ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান: বর্তমানে আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা ও স্পিকার পদসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে কয়েক নারীকে অধিষ্ঠিত দেখে অনেকেই নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে আত্মতৃপ্তির উচ্ছ্বাস প্রকাশ করন। তাদের এই আত্মতৃপ্তিতে মনে হয় এক্ষেত্রে আমরা যেন এক মহাবিপ্লব করে ফেলেছি।কিন্তু বাস্তবে এই চিত্রটা বেশ হতাশাব্যঞ্জক।
বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে এখানে নারী-পুরুষ সমযোগ্যতায় ও সমচিন্তায় বেড়ে উঠবে এটা আমাদের জাতীয় ভাবনা । এতদসত্ত্বেও শিক্ষা, চাকুরি ও সামাজিক অবস্থান সর্বক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীরা এখনো নানা দিক থেকে পিছিয়ে । সাম্প্রতিক সময়ে সমাজে নারীর অবস্থান অতীতের তুলনায় কিছুটা উন্নতি হলেও সার্বিক বিবেচনায় নারীরা যে এখনো পিছিয়ে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই । ফলে জাতীয়ভাবে নারী-পুরুষের যে সমতার কথা, সেই সমতা অর্জিত হতে এখনো অনেক পথ পারি দিতে হবে আমাদের। এ জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে নানা উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। কিন্তু এরপরও নারীর সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনে ধীরগতি লক্ষ্যনীয়।
বর্তমানে আমাদের জনসংখ্যা ১৬ কোটির উপরে । দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক নারী। তাই এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে নিরক্ষর, অবহেলিত ও অদক্ষতায় পেছনে রেখে দেশের সার্বিক উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয় । ফলে সংবিধানেও নারী পুরুষের সমাধিকারের কথা বলা হয়েছে । তবে বাস্তব প্রেক্ষাপটে সমাজে নারী-পুরুষের বৈষম্য এখনও প্রকট।
সাম্প্রতিককালে বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, সমাজে নারীদের পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ হচ্ছে যৌন হয়রানি। এ সমস্যা এতটাই প্রকট যে, সমাজের সর্বত্রই সব বয়সী নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্রেও নারীরা এ সমস্যার সম্মুখীন। এমন কী পরিবারের ঘনিষ্ঠজনদের দ্বারাও যৌনহয়রানির শিকার হচ্ছে নারীরা।
যৌন হয়রানির ঘটনা কতটা ভয়াবহ তার প্রমাণ মেলে সম্প্রতি জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান ইউএন-উইমেনের এক জরিপে। অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাতের নেতৃত্বে পরিচালিত ওই জরিপে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ৭৬ ভাগ ছাত্রীই কোনো না কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হন। এর মধ্যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি খবুই খারাপ। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ হার ৮৭ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোতে ৭৬ শতাংশ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৬ শতাংশ এবং মেডিকেল কলেজে ৫৪ ভাগ ছাত্রী যৌন হয়রানির শিকার হন। ফলে অনেক নারী শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নিরাপদ পরিবেশের অভাবে তারা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে না।ফলে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়নেও পিছিয়ে পড়ছে নারীরা।
সাউথ আফ্রিকান মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিলের অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে বিশ্বে (বাংলাদেশসহ) ১৪ জনে একজন করে নারী কোনো না কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার । ৫৬টি দেশের নারীদের সাক্ষাৎকার এবং বিভিন্ন ঘটনা তদন্ত করে গবেষকরা এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন৷ ৭.২ শতাংশ নারী যাদের বয়স ১৫ বছরের বেশি, তারা সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, জীবনে অন্তত একবার যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন এবং সেই জঘণ্য কাজটি হয়েছে প্রেমিক বা স্বামী ছাড়াও পরিবারের অন্য আত্মীয়দের হাতে৷
এছাড়া সম্প্রতি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশন এইড এর এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে জনসমাগমস্থলে নারীদের ওপর বেশি যৌন হয়রানি হয়ে থাকে বলে এ প্রবণতা গ্রামের তুলনায় শহরে বেশি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের গবেষক এস এম মান্নানের নেতৃত্বে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জসহ সাতটি শহরে গত বছরের মে-জুন মাসে চালানো এই জরিপে প্রায় ১২০০ জনের সঙ্গে কথা বলা হয়। তাদের মধ্যে ৮০০ জন নারী ও কিশোরী এবং অন্যরা পুরুষ ও বালক।
প্রতিবেদনে বলা হয়, “গণপরিবহনসহ জনসমাগম স্থানগুলোয় নারীরা সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হন। ৮৪ শতাংশ নারী অনাকাঙিক্ষত কটূক্তি ও অশোভন আচরণের মুখে পড়েছেন। ৫০ শতাংশ নারী রাস্তাঘাটে কুপ্রস্তাব পেয়েছেন এবং ৫৭ শতাংশ নারী অনাকাঙিক্ষত স্পর্শের শিকার হয়েছেন।”
অনূর্ধ্ব ২০ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে শতকরা ৭৬ ভাগ এবং ত্রিশোর্ধ্ব নারীদের মধ্যে শতকরা ৪৪ ভাগ যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে এতে বলা হয়।
অ্যাকশন এইডের এই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, হয়রানি বা নির্যাতন চরমে না পৌঁছালে নারীরা সাধারণত বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেন না। ৫০ শতাংশ নারীই নির্যাতনের কোনো প্রতিবাদ করেন না। তবে ৫৪ শতাংশ তাদের পরিবারকে অবহিত করেন। আর ৪১ শতাংশ নারী তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনার প্রতিবাদ করেন।
