‘ঈদ’ মানে খুশি, আনন্দ, উৎসব, ফিরে আসা ইত্যাদি। ঈদের আগমনে স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে শৈশবকালের কথা। এখনো ছোটদের মধ্যে ঈদ আসার আগে থেকেই চলতে থাকে বহু প্রস্তুতি। আর মনে মনে তারা ভাবতে থাকে ঈদের দিন কোন পোশাক পরিধান করবে। পোশাকের সঙ্গে ম্যাচিং করে থাকতে হবে সবকিছু। ঈদের দুই তিন দিন আগ থেকেই রাতে তাদের চোখে ঘুম থাকে না। তাদের মা’র বকাঝকা খেয়ে শেষ রাতে একটু ঘুমাবে। কিছুক্ষণ পরেই ঘুম থেকে উঠে বলবে আম্মু ঈদ এসেছে? এই যে শিশুদের এমন আনন্দ—খুশি, মনের আবেগ সত্যিই বড় মজাদার। কিন্তু বালেগ হওয়ার পর থেকে অর্থাৎ ব্যক্তি যৌবনকালে পদার্পণ করার সঙ্গে সঙ্গে তার ওপর শরিয়তের বিধিবিধান আরোপিত হয়ে যায়, অঘোষিতভাবে ইসলাম তাকে বলতে থাকে এখন থেকে লাগামহীন জীবনের লাগাম টেনে ধর। ইসলামী নীতিমালার ভিত্তিতে মনের আবেগ, আনন্দ, উল্লাস প্রকাশ কর।
ইসলামে ঈদ একটি সুউচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পরিপূর্ণ প্রতীক। যা দেহ ও মনের প্রয়োজন মিটিয়ে দেয়। মাহে রমজান ও হজের মাসসমূহের ইবাদত বন্দেগির বাহক হিসাবে ঈদের আগমন ঘটে। ঐ মাসসমুহের সকল ইবাদতই রূহের খোরাক যোগায়। ইরশাদ হচ্ছে : আপনি বলুন, আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর রহমত, সেটার উপর তাদের আনন্দ প্রকাশ করা উচিত। (সূরা ইউনুস : ৫৮)
ঈদের প্রকৃত অর্থঃ শুধু দামী পোশাক, রঙ্গিন জামা, হরেক রকম সুস্বাদু খাবার আর নানা ধরণের আনন্দ—উৎসবের নাম ঈদ নয়। আর ধনী গরিবের এক কাতারে নামাজই শুধু নয় তাদের মধ্যে বৈষম্য কমিয়ে আনাও ঈদের উদ্দেশ্য৷ ঈদের উদ্দেশ্য কি তা আল্লাহ তায়ালা সূরা বাকারার ১৮৫ নং আয়াতের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন: ”আর যেন তোমরা নির্ধারিত সংখ্যা পূরণ করতে পার এবং তোমাদেরকে যে সুপথ দেখিয়েছেন, তার জন্যে তোমরা আল্লাহর মহিমা বর্ণনা করবে এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হও।” এই আয়াত থেকে প্রমাণিত হচ্ছে, ঈদের উদ্দেশ্য হল দুটি:
ক. আল্লাহর বড়ত্ব, মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা। এবং
খ. আল্লাহ তায়ালা যে নেয়ামত দান করেছেন, তার জন্য আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করা।
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ্ববাসীকে এমন এক দ্বীনের প্রতি আহবান করেছেন, যেখানে রয়েছে আধ্যাত্মিকতার সাথে বৈষয়িতার সমন্বয়, দ্বীনের সাথে দুনিয়া, সামাজিক শৃংখলার সাথে আছে ব্যক্তি মানুষের অধিকার ও মর্যাদার মূল্যায়ন। রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কার, সামাজিক নেতৃত্ব তৈরি, পারিবারিক জীবনের প্রতি পূর্ণ দায়িত্ব পালনের জন্য বিরামহীন ছুটে চলা তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে। শাশ্বত সত্যের সুষমায় মহিমান্বিত এ মহান মানুষ তাঁর শয়নকক্ষে, ইবাদতগৃহে, সামষ্টিক কর্মকান্ডে, যুদ্ধে—সন্ধিতে, বিনোদন—বিষাদে, বেশভূষা—পানাহারে, বক্তব্য—বিবৃতিতে, উৎসব—অনুষ্ঠানে একজন মধ্যমপন্থি, আল্লাহ প্রেমিক সর্বাধুনিক মানবচরিত্রের অনুপম নমুনা। জাহেলী সমাজের বাতিল আনন্দ—উৎসব পরিহার করে ইসলামী আদের্শর ভিত্তিতে তিনি দুইটি ঈদ প্রবর্তন করেছেন। এ সম্পর্কে প্রখ্যাত সাহাবী আনাস বিন মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় আগমন করার পর দেখলেন মদীনাবাসীদের দু’টি উৎসবের দিন রয়েছে, যাতে তারা খেলাধুলা করে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের এই দিন দু’টির ছুটি কেমন? তারা বললো, জাহেলী জীবনে আমরা এই দু’দিন খেল তামাশা করতাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তায়ালা সেই দু’দিনের পরিবর্তে সেগুলো অপেক্ষা উত্তম দু’টি দিন তোমাদের দান করেছেন। তা হলো ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতরের দিন। যে দিনে আল্লাহর শুকরিয়া, তাঁর জিকির, দুরুদ—সালাম, তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সাথে সাথে পরিমিত আমোদ—ফুর্তি, সাজ—সজ্জা, খাওয়া—দাওয়া করা হবে। (সুনানে আবু দাউদ; সুনানে নাসায়ী)
এই ঈদ উৎসব মুসলিম জাতির অপার্থিব আনন্দের উৎসব। এই উৎসব যেমন একদিকে বাহুল্য বিবর্জিত, অপচয়—অশ্লীলতা মুক্ত তেমনি খোদায়ী প্রেমের সিগ্ধতা—পবিত্রতা ও সামাজিক স¤প্রীতি বন্ধনের এক অপূর্ব নিদর্শন। যা আমরা পাই নবী মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবন থেকে। চলুন জানা যাক, কেমন হওয়া উচিৎ ঈদ উৎসব—
