ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান: ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। আমাদের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অমর ভাষণের জন্য এই দিনটি ইতিহাসে অবিস্মরণীয়। ১৯৭১ সালের এই দিনে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) তিনি যে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ তা বিদ্যুৎ-গতিতে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেদিন ময়দানজুড়ে লাখো মানুষের মুখে স্লোগান ছিল ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’।
১৯ মিনিটের সেই ভাষণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে দারুণ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। আজও বিশ্বের মুক্তিকামী শোষিত-নিপীড়িত মানুষের কাছে তা অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে পরিগণিত ।ফলে নি:সন্দেহে বলা যায়, ওই দিনের ভাষণেরই পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালোরঘাট বেতার কেন্দ্রে মেজর জিয়াউর রহমানের জবানীতে । এদিক থেকে আমাদের মহান স্বাধীনতার যুদ্ধে এই দুই মহান ব্যক্তিত্ব যে ঐতিহাসিক ভুমিকা পালন করেছিলেন তাতে কারো কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয় । আজ স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর এসে স্বার্থবাদী রাজনীতির কারণে নানাভাবে বিতর্ক করা হলেও তাদের ভুমিকা কোনোভাবেই অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই । ঐতিহাসিকভাবেই তাদের ভুমিকা সত্য ও অমোছনীয়। এ বিষয়ে আর বেশী দূর অগ্রসর হয়ে বর্তমানের এই কুলষিত রাজনীতির মারপেচে নিজেকে জড়াতে চাই না। তবে আজকের প্রেক্ষাপটে শুধু বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের চেতনা ও আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কিছুটা আলোচনা করার চেষ্টা করবো।
চেতনা বলতে আমরা কী বুঝি? এক কথায় মনের সরুপ লক্ষণ হলো চেতনা। আর মন হলো দর্শনশাস্ত্রের একটি অন্যতম কেন্দ্রীয় ধারণা। মন বলতে সাধারণভাবে বোঝায় যে, বুদ্ধি এবং বিবেকবোধের এক সমষ্টিগত রূপ, যা চিন্তা, অনুভূতি, আবেগ, ইচ্ছা এবং কল্পনার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। মন কি এবং কিভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে অনেক রকম তত্ত্ব প্রচলিত আছে। এসব তত্ত্ব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু হয় মূলতঃ প্লেটো, অ্যারিস্টটল এবং অন্যান্য প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকদের সময়কাল থেকে।ফলে এ বিষয়টি যেহেতু এখানকার আলোচ্য বিষয় নয়, তাই চেতনার সংজ্ঞার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে মূল বিষয় নিয়ে এবার একটু আলোচনার চেষ্টা করি।
৭ মার্চের ভাষণ ও আমাদের চেতনা
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান ও আজকের বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠী দীর্ঘ ২৩ বছর যে শোষণ-নিপীড়নের শিকার হয়েছিল এরই প্রেক্ষিতে সবার মাঝে একটি চেতনা গড়ে উঠেছিল। ’৪৮, ’৫২, ’৬২, ’৬৬, সবশেষে ’৬৯ এ, সে চেতনার এক মহাজাগরণের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল। এ সময়ে দীর্ঘ আন্দোলন- সংগ্রামে কখনও মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্টীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। কখনও শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানভিত্তিক, সার্বজনিন শিক্ষার জন্য সংগ্রাম, কখনও বাঙালি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার তথা স্বায়ত্বশাসন আদায়ের জন্য সংগ্রাম। কখনও বা সামরিক শাসন বিরোধী সংগ্রাম, কখনও অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া আদায়ের সংগ্রাম এবং এই পুরো সময় জুড়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র এবং বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার উপযোগী সুস্থ-সবল সাংস্কৃতিক সংগ্রাম – এ সব রক্তঝরা বেগবান আন্দোলনই প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল এক মহাজাগরণের – যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে ১৯৭১-এর মার্চ মাসে।
ইহা সর্বজন স্বীকৃত যে, সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি বিশেষ চেতনার ভিত্তিতেই ভাষণ দিয়েছিলেন এবং সে আলোকেই সমস্ত বাঙালী সম্মিলিতভাবে ঝাপিয়ে পড়েছিল তাদের চেতনার সফল বাস্তবায়নে। সম্মুখ যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান।
সেই চেতনার মূল সারাংশ ছিল- শোষণ-নিপীড়ন থেকে মানুষের মুক্তি অর্থাৎ শোষণমুক্ত একটি গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা। ১৯ মিনিটের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু সেই স্বপ্নই দেখিয়েছিলেন ৭ কোটি বাঙালীকে। তিনি দেখিয়েছিলেন এদেশের নিপীড়িত-শোষিত মানুষের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির স্বপ্ন। আর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নেই বাঙালীর মনে জাগ্রত করেছিল অদম্য স্পৃহা। আর সেই ভিত্তিতেই দীর্ঘ ৯মাস যুদ্ধে ৩০ লাখ বাঙালীর রক্ত আর অগণিত মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত হয় সেই কাঙ্খিত মুক্তি। কিন্তু দেশ স্বাধীনের ৪৪ বছর পর আজ ২০১৫ সালে দাঁড়িয়ে যদি মূল্যায়ন করি তাহলে কী আমাদের সেই ৭মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের চেতনা মোতাবেক আমরা প্রকৃত অর্থে মুক্তি লাভ করতে পেরেছি? পেরেছি শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে? না আমাদের উপর শোষন-নিপীড়নের মাত্রা আরো বেড়েছে।
