ভাষার উৎপত্তি ও বর্ণ বিকাশ এবং আরবি ভাষার অবস্থান সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকে স্বাভাবিকভাবে একজন মানুষ কথার সাহায্যে তার মনের ভাব প্রকাশ করে আসছে। শিশু জনুগ্রহণের পর একটি নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে ছোট ও তারা ভাঙা শব্দে তার মনের উদিত ভাব ও আবেগের প্রকাশ করতে চেষ্টা করে। বিশ্বস্রষ্টার এটি একটি স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম যে, শিশু তার পিতামাতার ভাষাকে অবলম্বন করে মুখ খোলে এবং কথা বলে। তাই বাচন ক্ষমতা মানুষের জন্মসূত্রে পাওয়া বিশ্বপ্রভুর এক উৎকৃষ্ট দান। এভাবেই বিশ্বের বিভিন্ন অংশে ভাষার সৃষ্টি হয়েছে। প্রয়োজনের তাগিদে মনের ভাবকে অন্যের নিকট প্রকাশ করতে গিয়ে উদ্ভাবিত হয়েছে লেখার কলাকৌশল পৃথিবীর প্রত্যেক ভাষার বর্ণমালা আছে এবং সেগুলোর সাহায্যে শব্দ গঠিত হয়। একাধিক শব্দের সঠিক প্রয়োগের ফলে বাক্য সৃষ্টি হয় এবং তা কোনো লিখনযোগ্য উপকরণের উপর উপস্থাপন করে মনের লালিত ভাবকে নিকট ও দূরের ব্যক্তিদের নিকট প্রেরণ করা যায়।
প্রাচীন লিপি বিজ্ঞানের ওপর পরিবেশিত বিভিন্ন সূত্র পর্যালোচনা করে অনুমান করা যায় যে, প্রাচীন ভাষার বর্ণমালা আবিষ্কৃত হওয়ার পূর্বে জীবঙ্গস্তুর প্রতিকৃতি, প্রতীক চিহ্ন এবং সাঙ্কেতিক চিহ্ন ব্যবহার করে লেখার কাজ চালানো হত। মিসর ও ব্যাবিলনের সভ্যতা অতি প্রাচীন নীল নদ এবং দাজলা ফোরাতের উপত্যকা ধরে প্রাচীন সভ্যতার যে ভিত্তিস্তর রচিত হয়েছিল তারই ফল্গুধারা পরবর্তীতে বিশ্বের সর্বত্র বিস্তার লাভ করেছিল। প্রাচীন মিসরের সমাধিসৌধ ও উপাসনামদির গাত্রের প্রস্তর ফলকে এক প্রকার লেখার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এটি ‘হায়রোগ্লিফস’ (hicroglyphs) বা সাঙ্কেতিক চিহ্নের লিখন পদ্ধতি হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। সাধারণত জীব-জন্তুর স্থূল প্রতিকৃতি বর্ণমালার পরিবর্তে সাঙ্কেতিক চিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে যে লেখার জন্য দিয়েছে তাকে লিপিবিজ্ঞানীগণ ‘হায়ারোগ্লিফস’ লিখন পদ্ধতি হিসেবে অভিহিত করেছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, কাক, রুন, মাছি ও মানুষ প্রভৃতির প্রতিকৃতি বর্ণমালার পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রতিকৃতির একটি অক্ষরগত অবস্থান ও মান ধরে নেয়া হয়েছে। অনুর্ধ্বা একশত সাঙ্কেতিক লিপির সাহায্যে ‘হায়রোগ্লিফস’ লিখন পদ্ধতি পরিচালিত হত। আরবি লিখন পদ্ধতির ন্যায় সাধারণত ডান দিক হতে বাম দিকে সাঙ্কেতিক লিপি সাজিয়ে লেখার কাজ সম্পন্ন করা হত।’ অনুরূপ লিখন পদ্ধতি ক্রিট, এশিয়া মাইনর, সিরিয়া ও সিনাই উপদ্বীপে প্রচলিত ছিল। ব্যাবিলনে প্রাপ্ত পাথর ও ইটের উপর এক প্রকার কীলকাকার প্রতীক চিহ্ন ব্যবহৃত হয়ে যে লিখনশৈলীর সৃষ্টি হয়েছে লিপিবিজ্ঞানীগণ তাকে ‘কিউনিফরম’ (cuneiform) বা কীলকাকার সাঙ্কেতিক চিহ্নের লিখন পদ্ধতি হিসেবে অভিহিত করেছেন। প্রাথমিক পর্যায়ে ত্রিকোণাকৃতি ছবি সাঙ্কেতিক চিহ্ন হিসেবে অক্ষরের মান নির্ণয় করত। ক্রমান্বয়ে সরলীকরণের মাধ্যমে সাধারণ প্রাকৃতিক বস্তু কীলকাকার সাঙ্কেতিক চিহ্নরূপে অক্ষরের মান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে লেখার কাজ সম্পাদন করেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, মানুষের মাথা, পা, হাত, কুঁড়েঘরে মানুষ, হাঁতুড়ি, বিভিন্ন পাত্র ও নলখাগড়া ত্রিকোণাকৃতি পরিসর সৃষ্টি করে বর্ণমালার সাঙ্কেতিক চিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ব্যাবিলনে উদ্ভাবিত এই ‘কিউনিফরম’ লিখন পদ্ধতি সেমিটিক বা সামী লিখন গোত্রভুক্ত। ‘কিউনিফরমে’ নিদের্শিত চিহ্নকে কোনো কোনো সময় হিব্রু এবং আরবি ভাষার শব্দের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। দূর প্রাচ্যের চীনে শব্দের পরিবর্তে নয়, বরং ভাবের পরিবর্তে প্রতীক চিহ্ন ব্যবহৃত হয়ে যে লিখনশৈলীর সৃষ্টি করেছে তাকে ‘ইডিয়গ্রাফ’ (ideograph) হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
চীনের ‘ইডিয়গ্রাফ’ বা প্রতীক চিহ্নের সাহায্যে ভাব প্রকাশের পদ্ধতি বাদ দিলে মিশরের ‘হায়রোগ্লিফস’ এবং ব্যাবিলনের ‘কিউনিফরম’ লিখন পদ্ধতি পর্যায়ক্রমে বিবর্তনের ফলে প্রারম্ভিক অবস্থায় সেমেটিক বা সামী ভাষাসমূহের বর্ণমালা ও লিপির উদ্ভব ঘটিয়েছে এবং পরবর্তীতে তা ইউরোপীয় ভাষাসমূহের বর্ণ বিকাশে প্রভূত অবদান রেখেছে। আধুনিক পণ্ডিতগণের মতে, ফিনিসিয়ার অধিবাসীগণ মিসরের ‘হায়রোগ্লিফস’ লিখন পদ্ধতির দ্বারা বর্ণমালাভিত্তিক লিখন পদ্ধতির সূত্রপাত করেছিল। কিন্তু হায়রোগ্লিফস এবং ফিনিসীয় বর্ণমালাভিত্তিক লিখন পদ্ধতির মধ্যে সময়ের এক বিরাট ব্যবধান লক্ষ করা যায়। সম্ভবত এই ব্যবধানের মধ্যে সিনাই উপদ্বীপে খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ বছর আগে সিনাইতীয় বর্ণমালা, মিসরীয় হায়রোগ্লিফস এবং ফিনিসীয় বর্ণমালাভিত্তিক লিখন পদ্ধতির মধ্যে এক যোগসূত্র স্থাপন করেছিল। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, হায়রোগ্লিফস পদ্ধতিতে ব্যবহৃত ‘ষাড়ের মাথা’ ফিনিসীয় ভাষায় ‘আলিফ’ অক্ষরের প্রতীক চিহ্ন হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। সিনাইয়ে বর্ণমালার যে উৎপত্তি হয়েছিল তা দক্ষিণ আরবে পরিব্যাপ্ত হয়ে একটি স্বতন্ত্ররূপ পরিগ্রহ করে এবং খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতাব্দীতে তা পূর্ণ মাত্রায় ব্যবহৃত হতে থাকে। ক্রমান্বয়ে এ বর্ণমালা আরবদের পাথর ব্যবসায়ের সূত্রে উত্তরাভিমুখে ফিনিসীয় উপকূলে পৌঁছে এবং পরবর্তীতে ব্যবসায়ের সূত্র ধরে সে স্থান থেকে গ্রিকদের নিকট হস্তান্তরিত হয়ে যাবতীয় ইউরোপীয় বর্ণমালার জন্মদাত্রী হিসেবে বিবেচিত হয়। বিষয়টিকে পূর্বাপর সাজিয়ে বলা যায় যে, সিনাইতীয় বর্ণমালার রূপান্তর থেকে দক্ষিণ আরবি বর্ণমালার উদ্ভব হয়েছে এবং তা বিকাশের ধারায় ফিনিসীয়, রাস আল-শামরাহ, পরবর্তী গ্রিক, ল্যাটিন এবং আরবি বর্ণমালার উৎপত্তি ও ক্রমোন্নয়নে প্রকৃত প্রভাব বিস্তার করেছে।
