মহান আল্লাহর কাছে কল্যাণ ও উপকার লাভের উদ্দেশ্যে এবং ক্ষতি ও অপকার থেকে বেঁচে থাকার জন্য বিনয়ের সঙ্গে প্রার্থনা করার নামই দোয়া। অসীম দয়ালু আল্লাহ্ বান্দাকে দোয়া করার জন্য বলেছেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে
اُدْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ، إِنَّ الَّذِيْنَ يَسْتَكْبِرُوْنَ
عَنْ عِبَادَتِيْ سَيَدْخُلُوْنَ جَهَنَّمَ دَاخِرِيْنَ-
অর্থাৎ তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিব, যারা অহংকারবশত আমার ইবাদত থেকে বিমুখ হবে, তারা অচিরেই জাহান্নামে প্রবেশ করবে লাঞ্ছিত হবে। অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে,
وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيْبٌ أُجِيْبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ
إِذَا دَعَانِ فَلْيَسْتَجِيْبُوْا لِي وَلْيُؤْمِنُوْا بِي لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُوْنَ-
অর্থাৎ হে হাবীব! আমার বান্দারা যখন আপনার কাছে আমার বিষয়ে জিজ্ঞেস করে, তখন বলে দিন যে, আমি তাদের অতীব নিকটবর্তী। আমি আহ্বানকারীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে থাকি, যখন সে আমাকে আহ্বান করে। অতএব তারা যেন আমার আদেশ সমূহ পালন করে এবং আমার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করে। যাতে তারা সুপথ প্রাপ্ত হয়। এ প্রসঙ্গে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, দোয়া-ই ইবাদত।
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে- لَيْسَ شَىْءٌ أَكْرَمَ عَلَى اللهِ سُبْحَانَهُ مِنَ الدُّعَاءِ অর্থাৎ মহান আল্লাহর নিকট দোয়ার চাইতে অধিক মর্যাদাপূর্ণ বিষয় আর কিছু নেই। আলোচ্য নিবন্ধে দোয়ার পদ্ধতি, দোয়া কবুল না হওয়ার কারণ, দোয়া কবুলের সময়, কোন দোয়া আল্লাহ বেশি পছন্দ করেন, প্রভৃতি বিষয় কুরআন-সুন্নাহর আলোকে আলোচনা করার প্রয়াস পেলাম।
দোয়ার সুন্নাত পদ্ধতি
বিনয়, নম্রতা ও দাসত্ব প্রকাশ করার জন্য দোয়া করার সময় দু’হাতের তালু আসমানের দিকে রাখতে হবে এবং উভয় হাতের মাঝে সামান্য ফাঁক রেখে চেহারা বরাবর সামনে রেখে বিনয় কাকুতি-মিনতি করে প্রার্থনা করতে হবে। হাত কচলানো, রশি পাকানোর মতো হাতের তালু ঘষাঘষি করা দোয়ার আদবের খেলাপ। মনে রাখবেন, আপনি শাহানশাহের দরবারে হাত তুলেছেন, তাই এখানে কোনো ধরনের অমনোযোগিতা কাম্য নয়। এ প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়ার নিয়ম হলো, নিজের হাত দু’টি কাঁধ পর্যন্ত অথবা কাঁধের কাছাকাছি পর্যন্ত উঠাবে। কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোয়া করার সময় নিজের হাত উঠাতেন এমনকি তখন তাঁর বগলের উজ্জ্বলতা প্রকাশ পেত। আর দোয়ার প্রারম্ভে আল্লাহর প্রশংসা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দরূদ শরীফ পাঠ করবে। অতঃপর নিজের কামনা বাসনা চাইবে। আর দোয়া সারগর্ভ ও তাৎপর্যপূর্ণ হওয়া চাই। কেননা, হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিপূর্ণ (ব্যাপক অর্থবোধক দুনিয়া এবং আখিরাতকে শামিল করে) দোয়া করাকে পছন্দ করতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তাআলা অত্যধিক লজ্জাশীল ও দয়ালু। যখন কোন বান্দা তাঁর কাছে দুই হাত তুলে প্রার্থনা করে তখন তিনি তাকে শূন্যহাতে বা নিরাশ করে ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন।
দোয়ার আদবসমূহ
১. দোয়াকারী আল্লাহর রবুবিয়্যত, উলুহিয়্যত ও আসমা-সিফাতের প্রতি একত্ববাদী হওয়া।
২. একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর কাছে দোয়া করা: ইরশাদ হচ্ছে – আর তাদেরকে কেবল এ নির্দেশই প্রদান করা হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহ্র ইবাদত করে তাঁরই জন্য দ্বীনকে একনিষ্ঠ করে।
৩.আল্লাহ্র সুন্দর নামসমুহ দ্বারা তাঁকে ডাকা: ইরশাদ হচ্ছে, আল্লাহ্র জন্যই রয়েছে সুন্দর সুন্দর নাম। অতএব তোমরা তাঁকে সেসব নামেই ডাক; আর যারা তাঁর নাম বিকৃত করে তাদেরকে বর্জন কর।
৪.দোয়া করার পূর্বে আল্লাহর যথোপযুক্ত প্রশংসা করা: একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপবিষ্ট ছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে নামায আদায় করে দোয়া করল: ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে মাফ করে দাও, তুমি আমাকে রহম কর’। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: হে নামাযী! তুমি বেশ তাড়াহুড়া করে ফেললে। তুমি নামায আদায় করে যখন বসবে তখন আগে আল্লাহর যথোপযুক্ত প্রশংসা করবে, আমার ওপর দরুদ পড়বে। এরপর আল্লাহর কাছে দোয়া করবে।
৫.নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর দরুদ পড়া: রউফুর রাহিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর দরুদ না পড়া পর্যন্ত যে কোন দোয়া আটকে থাকে।
৬. দুই হাত তোলা: মুমিন বান্দা আপন দুই হাতের তালু আকাশের দিকে তুলে প্রার্থনা করবে; যেভাবে একজন নতজানু দরিদ্র সাহায্যপ্রার্থী কিছু পাওয়ার আশায় হাত পাতে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, “যখন তোমরা আল্লাহর কাছে কোন কিছু চাইবে তখন হাতের তালু দিয়ে চাইবে; হাতের পিঠ দিয়ে নয়”
৭. দোয়া কবুল হবে মর্মে বিশ্বাস রাখা: এ প্রসঙ্গে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা দোয়া কবুল হওয়ার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রেখে দোয়া কর। জেনে রাখ, আল্লাহ তাআলা অবহেলাকারী ও অমনোযোগী অন্তরের দোয়া কবুল করেন না।
৮. বারংবার চাওয়া: বান্দা আল্লাহর কাছে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণকর যা ইচ্ছা তাই কাকুতি-মিনতি করে প্রার্থনা করবে, তবে ফল প্রাপ্তিতে তাড়াহুড়া করা যাবে না। কেননা, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, বান্দার দোয়া ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল করা হয় যতক্ষণ না বান্দা ফলাফল প্রাপ্তিতে তাড়াহুড়া করে। জিজ্ঞেস করা হল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাড়াহুড়া বলতে কী বুঝাচ্ছেন? তিনি বললেন: বলে যে, আমি দোয়া করেছি; কিন্তু আমার দোয়া কবুল হতে দেখিনি। তখন সে ব্যক্তি উদ্যম হারিয়ে ফেলে এবং দোয়া ছেড়ে দেয়।
৯. দৃঢ়তার সাথে দোয়া করা: এ প্রসঙ্গে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমাদের কেউ যেন এমন না বলে যে, হে আল্লাহ! আপনি যদি চান আমাকে ক্ষমা করুন। হে আল্লাহ! আপনি যদি চান আমাকে দয়া করুন। কেননা নিশ্চয় আল্লাহর ওপর জবরদস্তি করার কেউ নেই।
১০.অনুনয়-বিনয়, আশা ও ভয় প্রকাশ করা: ইরশাদ হচ্ছে, আর আপনি আপনার প্রতিপালককে নিজ মনে স্মরণ করুন সবিনয়ে, ভীতচিত্তে ও অনুচ্চস্বরে, সকালে ও সন্ধ্যায়।
১১. তিনবার করে দোয়া করা: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন দোয়া করতেন তখন তিনবার করতেন।
১২. হালাল রিযিক: দোয়া কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত হালাল রিযিক গ্রহণ করা। ইরশাদ হচ্ছে, হে ঈমানদারগণ! তোমাদেরকে যেসব ভাল রিযিক দিয়েছি সেগুলো থেকে খাও।
