ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান
হায় প্রভু, তুমি আমাদের কতই না অসহায় করে সৃষ্টি করেছ এই বাংলার জমিনে! আর কত মানুষের আহাজারি শুনবো, এক ঘটনার আহাজারি না থামতেই অন্য আরেকটি ঘটনায় স্বজন হারানো মানুষের আহাজারি ভেসে আসছে। লঞ্চ ডুবে, ভয়াবহ আগুনে, সড়কপথে, ফ্লাইওভার ভেঙে, অবরোধ-হরতালে পেট্রলমোয়, র্যাব, বিজিবি-পুলিশের গুলিতে-বন্দুকযুদ্ধে, ভবন ধসে মানুষ মরছে আর মরছে। বাংলার জমিনে শুধু সারি সারি লাশ আর লাশ। লাশের গন্ধ আর স্বজনদের আহাজারিতে আজ বাঙালী বনী আদমের চোখ ভিজে রক্তজবা। এভাবে মৃত্যুর মাতম আর স্বজন হারানো মানুষের আহাজারির মিছিল ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। কোনো ভাবেই যেন থামনো যাচ্ছে না।
সর্বশেষ গেল শুক্রবার(২৭ মার্চ)এই মৃত্যুর মিছিলে যোগ হলেন নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দে অষ্টমী পুণ্যস্নান উৎসবে অংশ নিতে আসা সনাতন ধর্মাবলম্বী ১০ পুণ্যার্থী।তাদের স্বজনদের আকাশ বিদারী আর্ত কান্না যেন কোনো মতেই থামছে না।এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা, মানুষের কান্না আর কত দেখতে হবে আমাদের!
শুক্রবারের ঘটনায় আমরা কী দেখলাম- যথারীতি ঘটনার পরপরই আমাদের সমাজের হর্তাকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দু:খ প্রকাশ করলেন। বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করে বক্তব্য দিলেন।
নারায়নগঞ্জের জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান মিঞা বললেন, শুক্রবার ও শনিবার ছুটির দিন থাকায় এবার প্রচুর পুণ্যার্থীর আগমন হয়েছে। বেইলি ব্রিজের আগের রাস্তাগুলো খুব প্রশস্ত কিন্তু ব্রিজে এসে রাস্তাটি হঠাৎ সরু হয়ে যাওয়ায় সেখানে পুণ্যার্থীদের প্রচণ্ড ভিড় হওয়ায় এই দুর্ঘটনা ঘটে। তিনি দ্রুত বেইলি ব্রিজ এবং এর আশেপাশের সড়কগুলো আরও প্রশস্ত করার কথা জানালেন।
এলাকার সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান বিষয়টি অত্যন্ত মর্মান্তিক আখ্যায়িত করে নিহতদের স্বজনদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে ২৫ হাজার টাকা করে দিলেন। তিনি এ ঘটনার জন্য লাঙ্গলবন্দের অবৈধ দখলদারদের দায়ী করলেন। তিনি সাংবাদিকদের মাধ্যমে অবৈধ দখলদাদের জায়গাগুলো ছেড়ে দেয়ার আহবান জানালেন।
অন্যান্য মৃত্যুর ন্যায় যথারীতি আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীও এই ঘটনাকে মর্মান্তিক উল্লেখ করে নিহতদের আত্মার শান্তি ও স্বজনদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেছেন।এছাড়াও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন অন্যান্য ব্যক্তিরাও বিবৃতিতে একই ধরনের শোক প্রকাশ করেছেন। এরই মধ্যে ঘটনার কারণ তদন্তে গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি। ঘটনার পরপরই সেখানে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে প্রশাসন। দেশীয় আর্ন্তজাতিক মিডিয়ায় বিশাল কাভারেজ পেয়েছে ১০ পুণ্যার্থীর মৃতদেহ, স্বজনদের আহাজারি আর ঘটনারস্থল নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দ। কী চমৎকার! মৃত্যুর মিছিলে বাঙালী বনী আদমের এ জীবন কতই না সুন্দর!