১. পরিবারের দেহ ও মন যেভাবে উৎফুল্ল হয় ঈদ মৌসুমে উদারতার সাথে তার আয়োজন করা শরীয়তসম্মত। সম্মানিত ব্যক্তি তার বয়স ও ষ্ট্যাটাজের দরূন যদিও সে নিজে আনন্দ উৎসবে জড়িত হতে পারে না বটে। তার জন্য যা মানানসই সে তাতে যোগ দেবে। কিন্তু পরিবারের যে সব সদস্যের বয়স কম তারা স্বভাবগতভাবেই ঐসব খেল—তামাশার দিকে ধাবিত হয়. তাদের জন্য শরীয়তের সীমার ভিতর থেকে খেলা—ধুলা ও আনন্দ—ফুর্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
২. ঈদ উৎসবে আনন্দ প্রকাশ করা দ্বীনের একটি প্রতীক। এ কারণেই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুটি বালিকাকে গান গাইতে দেখে বারণ করেননি। শুধু তা—ই নয়, যখন হযরত ছিদ্দীকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাদের বাঁধা দিতে চাইলেন, তখন তিনি তাঁকে নিষেধ করলেন। অপর একটি বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, হে আবু বকর! প্রত্যেক জাতির ঈদ আছে, আর এটি আমাদের ঈদের দিন। অন্য একটি বর্ণনায় আছে— ইহুদিরা যেন বুঝতে পারে, আমাদের ধর্মেও আনন্দ উৎসবের সুযোগ আছে। আর নিশ্চয় আমি উদার ও ভারসাম্যপূর্ণ আদর্শ নিয়ে প্রেরিত হয়েছি।
৩. স্ত্রীর প্রতি সদয় আচরণ এবং তাকে ভালোবেসে কাছে টেনে আনার প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। কেননা, নারী জাতিকে নরম হৃদয় দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। তার প্রকৃতিগত স্বভাবের প্রতি কেউ সাড়া দিলে সে সহজেই তার দিকে ঝুকে পড়ে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্ত্রীদের ভালোবেসে কাছে টানার উত্তম দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন। তাঁর ঘর ছিল মুহাব্বত, ভালোবাসা, অনুগ্রহ ও পরস্পর শ্রদ্ধাবোধের উজ্জল নমুনা। হযরত আয়েশা ছিদ্দিকা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) এর বর্ণনা, (আমার চোয়াল নবীর চোয়াল মুবারকের সাথে মিশে গেল) দ্বারা স্ত্রীর প্রতি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কতটুকু আন্তরিকতা ছিল তা প্রকাশ পাচ্ছে, যা ঈদ উপলক্ষে বাস্তবায়িত হয়েছে।
৪. নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুউচ্চ মর্যাদা, তার ব্যক্তিত্ব ও সুমহান দায়িত্ববোধ থাকা সত্ত্বেও তিনি হযরত আয়েশা ছিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর মনে তৃপ্তিদানের জন্য দাঁড়িয়ে থাকার মাঝে পিতা—মাতা, ভাই—বন্ধু ও স্বামীদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। স্বামীগণ স্ত্রীদের আর পিতা—মাতা সন্তানদের মনোবাসনা পূরণ করার ব্যাপারে যদি এগিয়ে না আসে তাহলে স্ত্রী ও সন্তানদের মনে এর একটা বিরূপ প্রভাব পড়ে, যা তাকে মানসিক ও সামাজিক ভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলে।
৫. খেলা—ধুলায় ব্যস্ত হওয়ার সময় অবশ্যই শরীয়তের সীমারেখার ভিতর থাকতে হবে। কোন গুনাহে লিপ্ত হয়ে অথবা আল্লাহর বিধান নষ্ট করে কখনও খেলা—ধুলা করা যাবে না। হযরত আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) এর বক্তব্যে বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন : আমি হাবশিদের খেলা দেখার সময় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে আড়াল করেছিলেন। বর্ণনা থেকে বুঝা গেল যে, মেয়ে দুটো গাইতেছিল তারাও ছিল নাবালেগা। তাই উপযুক্ত প্রাপ্তবয়স্কা মেয়েদের গাওয়ার প্রশ্নই আসে না। তাছাড়া গান গাওয়া তাদের পেশা ছিল না। তারা শুধু কবিতা আবৃতির মাধ্যমে তাদের অনুভূতি প্রকাশ করেছিল যা শরীয়ত বহির্ভূত ছিল না।
ইসলামে ঈদ কোন ব্যক্তি কেন্দ্রীক আনুষ্ঠানিকতার নাম নয়। তাই কিছু মানুষের আনন্দ উৎসবের মাধ্যমে এর হক আদায় হবে না। বরং ঈদ হলো সমগ্র মুসলিম জাতির আনন্দ। শরীয়ত বিষয়টিকে খুব গুরুত্ব দিয়েছে। সবচেয়ে কাছের মানুষ পিতা—মাতা থেকে শুরু করে বন্ধু—বান্ধব, আত্মীয়—স্বজন সকলে মিলে আনন্দ উপভোগ করবে। এটাই শরীয়তের দাবি। ঈদুল ফিতরের দিন সকাল বেলা সকল মুসলমানের জন্য খাবার ব্যবস্থা নিশ্চিত করার মাধ্যমে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিষয়টি আরো পরিস্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন।
Leave a Reply