সেমিটিক বা সামী ভাষার মধ্যে আরবিকে বয়সের দিক হতে সর্বকনিষ্ঠ মনে করা হয়। কিন্তু সব ভাষার চেয়ে এর গ্রহণ ও ধারণ ক্ষমতা এত বেশি ছিল যে মধ্যযুগ বিশেষ করে আব্বাসীয় আমলে মুসলিম সভ্যতার স্বর্ণযুগে এটি আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করেছিল। ইউরোপীয় সভ্যতার প্রসারের ফলে পরবর্তীতে ইংরেজি ভাষা বিশ্বের সব ভাষার ওপর প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। বর্তমান বিশ্বে মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচুর্য ও চাকুরির আকর্ষণ বিশ্ববাসীকে পুনরায় আরবি ভাষার পঠনপাঠনের দিকে প্রলুব্ধ করছে। ভাষার অতীত ও বর্তমানের এই প্রেক্ষাপটে আরবি ভাষার বিকাশ এবং তার সুকুমার লিখন পদ্ধতির ওপর একটি সমীক্ষা পেশ করার প্রয়াস পাব।
আরবি ভাষা এবং লিখন পদ্ধতির উৎপত্তি সুস্পষ্ট নয়। এ সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ ও তত্ত্ব আছে। কথিত আছে যে, হযরত আদম (আ) আরবি, সিরীয় এবং অন্যান্য বর্ণমালার উদ্ভাবন করেন এবং ঐসব ভাষায় ভাবের আদান-প্রদান করেন।” আদমের (আ) পর তাঁর পুত্র শীস (আ) আরবি বর্ণ ও অক্ষরের উৎকর্ষ সাধন করেন। অপরপক্ষে আবদুল্লাহ বিন আব্বাসের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, হযরত ইসমাঈল (আ) চৌদ্দ বছর বয়সের সময় আরবি বর্ণমালায় লেখার পদ্ধতি চালু করেছেন। উপরিউক্ত দু’টি মতের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে বলা যায় যে, আদম (আ) কর্তৃক প্রবর্তিত আরবি লিপির প্রকৃত রূপ প্রদান করেন হযরত ইসমাঈল (আ)। ইবরাহীমের (আ) অপর পুত্র হযরত ইসহাক (আ) ও তাঁর বংশধরগণ সিরীয় বর্ণমালা ও ভাষার বিকাশ সাধন করেন। কারো কারো মতে, আরবি লিপির উদ্ভব হযরত ইদরীসের (আ) দিকে নির্দেশ করা হয়, যিনি ‘মাকালী’ বৈশিষ্ট্যের লিখন পদ্ধতিকে পূর্ণতার রূপ দান করেছেন। ১১ আরবি ভাষা ও লিখন পদ্ধতি সম্পর্কে উপরের উদ্ধৃতি কিছুটা উপকথার পর্যায়ভুক্ত। ইতিহাসের কষ্টিপাথরে এসবের যাচাই করা সহজসাধ্য নয়। ইবনে ইসহাক হতে বর্ণিত আছে যে, প্রাথমিক পর্যায়ে উমায়ম, জুদাইস এবং তাসম গোত্রের ব্যক্তিভিত্তিক নাম অনুসারে আরবি বর্ণমালার নামকরণ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। উত্তর আরবে নাবাতীয় সাম্রাজ্য খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর প্রারম্ভে শক্তিশালী ক্ষমতা হিসেবে বিদ্যমান ছিল। ১০৫ খ্রিস্টাব্দে নাৰাতীয় শক্তি স্বাধীনতা হারিয়ে রোমান সাম্রাজ্যের এক অঙ্গ প্রদেশে পরিণত হয়। নাবাতীয়দেরকে আরবদের সাথে একীভূত করা হয়ে থাকে। নাবাতীয়গণ দৈনন্দিন জীবনে আরবি ভাষায় ভাবের আদান-প্রদান করলেও আরবি বর্ণমালা ও লিখনশৈলীর উদ্ভাবিত না হওয়ার কারণে তাদের উত্তরাঞ্চলয় প্রতিবেশী এ্যারামীয়দের গোলায়িত লিখন পদ্ধতির সাহায্য গ্রহণ করত। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে এ্যারামীয় লিখনশৈলী হতে গোলায়িত নাবাতীয় লিখন পদ্ধতির সৃ হয়- যা পরবর্তীতে উত্তর আরবের সাবলীল আরবি লিখনশৈলীতে পরিবর্তিত হয়। এ সম্পর্কে উল্লেখিত হয়েছে যে, খ্রিস্টাব্দ ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রারম্ভে নাবাতীয় বর্ণমালা হতে আরবি বর্ণমালার উদ্ভব হয়েছে। আবার অপর সূত্র অনুযায়ী সিরীয় লিখন পদ্ধতি আরবি লিখন পদ্ধতির উৎপত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। 38