তবে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী লাঙ্গলবন্দে অষ্টমী পুণ্যস্নান উৎসবে অংশ নেয়া মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া আমার এক নিকট প্রতিবেশী সনাতন ধর্মাবলম্বী সোমা সরকারের কাছ থেকে (ফোনে) যা জানতে পেলাম তাতে, পুণ্যার্থীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা রাজঘাটের কাছের বেইলি ব্রিজ ভেঙে পড়ার গুজবেই ঘাটমুখী রাস্তায় লাখো মানুষের হুড়োহুড়ি থেকেই এই মৃত্যু আর অসংখ্য মানুষ আহত হবার ঘটনা ঘটেছে। মৃত্যু থেকে বেঁচে যাওয়া আহত সোমা সে সময়কার ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।তার সাথে পরিবারের অন্য ৩জন সদস্যও আহত হন। এভাবে সেখানে হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। সোমা সরকারের মতে, গুজব মূল কারণ হলেও আয়োজন কমিটির অব্যবস্থাপনাও কম দায়ী নয়। কেননা, চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টম তিথিতে ভোররাত ৫টা ২৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডে লাঙ্গলবন্দে ব্রহ্মপুত্র নদে পুণ্যস্নানের সূচনা হলেও ঘটনার আগ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আয়োজক ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের তেমন কোনো তদারকি দেখা যায়নি।
তার ভাষ্যমতে, প্রতিবছর এখানে প্রতিবছর দেশ-বিদেশের ১০ থেকে ১৫ লাখ পুণ্যার্থীর আগমন ঘটে। স্নানের জন্য লাঙ্গলবন্দের তিন কিলোমিটার এলাকায় প্রস্তুত করা হয় বেশ কয়েকটি ঘাট। কিন্তু এবার লোকের সমাগম বেশী হলেও ব্যবস্থাপনা সেভাবে করা হয়নি। এছাড়া পুণ্যস্নানে এসে পদদলিত হয়ে ১০ জনের মৃত্যুর জন্য ব্রহ্মপুত্র ঘাটে যাতায়াতের রাস্তা ও ব্রিজ সরু এবং আয়োজক কমিটি ও প্রশাসনের অবহেলাকে দায়ী করেছেন স্বজনরা। ওই এলাকার প্রত্যক্ষদর্শীদেরও একই অভিযোগ।মিডিয়ার তথ্যেও একই ধরনের চিত্র উঠে এসেছে।
তবে আমাদের রাষ্ট্রের হর্তাকর্তারা হয়তো এ ঘটনাকে অন্যান্য দুর্ঘটনার মতো সেইফ দুর্ঘটনা হিসেবেই আখ্যায়িত করছেন কিংবা করবেন, হয়তো দায় এড়াতে যুক্তি দাঁড় করাবেন ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে এ ধরনের পদদলিত হবার দুর্ঘটনা।হয়তো তথ্য উপস্থাপন করবেন- ২০১০ সালের ২৩ নভেম্বরের সেই কম্বোডিয়ার বর্ষবরণে পদদলিত হয়ে ৩৪৯ জনের মৃত্যু, ২০১৪ সালের ৪ অক্টোবরের ভারতের পাটনায় দুসেরা (রাবন দহন বা রাবন বধ) উৎসবে পদদলিত হয়ে ৩২ জনের মৃত্যু, ২০০৪ সালে বেইজিংয়ের উত্তর অংশে চীনা চন্দ্রবর্ষ বরণের উৎসবের মধ্যে একটি সেতুতে পদদলিত হয়ে ৩৭ জনের মৃত্যু, চীনে সাংহাইয়ের হুয়াংপু নদীর পাশে বুন্ড এলাকার চেন ই চত্বরে গেল থার্টি ফাস্ট নাইট তথা ২০১৫ সালের বর্ষবরণে ৩৫ জনের মৃত্যু, ২০১৪ সালের ৬ জানুয়ারি চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় গুয়ুয়ানের ঝিজি শহরের একটি মসজিদে পদদলিত হয়ে ১৪ মুসল্লির মৃত্যু, ২০১৩ সালের ১৩ অক্টোবর ভারতের মধ্য প্রদেশে রতনগড় মন্দিরে পদদলিত হয়ে ৩০ শিশুসহ অন্তত ১১৫ জন পূণ্যার্থীর মৃত্যু, ২০০৬ সালে একই মন্দিরে একই রকম দুর্ঘটনায় ৫০ পূণ্যার্থীর মৃত্যু, ২০১৪ সালের ২৫ আগস্ট ভারতের মধ্যপ্রদেশের সাতনা জেলার চিত্রকুটের কামতানাথ মন্দিরে হুড়োহুড়ির সময় পদদলিত হয়ে ১০ জন তীর্থযাত্রীর মৃত্যু, ২০১৩ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি ভক্তরা কুম্ভ মেলা উৎসব থেকে বাড়ি ফেরার পথে পদদলিত হয়ে ২২ ব্যক্তির মৃত্যু। এমন আরো হাজারো ঘটনার উদাহরণ উপস্থাপন করতে পারবেন। নারায়নগঞ্জের এই ঘটনাকে সেইফ দুর্ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করে আজকে হয়তো আমাদের রাষ্ট্র ও সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দায় এড়ানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু বরাবরই একই ধরনের ভাষ্য ও ভুমিকা কোনো যুক্তি হতে পারে না। এসব মৃত্যুর ঘটনা এড়াতে রাষ্ট্রের অনেক করণীয় রয়েছে।
আমাদের সবার জানা, ইতোপূর্বে নিকট অতীতে দেশ-বিদেশে যতগুলো পদদলিত হয়ে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে সেগুলো মুলত: অধিক লোকের সমাগম আর গুজবের কারণেই ঘটেছিল। ফলে ওই সব ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে সহজেই এড়ানো সম্ভব ছিল নারায়নগঞ্জের এই ঘটনা। এক্ষেত্রে প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা কমিটি সচেতন থাকলে হয়তো অকালে ঝরে পড়তো না এই দশটি প্রাণ।কিন্তু তা হয়নি। ফলে এর দায় কার, রাষ্ট্রের না পুণ্যার্থীদের?
