রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস মাহে রমাজান। মহান আল্লাহ পাক অপার করুণায় সয়লাব এ পবিত্র মাস, অধিকহারে বান্দার পাপরাশির মোচন হয়; বান্দা পায় মুক্তি ও পরিত্রাণের কাঙ্খিত সফলতা।
রমাজান মাসের রোজা মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের অন্যতম মাধ্যম। মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন-” হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমন করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যাতে তোমরা মুত্তাকী অর্জন করতে পারো।”
রোজা ইসলামের ৫ টি মূলভিত্তির একটি। কেউ রমাজান মাসের রোজাকে ফরয হিসেবে অস্বীকার করলে কিংবা রোজার প্রতি উপহাস বা বিদ্রুপ প্রকাশ করলে সে ঈমানহারা কাফির হয়ে যাবে। আর যে শয়তানের ধোঁকায় পড়ে রোজা পালন করবে না, সে ফাসিক বা মস্তবড় গুনাহগার সাব্যস্ত হবে।
তাই সকল মুসলমানদের উচিত, মাহে রমজানের সবগুলো রোজা যথাযথভাবে পালন করা। রোযার আহকামগুলো সঠিকভাবে আদায় করা।
রোযার নিয়তঃ
রোযার নিয়ত করা ফরয। অন্তরে সংকল্প বা ইচ্ছা-ইরাদাই নিয়ত। আর মুখে নিয়তের কথা উচ্চারণ করা ফরয নয়, বরং উত্তম বা মুস্তাহাব।
আরবি উচ্চারণঃ
নাওয়াইতু বি-সাওমি গাদিম মিন শাহরি রামাজান।
বাংলায় নিয়তঃ
আমি আগামীকাল রমাজানের রোজা রাখার নিয়ত করলাম। অথবা দিনে অবশ্যই ১১ টার পূর্বে এ নিয়ত করবে যে, “আজ আমি রোজা রাখলাম”।
রোজার সুন্নাতসমূহঃ
১. শেষ রাতে সাহরী খাওয়া। এ সর্ম্পকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-“তোমরা সাহরী খাও। কেননা, সাহরীর ভিতরে বরকত রয়েছে।” (মিশকাত শরীফ)
২. শেষ রাতে বিলম্বে সাহরী খাওয়া সুন্নাত। তবে এমন দেরি করবে না যাতে সুবহে সাদিক প্রকাশ পাওয়ার আশংকা হয়।
৩. সূর্য অস্ত যাওয়া মাত্রই তাড়াতাড়ি ইফতার করা।
৪. কোন খেজুর কিংবা ফলমূল দ্বারা ইফতার করা সুন্নাত।
৫. “বিসমিল্লাহি ওয়া’আলা বারাকাতিল্লাহ” বলে ইফতার করা।
ইফতারের দুআঃ
হে আল্লাহ তায়ালা আমি আপনার নির্দেশিত মাহে রমাজানের ফরয রোজা শেষে আপনারই নির্দেশিত আইন মেনেই রোজার পরিসমাপ্তি করছি ও রহমতের আশা নিয়ে ইফতার আরম্ভ করিতেছি। তারপর
“বিসমিল্লাহি ওয়া’আলা বারাকাতিল্লাহ” বলে ইফতার করা। যারা আরবিতে ইফতারের দুআ জানেন তারা আরবিতে দুআ করিতে পারিবেন। তবে উচ্চারণ সঠিক হওয়া চাই।
রোজা ভঙ্গ হবার কারণসমূহঃ
১. রোজা রেখে সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত হবার পূর্ব সময়ে ইচ্ছাপূর্বক পানাহার অথবা স্ত্রীর সহিত সহবাস করলে রোজা ভেঙ্গে যাবে। এ অবস্থায় রোজার কাযা এবং কাফফারা উভয়ই আদায় ওয়াজিব হবে। কাযা হচ্ছে- ভেঙ্গে ফেলা রোজার পরিবর্তে আরো একটা রোজা রাখা এবং কাফফারা হচ্ছে- একাধারে বিরতিহীনভাবে ৬০ টি রোজা রাখা।
২. স্বেচ্ছায় মুখ ভরে বমি করলে।
৩. ইচ্ছাকৃতভাবে বীর্যস্থলন করলে। হস্তমৈথুন কিংবা কাউকে চুম্বন বা উত্তেজনাসহ স্পর্শের জন্য বীর্য পাত হলে রোজা ভেঙ্গে যাবে।