উপরে উত্থাপিত সেমিটিক বা সামী বর্ণমালা ও লিখন পদ্ধতির প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, নাবাতীয় লিখন পদ্ধতিতে ব্যবহৃত বর্ণ ও অক্ষরের প্রকৃতি সাধারণত গোলায়িত এবং সিরীয় লিখন পদ্ধতিতে স্বর চিহ্ন অক্ষরের পৃথকীকরণের জন্য ব্যবহৃত ‘নোকতা’ বা বিন্দু এবং শব্দ বিন্যাসের নিয়ম পদ্ধতি পরিলক্ষিত হয়। ‘মাকালী’ পদ্ধতির লিখন বৈশিষ্ট্যের মধ্যে গোলায়িত অক্ষরের অনুপস্থিতি এবং লম্ব ও উল্লম্ব দণ্ডের ব্যবহার বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই তিনটি লিখন পদ্ধতি আরবি বর্ণমালা এবং লিখন পদ্ধতির উৎপত্তি ও বিকাশের ক্ষেত্রে প্রভূত অবদান রেখেছে। আরবি বর্ণমালায় লম্ব দণ্ডের জন্য ‘মাকালী’ পদ্ধতি, গোলায়িত আকৃতির জন্য নাবাতীয় পদ্ধতি এবং স্বর চিহ্ন ও অক্ষর পৃথকীকরণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত কৌশলের জন্য সিরীয় লিখন পদ্ধতি উৎস হিসেবে গৃহীত হয়েছে বলে অনুমান করা যেতে পারে। আরবি বর্ণমালা পরিপূর্ণ রূপ পরিগ্রহ করার ফলে এবং প্রয়োজন অনুসারে তাদের সঙ্কোচন ও সম্প্রসারণ করে ত্বরিৎ লেখার কাজ সমাধা ও অলঙ্করণের প্রয়োজনীয়তা ব্যবহার করার প্রেক্ষিতে সুন্দর হস্তলিখন পদ্ধতির উদ্ভব ও বিকাশ সাধিত হয়েছে। আরবি হস্ত লিখন শিল্প যেভাবে উৎকর্ষ লাভ করেছে তা অন্যকোনো ভাষার লিখন পদ্ধতির ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ করা যায় না। এটি সম্ভব হয়েছে লিখনশিল্পীদের দৃঢ় প্রত্যয় ও সাধনা দ্বারা শিল্প সাধনা মানুষের প্রকৃতির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। শিল্পের সাধনা বিভিন্ন যুগে বিভিন্নভাবে ধারা বদলিয়েছে এবং প্রশংসনীয় হয়ে আসছে। প্রাক ইসলাম যুগে কোনো শিল্প চর্চার ওপর বাধা-নিষেধ আরোপিত না হওয়ায় শিল্পী ভাস্কর্য ও চিত্রকলার উৎকর্ষ সাধনে যথেষ্ট উৎসাহ প্রদর্শন করেছে। কিন্তু ইসলামের আবির্ভাবের পর ভাস্কর্য ও চিত্রকলার ওপর ধর্মীয় নিষেধ আরোপিত হয়েছে। কুরআন হাদিসে চিত্রকলার চর্চাকে গর্হিত কাজ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এতদসত্ত্বেও পরবর্তীকালে মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় চিত্রকলা চর্চা অব্যাহত রয়েছে এবং তা বিকাশ লাভ করেছে। তবুও চিত্রশিল্পীগণ সাধারণভাবে সমাজের চোখে উন্নত মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হননি। এসব অবস্থার প্রেক্ষিতে ইসলামে অনুমোদিত শিল্পচর্চার দিকে শিল্পীদের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে। ইসলামের প্রাথমিক যুগ হতে সুন্দর হস্তলিপি প্রশংসিত শিল্প হিসেবে ইসলামি আইনের অনুমোদন লাভ করেছে। ‘হুসনে খত’ বা সুন্দর হস্তলিখনের অধিকারী ব্যক্তি সমভাবে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ করেছেন। ক্যালিগ্রাফী (calligraphy) বা সুন্দর হস্তলিপি উদ্ভবের