বুম্বার কম্পিউটারটা যেন অমর। যখন যে অঙ্গে সমস্যা দেখা দেয়, সেই অঙ্গটা বুম্বা পাল্টে ফেলে। গত এক বছরে এমন ভাবে যন্তরটা একটু একটু করে প্রায় নতুন হয়ে গেছে।
কিন্তু কিছু টাইপ করতে বসলে, একটা জিনিস বড়ই দৃষ্টিকটু লাগে – ওর ঐ আদ্যিকালের কীবোর্ড।
বুম্বার বক্তব্য – জিনিসটা ভালই চলে যাচ্ছে।
অনেক দিন ধরেই বলছে, কিন্তু আজ বিকেলে পাপাই প্রায় চেপেই ধরল, “বাজে কথা রাখ, তোর পুরনো মনিটরটাওতো বেশ ভাল চলছিল। সেটার বেলায় আপগ্রেড, আর এই কীবোর্ডের বেলায় আলসেমি?”
“ওরে শোন, ব্যাপারটা আলসেমির নয়। কিন্তু এরকম শক্ত-পোক্ত মেকানিক্যাল কীবোর্ড এখন পাওয়া চাপের”, বুম্বার জাস্টিফিকেশান।
পাপাই ছাড়ার পাত্র নয়, “সব কীবোর্ড সমান, তোর ঐ মেকানিক্যাল গল্প রাখ।”
বুম্বা মুচকি হেসে মাথা নাড়াল, “কীবোর্ডের যে কত ভ্যারাইটি, আর তার ভেতরে যে কত টেকনোলজি, সেই সব শুনলে তোর ঘাবড়ে না গিয়ে উপায় নেই।”
“বেশ, তাহলে শোনাই যাক,” পাপাই এই ব্যাপারে এক পায়ে খাড়া।
পাশের টেবিলের ওপর ঠান্ডা জলের বোতল রাখা ছিল। “সে কি আর এক দিনের গপ্পো? যা গরম পরেছে ইদানিং …” বুম্বা অন্যমনস্ক হয়ে বলেই একবারে প্রায় আধ লিটার জল খেয়ে ফেলল।
“আমার এই কীবোর্ড হল যাকে বলে ‘বাকল স্প্রিং কীবোর্ড’। প্রতিটা কী-র নীচে এতে থাকে একটা ছোট স্প্রিং। আর থাকে একটা ছোট হাতুড়ি। কী প্রেস করলে সেই হাতুড়ি গিয়ে মারে একটা কন্টাক্ট পয়েন্টে, আর তার ফলে কম্পিউটার বোঝে যে সেই কী চাপা হয়েছে,” বুম্বা বুঝিয়ে বলল।
“এর সুবিধা?” পাপাই এক ভুরু একটু উঠিয়ে জিজ্ঞেস করল।
“পেশেন্স ধরে বস, সব বলছি। প্রথম সুবিধে যে জিনিসটা খুবই নির্ভরযোগ্য। আর তার থেকেও বড় কথা – অন্তত আমার কাছে – যে এতে টাইপ করার মজাই আলাদা,” বুম্বার মুখে একগাল হাসি।
পাপাই মোটেই কনভিন্সড নয়, “টাইপিং টাইপিং। তার আবার মজা কি?”
“টাইপ করার সময়, ভাল টাইপিস্ট কখনো তার হাত চালায় না। চালায় শুধু দুই হাতের আঙুল। আঙুলের মাসল জানে যে কোন কী ঠিক কোথায়। আর জানে যে ঠিক কতটা চাপ দিলে কী-টা প্রেস হবে। চাপ যদি কম পড়ে, তবে কম্পিউটার কী-প্রেস বুঝবে না। খুব বেশি চাপে আঙুলে হবে ব্যথা। প্র্যাক্টিস করতে করতে আঙুল বুঝে নেয় ঠিক কতটা চাপ দেওয়া প্রয়োজন। এবং সেটা বোঝাতে, কীবোর্ড দেয় সঠিক ‘ফিডব্যাক’ টাইপিস্টকে।”
বুম্বাকে এখানে থামিয়ে পাপাই একটু ঠাট্টার সুরেই বলল, “তা তোর কীবোর্ড কি তোকে রোজ দিনের শেষে বলে – ‘বাহ্ ভাই আজ ভাল টাইপিং করেছ’, বা ‘আজ তোমার টাইপিং স্পীড কম কেন হে?”