১৩.গোপনে দোয়া করা: এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমরা বিনীতভাবে ও গোপনে তোমাদের প্রতিপালককে ডাক।
দোয়া কবুলে প্রতিবন্ধকতা
১.নিরাশ হওয়া : দোয়ার পর আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করবেন। নেতিবাচক কোনো চিন্তা করা যাবে না। অন্যথায় এ দোয়া কবুল নাও হতে পারে।
২.হারাম উপার্জন: দোয়া কবুল হওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে হারাম খাদ্য, বস্ত্র, পানীয় ইত্যাদি পরিহার করা। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, জনৈক ব্যক্তি দীর্ঘ সফরের ক্লান্তিতে যার মাথার চুল বিক্ষিপ্ত, অবিন্যস্ত ও পুরো শরীর ধুলোমলিন, সে আসমানের দিকে হাত প্রশস্ত করে বলে, হে আমার প্রতিপালক! অথচ তার খাদ্য ও পানীয় হারাম, তার পোশাক হারাম, তার জীবন-জীবিকাও হারাম। এমতাবস্থায় তার দোয়া কিভাবে কবুল হতে পারে? অন্যত্র বলা হয়েছে এক লুকমা হারাম আহার কারো পেটে গেলে তা তাকে ৪০ দিন পর্যন্ত দোয়া কবুল হওয়া থেকে বঞ্চিত করে।
৩.আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া : রাসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সেই সত্ত্বার শপথ, যাঁর কুদরতি হাতে আমার প্রাণ! নিশ্চয়ই তোমরা সৎ কাজের জন্য আদেশ করবে এবং অন্যায় কাজে প্রতিরোধ করবে। তা না হলে আল্লাহ তাআলা দ্রুত তোমাদের ওপর তাঁর শাস্তি অবতীর্ণ করবেন। তোমরা তখন তাঁর কাছে দোয়া করলেও তিনি তোমাদের সেই দোয়া গ্রহণ করবেন না।
৪.আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা: আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা একটি বড় ধরনের পাপ। এই পাপের কারণে দোয়া কবুল হয় না।
৫. আন্তরিকভাবে দোয়া না করা: ইরশাদ হচ্ছে, তোমরা দোয়া কবুল হওয়ার পূর্ণ আস্থা নিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করো। জেনে রেখো, আল্লাহ অমনোযোগী ও অসাড় মনের দোয়া কবুল করেন না। এ প্রসঙ্গে ইমাম জাফর সাদিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, মহান প্রভু অন্য মনস্ক অন্তরের প্রার্থনা কবুল করেন না। তাই যখন তোমরা কোন দোয়া করবে, অন্তর থেকে তা বের করবে, অতঃপর কবুল হওয়ার প্রতি আস্থাবান হবে।
৬. শুধু বিপদের সময় দোয়া করা : ইরশাদ হচ্ছে “আর যখন মানুষ কষ্টের সম্মুখীন হয়, শুয়ে বসে, দাঁড়িয়ে আমাকে ডাকতে থাকে। তারপর আমি যখন তা থেকে মুক্ত করে দিই, কষ্ট যখন চলে যায়, তখন মনে হয়, কখনো কোন কষ্টেরই সম্মুখীন হয়ে যেন আমাকে ডাকেইনি।
৭. পাপকাজ থেকে বিরত না থাকা: এ প্রসঙ্গে ইমাম বাকির রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, যখন কোন বান্দা আল্লাহর কাছে কোন কিছুর আবেদন করে তখন আল্লাহ্ পাক প্রার্থনা অতি নিকট সময়ে অথবা একটু দেরীতে পূর্ণ করতে মনস্থ করেন। কিন্তু যখনই সে বান্দা কোন গুনাহের কাজে লিপ্ত হয় তখন ফেরেশতাদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়, তার দোয়া মঞ্জুর করো না, তাকে বঞ্চিত করো, কেননা সে সীমা লঙ্ঘন করেছে। তাই তাকে বঞ্চিত করা বাঞ্ছনীয়।
৮. দোয়ার সাথে কর্ম ও প্রচেষ্টার সংযোগ না থাকা: এ প্রসঙ্গে ইমাম জাফর সাদিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ঐ ব্যক্তির দোয়া আল্লাহ কবুল করেন না, যে নিজ গৃহে বসে থেকে বলে ‘প্রভু আমাকে জীবিকা দান কর’; অথচ প্রভু তাকে বলেন: ‘আমি কি তোমাকে নির্দেশ দেইনি যে তুমি তার (রিযিকের) সন্ধানে যাবে?