হয়রানি কিংবা নির্যাতিত হলেও অধিকাংশ নারী লোকলজ্জা বা আরো হয়রানির ভয়ে এ নিয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিকার চাওয়া থেকে বিরত থাকেন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
জরিপে অংশ নেয়া ৮৪ শতাংশ নারী জানিয়েছেন, যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার পর কোনো সংস্থা বা পুলিশকে তারা কিছু জানাননি।কেননা, নারী নির্যাতনের ঘটনার প্রতিকার চাইতে গেলে পুলিশ উদাসীনতা দেখানোয় নির্যাতিতরা পুলিশের সহায়তা নিতে চান না বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
৬৫ শতাংশ নারী মনে করেন, পুলিশ উল্টো অভিযোগকারীকে দোষারোপ করে। আর ৫৭ শতাংশ বলেছেন, মামলা নিতে গড়িমসি করে পুলিশ। ৫৩ শতাংশ নারী পুলিশের কাছে অভিযোগ করেও প্রতিকার পাননি বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
ফলে যৌন হয়রানি রোধে আইন প্রণয়ন ও আইনের যথাযথ ব্যবহার করা প্রয়োজন বলে গবেষকরা মত দিয়েছেন। নির্যাতিতদের জন্য স্বাস্থ্য সেবা ও আইনি সহায়তার ব্যবস্থার পাশাপাশি সব থানায় ২৪ ঘণ্টা ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ সেল’ চালু করার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এছাড়া গৃহকর্মীর কাজ করতে গিয়ে, শিল্প-কারখানায়-কোম্পানী কিংবা সরকারি প্রতিষ্ঠানেও চাকুরি করতে গিয়ে কিংবা স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে গিয়েও নারীরা প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ফলে বাংলাদেশে নারীদের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের পরিবেশ ক্রমেই ঝুকিঁপূর্ণ হয়ে উঠছে।
এদিকে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে যৌন হয়রানি প্রসঙ্গ আলোচনায় এলেও প্রতিকারে কার্যকর আইনী সুরক্ষা পায়নি। যতদূর জানা যায়, ১৯৯২ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমে এ অপরাধের ধরনটি সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে এবং এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে। ১৯৯৮ সালের আগস্টে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে ওঠে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন এবং দীর্ঘদিন আন্দোলন চলার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্তদের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয়। এরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ধরনের আন্দোলন হয়। আস্তে আস্তে জানা যায় এবং খোলাসা হতে থাকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানির নানা ঘটনার কথা।
এছাড়া গত কয়েক বছরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী ও কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে। শিক্ষার্থীদের লাগাতার আন্দোলনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব কর্মেক্ষেত্রে যৌন হয়রানি নিরোধ নীতিমালা এবং আচরণবিধি তৈরি করার তাগিদ বোধ করে। কিন্তু এর আগে বাংলাদেশে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কোনো আইনি সুরক্ষা ছিল না।
প্রসঙ্গত, এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে ২০০৮ সালের ৭ আগস্ট কর্মস্থল এবং শিক্ষাঙ্গনে নারী ও শিশুদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধের জন্য দিকনির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্ট বিভাগে জনস্বার্থে রিট করেন বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী। এরই পরিপেক্ষিতে ২০০৯ সালের ১৪ মে যৌন হয়রানি রোধে হাইকোর্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী রায় প্রদান করেন । বাংলাদেশে এই সিদ্ধান্তই হলো এ বিষয়ে মাইলফলক। এ রায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এখানে বিভিন্নভাবে যৌন নিপীড়নকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। রায়ে যৌন হয়রানি রোধে কয়েকটি দিকনির্দেশনা উল্লেখ করে একটি নীতিমালা করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। সংসদে আইন পাস না হওয়া পর্যন্ত এটি মেনে চলা বাধ্যতামূলক।
এর ফলে আশা করা হয়, কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি, আধা সরকারি অফিস এবং সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে নারীর প্রতি যৌন নিপীড়নের প্রতিকারের হবে। সব ক্ষেত্রে নারীর সার্বিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিতকরণে এবং নারী-পুরুষ সমতা প্রতিষ্ঠায় এটি মাইলফলক বিবেচিত হবে। কিন্তু এরপর থেমে নেই নারীর যৌন হয়রানি। এর অন্যতম কারণ হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়নে নেই যথাযথ পদক্ষেপ।এছাড়া নিদের্শনা জারির ৬ বছর পরও সংসদে আইন পাস করারও যথাযথ উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি।
সবশেষে বলবো- যৌন হয়রানি হলো ব্যক্তির মৌলিক মানবাধিকার এবং সংবিধান পরিপন্থী। সুতরাং এর প্রতিকারে হাইকোর্টের যুগান্তকারী রায় বাস্তবায়নে সরকারকে আরো আন্তরিক হতে হবে। এছাড়া সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিক মন-মানসিকতার পরিবর্তন, নারীদের সচেতনতা, সাহসী প্রতিবাদ ও স্বাবলম্বী হওয়ার প্রেরণাই নারীর বর্তমান পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পারে।
লেখক: শিক্ষা ও সমাজ বিষয়ক গবেষক। ই-মেইল: sarderanis@gmail.com
Leave a Reply