প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে লিপিকার কর্তৃক লেখার মাধ্যমে কুরআন সংরক্ষণ পদ্ধতিকে উপস্থাপন করা যায় মহানবীর (স) ওপর অবতীর্ণ গুহি লিখে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গৃহীত হয়। এ ব্যাপারে সুন্দর হস্তলিখনকে উৎসাহিত করা হয়েছে। আরবি কুরআনের ভাষা হওয়ার ফলে প্রাথমিক যুগ হতে ইসলামের • অনুসারীগণ কুরআনের পঠনপাঠনের দিকে আত্মনিয়োগ করেছেন এবং সুন্দর হস্ত পৃক্ষরে কুরআনের লিখন ও সংরক্ষণ সৎকর্ম হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। কুরআন ও হাদিসে কলমের ব্যবহার করে সুন্দরভাবে লেখার কাজ সম্পন্ন করার জন্য উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। ফলে শিল্পীগণ এদিকে উৎসাহিত বোধ করেছেন। উপরন্ত মুসলিম শাসকগণ লিপিকারগণকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছেন। অর্থ সাহায্য যাতিত তাঁরা বিভিন্ন সম্মানজনক উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন।
প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার সুষ্ঠু সম্পাদনের জন্য এবং বৈদেশিক শাসকবর্গের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের ব্যাপারে চিঠিপত্রের আদান-প্রদান অপরিহার্য হয়ে পড়ে। ফলে স্পষ্ট অথচ সুন্দর লেখার ওপর গুরুত্বারোপিত হয়। হুদায়বিয়ার সন্ধিপত্র লেখার জন্য মহানবী (স) আলীকে নিয়োগ করেছিলেন। কারণ হযরত আলীর (রা) লেখা ছিল সুন্দর ও স্পষ্ট। আরবি লিপিকলার বিকাশে এটিকে প্রাথমিক উদ্যোগ হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে। হুদায়বিয়ার সন্ধির পর মহানবী (স) বিভিন্ন দেশের শাসকবর্গের নিকট ইসলামের বাণী পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে লিপি প্রেরণ করেছিলেন। শুদ্ধ ও সাবলীল ভাষায় এসব পত্র লেখা হয়েছিল। যেসব শাসকের নিকট তিনি পত্র প্রেরণ করেছিলেন তাদের মধ্যে পারস্যের সম্রাট খসরু পারভিজ, রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াস এবং মিসরের শাসক মুকুকাস প্রসিদ্ধ। মহানবী (স) কর্তৃক প্রেরিত এসব পত্রের লেখক কে ছিলেন তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে হস্তলিখন শিল্পের পর্যায়ক্রমিক উন্নয়ন ও বিকাশ এ সময় হতে লক্ষ করা যায়। ১ মুকুকাসের নিকট প্রেরিত পত্রের লিপি পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে, বর্ণমালায় একটিকে অপরটি হতে পৃথকীকরণের উদ্দেশ্যে নোকতা ও স্বর চিহ্ন ব্যবহৃত হয়নি। কিন্তু বর্ণমালার উল্লম্ব ও লম্ব দণ্ডের প্রয়োগ সুসামঞ্জস্যভাবে করা হয়েছে। সম্ভবত এসব পত্র কৌণিক লিখন পদ্ধতির আওতায় পড়ে। কাজেই দেখা যায় যে, মহানবীর (স) আমল হতে লিপিকলার ওপর গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে। পরবর্তীতে তাঁর অনুসরণ অব্যাহত রয়েছে। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা) প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ‘দীওয়ান’ বা রাজস্ব আদায় ও আয়ব্যয়ের হিসাব-নিকাশ এবং নামের তালিকা প্রস্তুতকরণের উদ্দেশ্যে রেজেস্ট্রি বিভাগের গোড়াপত্তন করেন। এই কাজ পরিচালনার জন্য লেখকের প্রয়োজন পড়ে এবং কোনোরূপ বিশেষ পদ্ধতি গ্রহণ না করেও হস্তলিখন শিল্পের ক্রমোন্নয়ন সাধিত হতে থাকে। এরপর তৃতীয় খলিফা হযরত উসমানের (রা) আমলে খিলাফতের বিভিন্ন অঞ্চরে চলিত আঞ্চলিক পরিভাষার মাধ্যমে পঠিত কুরআনের অনুলিপিসমূহকে বাতিল করে দিয়ে মহানবীর (স) স্ত্রী হযরত হাফসার (রা) নিকট সংরক্ষিত শুদ্ধ কপি হতে অনুলিপি প্রস্তুত করে সর্বত্র কুরআন পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়। এই কাজে অনেক লিপিশিল্পীকে নিয়োগ করা হয়। ফলে পরোক্ষভাবে এই প্রক্রিয়া আরবি হস্তলিখন শিল্পের ধারাবাহিক বিকাশে যথেষ্ট অবদান রেখেছে। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে যে, ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমরের (রা) সময় বাইজেন্তীয় ও সাসানীয় সাম্রাজ্য বিজয়ের ফলে সিরিয়া ও পারস্যে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা হয়। মিসর বিজিত হয়ে সেখানেও মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। আরবের বাইরে ইসলাম ছড়িয়ে পড়লেও এবং মুসলিম শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হলেও প্রশাসন কাঠামোর সেদেশীয় ভাষা বহাল রাখা হয়েছিল। ফলে আরবি বর্ণ বিকাশে ভাষার উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি।
উমাইয়া শাসন আমলে আরবি ভাষার ক্রমোন্নয়নে দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়। উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান সাম্রাজ্যের সর্বত্র প্রশাসন ব্যবস্থাকে সুবিন্যস্ত করতে গিয়ে আরবীয়করণ নীতি অনুসরণ করেন। আরবিকে একমাত্র রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দান করে তিনি প্রশাসন কাঠামোর সর্বস্তরে আরবি ভাষা চালু করেন। বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা রাষ্ট্রের প্রশাসন যন্ত্র থেকে বর্জিত হয়। সিরীয়, কণ্ডীয় ও পাহলবী ভাষার চর্চা কার্যত স্তিমিত হয়ে পড়ে। কারণ সরকারি চাকুরিতে যোগদানের জন্য এবং রাষ্ট্রীয় অনুকম্পা গ্রহণের উদ্দেশ্যে আরবি ভাষা আয়ত্ত করতে প্রত্যেকেই উৎসাহিত বোধ করে। এমনকি ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় ভাষা হওয়ার কারণে মিসর, সিরিয়া এবং ইরাকে জনজীবনের সর্বস্তরে আরবি একমাত্র ভাষা হিসেবে গৃহীত হয় এবং ক্রমান্বয়ে তা তাদের মাতৃভাষায় রূপান্তরিত হয়। আবদুল মালিকের এই আরবীয়করণ নীতি আরবি ভাষার বিকাশের ক্ষেত্রে বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। সর্বজনীন ও আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদায় উন্নীত করার প্রয়াসে আবদুল মালিক বিশেষ কতকগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। প্রথমত, অনারব জনগণের সহজবোধ্য করার উদ্দেশ্যে বর্ণমালায় নোকতা ও স্বর চিহ্নের ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়। দ্বিতীয়ত, ভাষাকে সাবলীল ও গতিশীল করার লক্ষ্যে ব্যাকরণের নীতিমালা নির্ধারিত হয়। তৃতীয়ত, হস্ত লিখন শিল্পের সরলীকরণ রীতি গৃহীত হয়। কারণ প্রশাসনে আরবিকরণ নীতি বাস্তবায়িত হওয়ার ফলে আরবিতে লেখার কাজ পরিচালনা করার পরিধি বেড়ে যায়। স্বাভাবিকভাবে হস্তলিখন শিল্পে সহজ পদ্ধতি উদ্ভাবিত হতে থাকে পর্যায়ক্রমে উন্নতি ত্বরান্বিত করে। আবদুল মালিকের এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের পরামর্শ ও সুচিন্তিত অভিমত প্রশংসা পাওয়ার দাবি রাখে।