৯. ফরয আমল বাদ দিয়ে দোয়াতে মশগুল না হওয়া:, ফরয নামাযের ওয়াক্তে ফরয নামায বাদ দিয়ে দোয়া করা কিংবা দোয়া করতে গিয়ে মাতা-পিতার অধিকার ক্ষুন্ন করা। বেশি ইবাদতগুজার আল্লাহর বান্দা হযরত জুরাইজ রহমাতুল্লাহি আলাইহির কাহিনী থেকে এ বিষয়ে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ঘটনাক্রমে লাগাতার কয়েকদিন তাঁর মায়ের ডাকে সাড়া না দিয়ে ইবাদতে মশগুল থেকেছেন। ফলে মা তাকে বদদোয়া করেন; এতে করে তিনি আল্লাহ্র পক্ষ থেকে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন।
১০.দোয়া গ্রহণে বিশেষ কোন সমস্যা থাকা: দোয়া কবুল না হওয়ার অন্যতম কারণ হল উক্ত বিষয়ে তার জন্য ক্ষতির কারণ থাকতে পারে। কেননা, আমরা মহান প্রতিপালকের কাছে অনেক কিছু আবেদন করে থাকি কিন্তু তার প্রতিফল সম্পর্কে আমরা অবগত নই। অনেক সময় আমরা এমন কিছু আবেদন করি, যা আমাদের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, তোমাদের কাছে হয় তো একটা বিষয় পছন্দনীয় নয়, অথচ তা তোমাদের জন্যে কল্যাণকর। আর হয় তো বা কোন একটি বিষয় তোমাদের কাছে পছন্দনীয় অথচ তা তোমাদের জন্যে অকল্যাণকর। বস্তুত আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না।”
দোয়া কবুল হওয়ার বিশেষ কিছু সময় ও স্থান
১. ফরজ সালাতের পর : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! কোন সময়ের দোয়া বেশি গ্রহণযোগ্য হয়? তিনি বললেন, ‘শেষ রাতের মাঝের দোয়া এবং ফরজ সালাতের পরের দোয়া।’
২. আজান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময়: ইরশাদ হচ্ছে,‘আজান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময়ের দোয়া কখনো প্রত্যাখ্যাত হয় না।
৩. রাতের শেষ ভাগে : হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘প্রতি রাতে যখন রাতের এক-তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকে তখন আমাদের প্রতিপালক পৃথিবীর নিকটবর্তী আকাশে অবতরণ করেন (আল্লাহর তজল্লী বর্ষিত হয়)। তখন তিনি বলেন, কে আছে আমার কাছে দোয়া করবে আমি কবুল করব? কে আমার কাছে তার যা দরকার প্রার্থনা করবে আমি তাকে তা দিয়ে দেবো? কে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে আমি ক্ষমা করে দেবো।’
৪. জুমার দিন: আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমার দিন সম্পর্কে অলোচনায় বলেন, ‘এ দিনে এমন একটি মুহূর্ত রয়েছে, যে কোনো মুসলিম বান্দা যদি এ সময় সালাতে দাঁড়িয়ে আল্লাহর নিকট কিছু প্রার্থনা করে, তবে তিনি তাকে তা অবশ্যই দিয়ে থাকেন এবং তিনি হাত দিয়ে ইঙ্গিত করে বুঝিয়ে দিলেন যে, সে মুহূর্তটি খুবই সংক্ষিপ্ত।’ আর সে সময়টি হচ্ছে, ইমামের মিম্বারে বসা হতে সালাত শেষ হওয়া পর্যন্ত।’ অন্য বর্ণনায় আছে, ‘আসর হতে মাগরিব পর্যন্ত।’