বুম্বা পাপাইয়ের ঠাট্টা কখনোই গায়ে মাখে না। “কিছু কীবোর্ডে, কী-প্রেস করে ঠিক বোঝে যায় না যে ঠিক-ঠাক হল, নাকি আরও জোরে আবার প্রেস করতে হবে। বাকল স্প্রিং কীবোর্ডে এই ঝামেলা নেই। এতে সুন্দর ভাবে কী-টা নামে, এবং একটা ক্লিক শব্দে বুঝিয়ে দেবে যে প্রেস হল।”
“মনে হচ্ছে তোর কীবোর্ড নিয়ে বেশ কিছু টাইপিং করে দেখতে হবে যে তুই এতটাই উচ্ছাসিত কেন। যাই হোক, বাকল স্প্রিং বুঝলাম। কিন্তু এটা ছাড়া আর ক’রকম কীবোর্ড পাওয়া যায়?” পাপাই জিজ্ঞেস করল।
“মার্কেটে সাধারণত যে ডেক্সটপের স্ট্যান্ডার্ড কীবোর্ডগুলো আমরা দেখি, সেগুলোর বেশিরভাগই হল ‘ডোম সুইচ কীবোর্ড”। সহজে বোঝাতে গেলে মোদ্দা কথা এই যে এতে প্রতিটি কী-র নিচে থাকে একটা রবার বা পলিয়েস্টারের ‘ডোম’। আর তার নিচে একটা সার্কিট বোর্ড। কী-প্রেস হলে এই নরম ডোম একটু নেমে সার্কিট বোর্ডে টাচ করে এবং কন্টাক্টের ফলে কম্পিউটার কী-প্রেস বোঝে। “এই ধরনের কীবোর্ড বাজারে ভর্তি। কিন্তু পলিয়েস্টার এতই নরম যে স্প্রিঙের মতন চোস্ত ভাব নেই তার। তাই এমন কীবোর্ডে টাইপ করে মজা নেই। তাছাড়া এই কীবোর্ডের আয়ু বাকল স্প্রিং কীবোর্ডের তুলনায় বেশ কম।”
বুম্বা এই পর্ক্সন্ত বুঝিয়ে থামল। ও জানে যে পাপাই-এর মাথায় আরও প্রশ্ন ঘুরবেই। আর ঠিক তাই – বুম্বার থামার সুযোগ বুঝেই পাপাই-এর প্রশ্ন, “তা কীবোর্ড এই দু’রকম হয় নাকি আছে আরও রকমফের?”
“এছাড়া, আরও কয়েক রকমের কীবোর্ড হয়। সাধারণ ডোম সুইচ কীবোর্ডে ধর যদি প্লাস্টিকের কী না থাকত, তাহলে টাইপ করা হত শুধু নিচের রবার বা পলিয়েস্টার ডোম চাপ দিয়ে। এই ধরনের কিছু কীবোর্ড বাজারে উপলব্ধ ‘মেম্ব্রেন কীবোর্ড’ নামে। ইদানিং কিছু ফ্যান্সি কীবোর্ড পাওয়া যায় যেগুলোকে কাজ হয়ে গেলে ক্যালেন্ডারের মতন গুটিয়ে রাখা যায়।এগুলো আসলে একরকম মেম্ব্রেন কীবোর্ড যাতে নিচের সার্কিট বোর্ড শক্ত না হয়ে রবারের হয়।”
পাপাই-এর দিকে তাকিয়ে বুম্বা জিজ্ঞেস করল, “আরও শুনবি?”
পাপাই-এর না নেই, মাথা নেড়ে সায় দেয়।
“আর একরকম হল ‘লেসার প্রজেক্সান’ কীবোর্ড। এর জন্যে চাই শুধু একটা টেবিল জাতীয় সারফেস। এটা দেখতে একটা দাঁড়ানো মাউসের মতন। যন্ত্রটার থেকে লেসার আলো বেরিয়ে টেবিলে পড়ে। সেই আলোয় তৈরি হয় একটা স্ট্যান্ডার্ড সাইজ কীবোর্ড। সাধারণ কীবোর্ডের মতন টাইপ করতে হয় সেই টেবিলে পড়া আলোর ওপর। যন্ত্রটা লেসার এবং ছায়া দেখে বোঝে যে কোন কী প্রেস হল,” বুম্বা থেমে পাপাই-এর মুখের দিকে তাকাল।
পাপাই পুরো হাঁ। বুম্বা মুচকি হেসে বলল, “ব্যাপারটা শুনতে যতটা হ্যাপেনিং, কাজে ঠিক ততটা না। এই কীবোর্ডে টাইপ করতে এত ভুল হয় যে ঠিক-ঠাক একটা কিছু টাইপ করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য ব্যাপার।”
পাপাই আবার কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল ….
“তোর এটাই প্রব্লেম…” পাপাইকে থামিয়ে বুম্বা বলল, “এক দিনে সব প্রশ্নের উত্তর জানা চাই। তুই না একটু আগেই বললি যে আমার পুরনো কীবোর্ড নিয়ে আমি কেন এত উচ্ছাসিত সেটা তুই নিজেই টাইপ করে দেখে বুঝবি? বসে প্রশ্ন করলে তো আর সেটা জানা হবে না। যা-যা বললাম সেগুলো একটা ভাল রচনার মত করে টাইপ করে ফেল দেখি?” বুম্বা পাপাই-এর দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করল।
পাপাই বলল, “সেসব হবে। তবে তার আগে বল, তোর ঐ আকবরের আমলের কীবোর্ড থাকছে না অবসর নিচ্ছে।”
বুম্বা মুচকি হেসে বলল, “তোর কী মনে হয়?”