প্রসঙ্গত বলতেই হয়- দেশ স্বাধীনের আগে বাঙালীদের শোষণ নিপীড়ন করতো ভিন্ন ভুখন্ডের ভিন্ন ভাষাভাষি লোকেরা, আজ তা করছে নিজ দেশের স্বার্থবাজ লোকেরা। চলতি বছরের শুরু থেকে প্রতিদিন আমরা কী দেখছি? প্রতিদিন মানুষ মরছে পেট্রল বোমা হামলায় না হয় বন্দুকযুদ্ধে। এই মৃত্যুর মিছিল ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। এটা কোনোমতেই যেন থামানো যাচ্ছে না।
এর আগেও দেশে অনেক রাজনৈতিক সংকট ছিলো, এ জন্য আন্দোলন সংগ্রামও হয়েছে। তবে এভাবে পেট্রল বোমা ও বন্দুকযুদ্ধের নামে কখনো নৃংশসভাবে মানুষ হত্যা করা হয়নি । প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও যানবাহনে পেট্রল বোমা হামলা হচ্ছে। বোমার আগুনে পুড়ে হতাহত হচ্ছে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। নারী-শিশুদেরও এ থেকে রেহাই নেই।
অন্যদিকে ঘুম থেকে উঠেই শোনা যাচ্ছে বন্দুকযুদ্ধে এক যুবক বা সন্ত্রাসী কিংবা অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি নিহত হয়েছে। এর কিছুক্ষণ পরেই মিলছে তার পরিচয়।আশ্চার্যজনক হলেও সত্য, এই সব বন্দুকযুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একজন সদস্যও হতাহত হচ্ছে না।
ইতোমধ্যে গত দুই মাসের চলমান সংকটে আগুনে পুড়ে মারা গেছে ৭৮জন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ । অন্যদিকে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হয়েছে ৩৬জনকে। ফলে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নামে আগুনে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা যেমন গ্রহণযোগ্য নয়, তেমনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক বিনা বিচারে যেভাবে মানুষ হত্যা করছে, সেটাও গ্রহণযোগ্য নয়।
অপরাধ নিয়ন্ত্রণের নামে রাষ্ট্র কর্তৃক নাগরিকের প্রাণহাণি কোনো সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পরিচয় হতে পারে না।
আজ রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক চর্চা ও আইনের শাসনের অভাবেই এ সব হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে । অন্যথা কেউ আগুনে পুড়িয়ে কিংবা অন্য কোনভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে পার পেয়েও যেত পারতো না।
রাষ্ট্রে আজ নাগরিকরা নিরাপত্তাহীন। বর্তমানে ঘরের বাইরে বের হওয়া বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে। মানুষের জানমালের স্বাভাবিক নিরাপত্তা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশ করার অধিকারের বিষয়টি সংকোচিত হয়েছে। ফলে এসব হত্যাকে যেভাবেই সংজ্ঞায়িত করা হোক না কেন, রাষ্ট্র এর দায় এড়াতে পারে না।
জোর করে ক্ষমতা দখল যেমন গণতান্ত্রিক রীতি নয়, তেমনি জনমতকে উপেক্ষা করে জোর করে ক্ষমতা ধরে রাখা কোনো গণতান্ত্রিক আচরণ হতে পারে না। ‘গণতন্ত্র’ মানে নিছক নির্বাচন নয়, রাষ্ট্রগঠনের-প্রক্রিয়া ও ভিত্তি নির্মাণের গোড়া থেকেই জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় নিশ্চিত করা। জনগণের সেই ইচ্ছা ও অভিপ্রায় রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বক্ষেত্রে নিশ্চিত করা না গেলে তাকে কোনোভাবেই ‘গণতন্ত্র’ বলা যায় না।
আর যেখানে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই, সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন স্বাভাবিক ঘটনা। মানবাধিকারের সুরক্ষার জন্য যেমন গণতান্ত্রিক পরিবেশ অত্যাবশ্যক, তেমনি গণতন্ত্র সফলের জন্য মানবাধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
ফলে বলা যায়- স্বীকৃত অধিকারগুলো নাগরিকরা যতদিন স্বাধীনভাবে ভোগ করতে না পারবে ততদিন তাদের সংগ্রাম চলবেই। আর সংগ্রামের মধ্যদিয়েই তাদের অধিকার একসময় প্রতিষ্ঠিত হবে।
আজ থেকে ৪৪ বছর আগে বাঙালী জাতি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্লোগান নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানী স্বৈরাচার আর সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধে অনেক রক্ত আর ত্যাগের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন করে তারা। যে গণতন্ত্রের জন্যে এতো আত্মত্যাগ, আজ সেই গণতান্ত্রিক চর্চা ও মূল্যবোধ কোথায়?
বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ভাষণের চেতনা বা কোথায়? এদিক থেকে আমরা বলতে পারি, যে চেতনা নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মেজর জিয়াউর রহমান দেশ স্বাধীন করেছিলেন, আজ সেই চেতনার সাথে আমরা সবাই বিশ্বাসঘাতকতা করছি। তা না হলে কী এভাবে রাজনীতির নামে আওয়ামী লীগ-বিএনপি মিলে মানুষ হত্যার অপরাজনীতিতে মেতে উঠতে পারতো?
সবশেষে বলবো- স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণের গুরুত্ব বিলীন হয়ে যায়নি বরং তা আজও বর্তমান বিশ্বের মুক্তিকামী ও গণতন্ত্রকামী মানুষের পাথেয়। ফলে আমরা যদি সেই চেতনাকে ধারণ রাজনৈতিক হানাহানি বন্ধ করে সুস্থ ও গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরতে পারি তবে আজও বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের চলার পথের দিক-নির্দেশনা, অনুপ্রেরণা ও পাথেয় হতে পারে সেই ঐতিহাসিক ভাষণ।
লেখক: শিক্ষা ও সমাজ বিষয়ক গবেষক, ই-মেইল- sarderanis@gmail.com
Leave a Reply