০৫. রোজাদার ব্যক্তির ইফতারের সময়ের দোয়া: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া রদ হয় না। ন্যায়পরায়ণ শাসক, রোজাদার যতক্ষণ না ইফতার করে এবং মাজলুমের দোয়া। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার দোয়া মেঘমালার উপরে তুলে নিবেন এবং তার জন্য আসমানের দ্বারসমূহ খুলে দেয়া হবে এবং আল্লাহ বলবেন, আমার মর্যাদার কসম! আমি অবশ্যই তোমাকে সাহায্য করব, একটু বিলম্ব হলেও।’
০৬. যুদ্ধের মাঠে শত্রুর সাথে মোকাবেলার সময় : প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘দুই সময়ের দোয়া খুব কমই প্রত্যাখ্যাত হয়। আজানের সময়ের দোয়া এবং যুদ্ধের সময়ের দোয়া, যখন পরস্পর তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়।’
০৭. সিজদা অবস্থায়: ইরশাদ হচ্ছে, ‘তোমরা রুকুতে তোমাদের রবের মহিমা বর্ণনা করো। আর সিজদায় অতি মনোযোগের সাথে দোয়া করবে। তোমাদের দোয়া অবশ্যই কবুল করা হবে। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘বান্দা সিজদার সময়ে মহান আল্লাহর সর্বাধিক নৈকট্য লাভ করে। কাজেই এ সময় তোমরা অধিক পরিমাণে দোয়া পাঠ করবে।”
০৮. আরাফার ময়দানে : এ প্রসঙ্গে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, দোয়ার মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো আরাফাতের দিনের দোয়া। হযরত উসামা ইবনে যায়েদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি আরাফার ময়দানে রাসূলুল্লাহর সাওয়ারীর পিছনে ছিলাম, তিনি সেখানে দু’হাত তুলে দোয়া করলেন।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘মহিমান্বিত আল্লাহ আরাফাতের দিন জাহান্নাম থেকে যত সংখ্যক বান্দাকে নাজাত দেন, অন্য কোনো দিন এত অধিক সংখ্যক বান্দাকে নাজাত দেন না। মহাপ্রতাপশালী আল্লাহ এ দিন (বান্দার) নিকটবর্তী হন, অতঃপর তাদের সম্পর্কে ফেরেশতাদের নিকট গৌরব করে বলেন, তারা কী চায়?’(সহিহ মুসলিম)।
০৯. দোয়া ইউনুস পাঠ: যেকোনো প্রয়োজনে কোনো মুসলিম যদি দোয়া ইউনুস পাঠ করে, আল্লাহ তার দোয়া কবুল করবেন।’
১০.বৃষ্টির সময়ে দোয়া : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, দু’টি বিষয় আছে এমন যেগুলো ফিরিয়ে দেয়া হয় না, আজানের সময়ে এবং বৃষ্টির সময়ে কৃত দোয়া।
১১. মোরগের ডাক: ইরশাদ হচ্ছে ‘যখন তোমরা মোরগের ডাক শুনবে, তখন তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ চাইবে, কেননা সে একটি ফেরেশতা দেখেছে। আর যখন তোমরা কোনো গাধার স্বর শুনবে, তখন শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইবে, কেননা সে শয়তান দেখেছে।
১২. ভোর বেলা: ইরশাদ হচ্ছে, যে ব্যক্তি রাতে ঘুম থেকে জেগে উঠে বলে: লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহ্’দাহু লা-শারীকালাহু, লাহুল মুলকু, ওয়ালাহুল হামদু, ওয়াহুয়া আ’লা কুল্লি শায়ইন ক্বাদীর। সুবহা’-নাল্লাহি, ওয়ালহা’মদু লিল্লাহি, ওয়া লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু, ওয়াল্লা-হু আকবার। ওয়া লা- হা’ওলা ওয়ালা- ক্বুওয়াতা ইল্লা- বিল্লা-হিল আ’লিয়্যিল আ’যীম। রাব্বিগফির লী।” তাকে ক্ষমা করে দেয়া হবে। যদি সে দোয়া করে, তবে তার দোয়া কবুল হবে। যদি সে উঠে অজু করে নামাজ পড়ে, তবে তার নামাজ কবুল করা হবে।