আমরা জানি, অন্যান্য ঘটনার মতো এ ঘটনারও তদন্ত হবে, হোটেল সোনার গাঁ কিংবা শেরাটন বা অন্য কোন তারকা খচিত হোটেলে এ নিয়ে আলোচনা হবে,
ঘটনার কারন নির্ণয় ও পরবর্তী করনীয় নির্ণয় হবে, তদন্তে সব বেরিয় আসবে। কিন্তু বন্ধ হবে কি অসহায় মানুষের মৃত্যুর এই মিছিল? জানি, এ মৃত্যুর মিছিল শেষ হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না দায়িত্বে অবহেলায় জড়িত মানুষগুলোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে।
প্রসঙ্গত, ২০১১ সালে আমাদের দেশের দুই কৃতী সন্তান মিশুক মুনীর ও তারেক মাসুদ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর দেশজুড়ে অনেক হইচই হয়েছে। রাষ্ট্রের হর্তাকর্তারাও অনেক পদক্ষেপের আশ্বাসের কথা শুনিয়েছিলেন। কিন্তু এরপরও কি সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যুর সংখ্যার তেমন তারতম্য হয়েছে? চলচ্চিত্র নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন অনেক দিন ধরে। তিনি ব্যক্তিগত জীবনের ট্র্যাজেডি থেকেই হয়তো এই আন্দোলনে নামার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছেন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকার রাস্তায় ঝাড়ুমিছিল করেছে পরিবহনশ্রমিকদের একটি সংগঠন। নৌমন্ত্রীর মতো একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি যদি বলতে পারেন, গরু-ছাগল চিনলেই ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া যায়, তাহলে এই পরিবহন শ্রমিকদেরই বা আর দোষ কী!এভাবে অন্যায়কে জায়েজ করা হলে তার প্রতিকারের সম্ভাবনা কতটুকু তা সহজেই অনুমেয়।
সবশেষে বলবো, এটা আমাদের রাষ্ট্রের হর্তাকর্তারা স্বীকার করুন আর নাই বা করুন, কোনো মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যুর দায় রাষ্ট্র কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। কেননা, এ ধরনের অঘটন কিংবা দুর্ঘটনা ঘটে থাকে মূলত: রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলার কারণেই। ধরা যাক, দীর্ঘ দিন থেকে চলে আসা নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দে অষ্টমী পুণ্যস্নান উৎসবে যদি আগে থেকেই প্রশাসন ও আয়োজক কমিটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতেন, তাহলে হয়তো এই ১০ পুণ্যার্থীর অকালে প্রাণ ঝরে পড়তো না এবং আমাদেরকেও নিহতদের স্বজনদের এমন হৃদয়বিদারক কান্না শুনতে হতো না। তাই সরকারের প্রতি আহবান রাখবো, নিহতদের স্বজনদের শুধু ২৫ হাজার টাকায় সমবেদনা কিংবা তদন্ত কমিটির শান্তনা নয়, এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে চাই কার্যকর পদক্ষেপ। সেই সাথে দায়িত্বে অবহেলায় জড়িত রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। আজ নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দে অষ্টমী পুণ্যস্নান উৎসবে পদদলিত হয়ে নিহত ১০ পুণ্যার্থীর স্বজনদের বিদায়ক আর্ত কান্না থামানোর মতো শান্তনার ভাষা আমার জানা নেই। এরপরও নিহতদের স্বজন ও আহতদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করছি।
লেখক: শিক্ষা ও সমাজ বিষয়ক গবেষক। ই-মেইল: sarderanis@gmail.com
Leave a Reply