৪. মাসিক স্রাব এবং প্রসবোত্তর স্রাব শুরু হলে রোজা ভেঙ্গে যাবে। এ অবস্থায় রোজা ও নামাজ ছেড়ে দিতে হবে এবং সুস্থ হলে রোজা ও নামাজের কাযা আদায় করতে হবে। এক্ষেত্রে রোজার কাযা আদায় করলেই চলবে কোন কাফফারা দিতে হবে না। লক্ষণীয় যে, যদি কারো দিনের বেলা স্রাব বন্ধ হয়ে যায় সেই দিন সেই সময় থেকেই সন্ধ্যা পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকতে হবে এবং রোজাদারের ন্যায় আচরণ করতে হবে।
৫. রোজা অবস্থায় শরীরে রক্ত পুশ করালে অথবা শক্তিবর্ধক ইনজেকশন কিংবা পানাহারের স্থলাভিষিক্ত কোন ইনজেকশন বা স্যালাইন পুশ করালে রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে।
৬. নাকে বা কানে তৈল বা ওযুধ প্রবেশ করালে রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে।
রোজা মাকরূহ হবার কারণসমূহঃ
১. রোজা অবস্থায় উজুর সময় গড়গড়ার সাথে কুলি করা এবং নাকে পানি টেনে নেয়া মাকরূহ।
২. রোজা অবস্থায় যৌনকামনার সাথে স্ত্রীকে চুম্বন, আলিঙ্গন ইত্যাদি করলে।
৩. রোজা অবস্থায় উত্তেজনাসহ বার বার স্ত্রীর দিকে তাকানো কিংবা সহবাসের চিত্র বার বার মনে করা মাকরূহ।
৪. রোজা অবস্থায় বিনা প্রয়োজনে খাদ্যের স্বাদ গ্রহণ করা।
৫. থুথু-কাশি মুখে জমা করে গলধঃকরণ করা মাকরূহ। তবে জমা না করে থুথু গিলা যাবে।
৫. রোজা অবস্থায় টুথপেস্ট, মাজন দ্বারা দাঁত পরিস্কার করা মাকরূহ। তবে মিসওয়াক করা যাবে। রোজা ভঙ্গ হয় না যে সব কারণেঃ
১. রোজার কথা ভুলে পানাহার করলে।
২. সুগন্ধি ব্যবহার করলে।
৩. নিজ মুখের থুথু-কফ জমা না করে গিলে ফেললে।
৪. শরীর বা মাথায় তৈল ব্যবহার করলে।
৫. দিনের বেলা ঘুমের মধ্যে স্বপ্নদোষ হলে।
৬. মিসওয়াক করলে। মিসওয়াকে রক্ত বের হলে তা গলার ভেতরে না পৌঁছলে কোন ক্ষতি নাই।
৭. অনিচ্ছকৃতভাবে বমি করলে। ইচ্ছাকৃতভাবে অল্প পরিমাণ বমি করলেও রোজা ভাঙ্গবে না।
৮. চোখে সুরমা বা ওষুধ ব্যবহার করলে।
৯. ঠান্ডার জন্য গোসল করলে।
১০. অসুস্থতার জন্য ইনজেকশন নিলে রোজার ক্ষতি হবে না।
যেভাবে কাটাবেন মাহে রমাজান মাসঃ
মাহে রমাজান মাসে সম্পূর্ণ গোনাহমুক্ত থাকা চাই। একটি গোনাহ যেন না হয় আমাদের দ্বারা। খেয়াল রাখতে হবে যে-“এই মুবারক মাসে চোখ যেন ভুল জায়গায় দৃষ্টিপাত না করে, কান যেন ভুল ও অন্যায় জিনিস না শোনে, যবান দিয়ে যেন কোন অশ্লীল ও অশ্রাব্য বাক্য বের না হয়”
সারমর্ম হচ্ছে-
১. চোখ দ্বারা নোংরা ছবি, সিনেমা কিংবা পরনারীর প্রতি দৃষ্টিপাত না করা।
২. কান দ্বারা গান-বাজনা, অশ্লীল কথাবার্তা না শোনা।
৩. মুখ দ্বারা মিথ্যা কথা বলা, গীবত করা, পরনিন্দা করা, চোগলখুরি করা, অশ্লীল কথাবার্তা বলা থেকে বিরত থাকা।
মোটকথা, শরীরের সকল অঙ্গ-প্রতঙ্গকে আল্লাহ তায়ালার যাবতীয় নাফরমানী থেকে পরিপূর্ণভাবে বিরত রাখতে হবে। কেননা, মহানবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-“যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও অন্যায় কাজ পরিত্যাগ করল না, তার ক্ষুধার্থ ও উপবাস থাকায় আল্লাহ পাকের কোন প্রয়োজন নেই”।
(মিশকাত শরীফ)
আরো জানতেঃ snkzubayer@gmail.com
Leave a Reply