বলতে পারবেন। তবে এ পদ্ধতি চালু হলে অনেক মেধাবীবাদ পড়ে যাবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, এপদ্ধতি চালু করার সময় এখনও আসেনি। কারণ বর্তমান জিপিএ–৫ যদি বিতর্কিত না হতো, তাহলে ঠিক ছিল। কারণএখনও এ পদ্ধতি নিয়ে একটা বিতর্ক রয়ে গেছে। যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা সৃজনশীল, মননশীল পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরাপরীক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করতে না পারবো, যতক্ষণ পর্যন্ত এ পদ্ধতি নিয়ে একটি সমালোচনা থেকেই যাবে। তিনি বলেন,জিপিএ-৫ পাওয়া একজন শিক্ষার্থীকে যে মেধা আমাদের দেয়ার কথা, সেটি দিতে পারছি না। এর কারণ দক্ষ শিক্ষকের অভাব। এপদ্ধতিতে ৭০ ভাগ মেধা মূল্যায়ন হয়তো হতে পারে। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হঠাৎ করে এ সিদ্ধান্তের ফলে অনেক শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্তহতে পারে। এটি সময় ও মতামতের ভিত্তিতে করলে ভাল হতো। তিনি বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিতে নানা ধরনের অনিয়মহয়, ছাত্রনেতাদের প্রভাব ইত্যাদি কারণে মেধা মূল্যায়ন হয় না, সেটি কিন্তু নয়। তবে এ সংখ্যা খুবই কম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ এ প্রসঙ্গে বলেন, সবচেয়ে বড় এ বিশ্ববিদ্যালয়েরমেধা মূল্যায়ন হবে, এটি স্বাভাবিক। কিন্তু সেটি কোন প্রক্রিয়ায় হবে সেটি নির্ধারণ করবে তারা। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষাছাড়াই মেধা মূল্যায়ন করার সময় কি এখনই এসেছে– প্রশ্ন রাখেন তিনি।
শুধুমাত্র জিপিএ ৫.০০ পাওয়াদের এ কি হাল?
গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি পরীক্ষায় মাত্র ২জন শিক্ষার্থী ভর্তির যোগ্য বিবেচিত হয়েছিলেন। আর এসএসসিও এইচএসসি উভয় পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া ৭০ ভাগ শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষার পাস নম্বরই তুলতে পারেননি। ভর্তি পরীক্ষায় অংশনেয়া এসএসসি ও এইচএসসি উভয় পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে এ রকম শিক্ষার্থী ছিল ৮৪ হাজার ৫৫৩ জন। এদের মধ্যে ৩০.১৪ জনশিক্ষার্থী পাস নম্বর তুলতে সমর্থ হন। ৭০ ভাগ শিক্ষার্থী পাস করতে পারেনি। এর আগে ২০১৩ সালে ৫৬%, ২০১২ সালে ৫৫%এবং ২০১১ সালে ৫৩% ভাগ শিক্ষার্থী, যারা উভয় পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছিল তারা পাস নম্বর তুলতে পারেনি ঢাবি ভর্তিপরীক্ষায়। গত বছর ভর্তি পরীক্ষায় ‘ক’ ইউনিটে ২১.৫০, ‘খ’ ইউনিটে ৯.৫৫, ‘গ’ ইউনিটে ২০.৬১ এবং ‘ঘ’ ইউনিটে ১১.৪০শতাংশ শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছে, যা নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়তে হয় শিক্ষামন্ত্রীকে।
এদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট নিরসন করতে গিয়ে কর্তৃপক্ষ একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেশিক্ষার্থীরা। সর্বশেষ অনার্স চতুর্থ বর্ষ পরীক্ষার রুটিন প্রকাশ করতে গিয়ে হ-য-ব-র-ল অবস্থা তৈরি করে।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১লা অক্টোবর থেকে ভর্তি কার্যক্রম শুরু করলে অধিকাংশ পাবলিকবিশ্ববিদ্যালয়েরই ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন হবে না। এমতাবস্থায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃষ্টি হবে নতুন সংকট। কারণ পাবলিকবিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কার্যক্রম শেষ না হওয়ার ফলে প্রাথমিকভাবে সকলেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে বাধ্য হবে কিন্তু পাবলিকবিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফল ঘোষণার পর দেখা যাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি বাতিলের মিছিল।