১৩.জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনের দোয়া: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনের আমল অন্য যে কোনে দিনের আমলের চেয়ে উত্তম।’
১৪. অপরের জন্য দোয়া করা: কারো পিছনে খালেস মনে দোয়া করলে, সে দোয়া কবুল হয়। কেননা, সেখানে একজন ফেরেশতা নিযুক্ত থাকেন। যখনই ঐ ব্যক্তি তার ভাইয়ের জন্য দোয়া করে, তখনই উক্ত ফেরেশতা ‘আমীন’ বলেন এবং বলেন তোমার জন্যও অনুরূপ হৌক’।
দোয়া কবুলের আরো কিছু উত্তম সময়
লাইলাতুল কদরের সময়, পবিত্র কা’বা শরীফ তাওয়াফের সময়, সাফা ও মারওয়া সায়ী করার সময়, যমযমের পানি পান করার আগে কৃত দোয়া, সন্তানের জন্য পিতা-মাতার দোয়া, অসহায় বিপদগ্রস্থের দোয়া, মজলুমের দোয়া যতক্ষণ সে প্রতিশোধ না নেয়, হজ পালনকারীর দোয়া যতক্ষণ সে ঘরে ফিরে না আসে, আল্লাহর পথে জিহাদকারীর দোয়া যতক্ষণ সে শহীদ না হয়, রুগ্ন ব্যক্তির দোয়া যতক্ষণ সে আরোগ্য লাভ না করে, অনুপস্থিত মুসলিমের জন্য যে দোয়া করা হয়; সেটাও তার জন্য কবুল করা হয়। অনেক সময় আল্লাহ তাআলা দোয়াকারীর বৃহত্তর স্বার্থে দোয়া কবুলে বিলম্ব করেন। আল্লাহ তাআলা যেহেতু সর্বজ্ঞানী, তার বান্দা যে বিষয়ে দোয়া করেছে তিনি তাকে বৃহত্তম আরেকটি লক্ষ্য অর্জনের জন্য তা কবুল না করে পিছিয়ে দেন। হতে পারে, বান্দা তখন দোয়া নাও করতে পারে অথবা বৃহত্তম স্বার্থের কথা তার চিন্তা চেতনায় আসে নিই, কিংবা পরকালে বৃহত্তর বিপদে রক্ষা করা ও মুক্তির জন্য তার ওই দোয়াকে দুনিয়াতে কবুল করা হয়নি। এর পরিবর্তে পরকালে তাকে উত্তম বিনিময় প্রদান করা হবে। এ সব কারণে আল্লাহ তাআলা কোনে কোনো সময় দোয়া বিলম্বে কবুল করেন। এ জন্য দোয়াকারীর নিরাশ না হওয়া চাই। বস্তুত পৃথিবী মুমিনের জন্য পরীক্ষা ক্ষেত্র। ইরশাদ হচ্ছে-
وَلَنَبْلُوَنَّكُم بِشَىْءٍ مِّنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ
مِّنَ الْأَمْوٰلِ وَٱلْأَنفُسِ وَالثَّمَرٰتِۗ وَبَشِّرِ الصّٰبِرِينَ
অর্থাৎ তোমাদেরকে ভয় ও ক্ষুধা এবং ধন-সম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়-ক্ষতি (এসবের) যে কোন কিছুর দ্বারা নিশ্চয়ই পরীক্ষা করব, ধৈর্যশীলদেরকে সুসংবাদ প্রদান কর। অতএব মুমিন মুসলমানের উচিত উপরোক্ত সময় ও দিনক্ষণগুলোতে বেশি বেশি তাওবা-ইস্তেগফারের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। নিজের একান্ত চাহিদাগুলো পূরণে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে উল্লেখিত দিন ও সময়ে তাওবা-ইস্তেগফারসহ দোয়া করার তাওফিক দান করুন। আমিন। বিজাহিন নবিয়্যিল আমিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
দোয়া মুমিনের অনন্য হাতিয়ার
লেখক: এমফিল গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়,;আরবি প্রভাষক, রাণীরহাট আল-আমিন হামেদিয়া ফাযিল মাদরাসা; খতিব, রাজানগর রাণীরহাট ডিগ্রি কলেজ জামে মসজিদ, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।
Leave a Reply