আরবি বর্ণমালার বিকাশ, ভাষার উন্নতমান এবং হস্তলিখন শিল্পের গতিশীলতা নিশ্চিত করতে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের প্রচেষ্টা পরবর্তীকালে আরবি ভাষাকে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার আকরে পরিণত করেছিল। সরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন প্রশাসনিক বিভাগের আরোপিত হয়। ফলে হস্তলিখন শিল্পকে অধিক গতিশীল করার প্রয়াসে সহজতর পদ্ধতি উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। দ্রুতগতিতে লেখার কাজ সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে লিপিশিল্পীদেরকে উৎসাহিত করা হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে কৌণিক লিখন পদ্ধতির উন্নয়নের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয় এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দান করা হয়। প্রাপ্ত উপকরণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, হস্তলিখন শিল্পের উদ্ভাবনের কৃতিত্ব আরব মুসলমানদের প্রাপ্য। উমাইয়া যুগ (৬৬১-৭৫০ খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত আরব লিপি শিল্পীদের দ্বারা কৌণিক লিখন পদ্ধতির বিকাশ সাধিত হয়। এ যুগেই দ্রুতগতিতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে লেখার কাজ চালানোর উদ্দেশ্যে কৌণিক লিখন পদ্ধতি ক্রমান্বয়ে কিছুটা গোলায়িত পদ্ধতির দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
হস্তলিখন শিল্পের বিকাশে আব্বাসীয় আমলকে তৃতীয় পর্যায় হিসেবে গণ্য করা যায়। পূর্বের চেয়ে সরকারি কার্যক্রম বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে লিখন শিল্পকে আকর্ষণীয় করে তোলার দিকে দৃষ্টি দান করা হয়। উপরন্ত শিক্ষা ও সংস্কৃতির পরিমণ্ডল সম্প্রসারিত হয়। খলিফা আল মনসুরের ‘দারুত তারজামা’ এবং খলিফা আল মামুনের ‘বায়তুল হিকমা’ ব্যাপকভাবে বিদেশি ভাষায় রচিত গ্রন্থাদি আরবিতে অনূদিত করার কার্যক্রম গ্রহণ করে এবং অধিক পরিমাণে অনুলিপি প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে হস্ত লিখনে পারদর্শী শিল্পীদের নিয়োগ করা হয়। এছাড়াও জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পণ্ডিত ব্যক্তিগণ কর্তৃক মৌলিক গ্রন্থাদি রচিত হতে থাকে। এসব গ্রন্থের বহুল পরিমাণে পাণ্ডুলিপির অনুলিপি তৈরি করতে অধিক সংখ্যক লিপিকারকে নিয়োগ করা হয়। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে লিখন শিল্পে গতি সম্প্রসারিত হয় এবং বিভিন্ন প্রকারের লিপি পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়।
Leave a Reply