উপর্যুক্ত দৈনিকটি ছাড়াও অন্যান্য বহুল প্রচারিত দৈনিকসমূহ যেমন: প্রথম আলো, সমকাল, যুগান্তর, বাংলাদেশ প্রতিদিন ও নয়া দিগন্তসহ সকল অনলাইন পত্রিকায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রণীত বিতর্কিত ভর্তি পদ্ধতির বিরুদ্ধে অসংখ্য যুক্তিনির্ভর নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে যা আশাকরি সকলেরই দৃষ্টিগোচর হয়েছে।
মেধার অবমূল্যান করে শুধুমাত্র জিপিএ’র মাধ্যমে ভর্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সীমাবদ্ধতা থেকে যাবে। এসকল সমস্যাগুলি আপনার অবগতির জন্য নিচে উল্লেখ করা হলো।
১. জিপিএ’র মাধ্যমে ভর্তির ক্ষেত্রে সবথেকে বড় সমস্যা হচ্ছে এখানে কোন ছাত্র-ছাত্রী একাডেমিক রেজাল্টের বাইরে তার সৃজনশীলতা প্রকাশের কোন ধরণের সুযোগ পাবে না।
২. আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা হচ্ছে বহুমূখী অর্থাৎ সাধারণ, মাদ্রাসা, কারিগরি, উন্মুক্ত ও ইংরেজি মাধ্যম। তাই এই শিক্ষা ব্যবস্থায় কখনোই জিপিএ’র সমন্বয়সাধন সমানভাবে করা সম্ভব নয়। কারন এখানে মাদ্রাসা, কারিগরি ও উন্মুক্ত শিক্ষার মান নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
৩. অধিকাংশ সময়ই লক্ষ করা যায় যে শুধু জিপিএ ৫.০০ দিয়েই মেধার মূল্যায়ন সঠিক হয় না। উদাহরণসরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাগুলোতে জিপিএ ৫.০০ না থাকা সত্বেও মেধা থাকার কারনেই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
৪. জিপিএ’র মাধ্যমে ভর্তি করলে মেধাশূন্য একটি জাতি তৈরি হবে। প্রকৃতপক্ষে জিপিএ’র মাধ্যমে ভর্তি নেওয়া মেধা যাচাইয়ের কোন মাপকাঠি হতে পারে না, তাহলে উন্নত বিশ্বেও ভর্তি পরীক্ষার দরকার হতো না।
৫. এসএসসি ও এইচএসসির রেজাল্ট যদি মেধা মূল্যায়নের চূড়ান্ত মাপকাঠি হয়ে থাকে তাহলে এই দুটি সার্টিফিকেটের কল্যাণে অনার্স ও মাস্টার্সের রেজাল্ট দিয়ে দিন এবং পরবর্তীতে এর ভিত্তিতেই বিসিএস ক্যাডার নিয়োগ দিয়ে দিন।
৬. সর্বোপরি আমাদের দেশের পাবলিক পরীক্ষাগুলো এখনো শতভাগ সচ্ছভাবে সম্পন্ন হচ্ছে তা বলা যাবে না। সুতরাং এখানেও অনেক প্রশ্ন দেখা দিতে পারে।
আসলে শুধুমাত্র জিপিএ’র মাধ্যমে ভর্তির ক্ষেত্রে উপরে আলোচিত সীমাবদ্ধতাসমূহ একটি বড় অন্তরায়। তাই বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে মেধা ধ্বংসের এই হঠকারী সিদ্ধান্ত থেকে দ্রুত সরে আসতে হবে। নাহলে জাতিকে মেধাহীন করার অপরাধে একদিন তাদের জনগণের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। মেধাহীন জাতি কখনও উন্নত দেশ গড়তে পারে না। আমরা সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা ও দেশের সচেতন নাগরিকগণ মনে করি যে, নিজেদের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতাকে ধরে রাখার জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেশন জট দূর করার নামে বিভিন্নভাবে উচ্চশিক্ষা ধ্বংসকারী সিদ্ধান্ত প্রণয়ন করে চলেছে। যেটি জাতিকে মেধাশূন্য করার গোপন চক্রান্ত বলেই মনে হচ্ছে।
তাই আপনার মাধ্যমে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিকট আমাদের আকূল আবেদন সাধারণ মানুষকেউচ্চশিক্ষা গ্রহণের শেষ আশ্রয়স্থল থেকে বঞ্চিত করবেন না। তাই অবিলম্বে শুধুমাত্র জিপিএ’র মাধ্যমে অনার্স প্রথম বর্ষের ভর্তির সিদ্ধান্ত বাতিল করে পূর্বের ন্যায় জিপিএ এবং ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করুন যাতে সাধারণ তথা গ্রাম এবং মফস্বলের ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্চশিক্ষা লাভের শেষ সপ্নটুকুও বেঁচে থাকে। শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীকে দেখানোর জন্য এবং নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য এধরনের আইওয়াশ করবেন না।
অতএব জনাবের নিকট আকূল আবেদন এই যে, উপরের উল্লিখিত বিশ্লেষণধর্মী নিবন্ধ এবং শুধুমাত্র জিপিএ’র মাধ্যমে ভর্তির ক্ষেত্রে যেসকল সীমাবদ্ধতা আছে সেগুলো মূল্যায়নপূর্বক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে আপনার একান্ত মর্জি হয়।
ধন্যবাদন্ত
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু ছাত্র-ছাত্রী।
Leave a Reply