
বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে বিশেষত সমালোচনা ও গবেষণার জগতে এবং অনুবাদকর্মে প্রফেসর মোবাশ্বের আলীর পাণ্ডিত্য অতীব উজ্জ্বল এবং স্বকীয়তা বলে দেদীপ্যমান। তিনি ২০০৫ সালের এই দিনে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি মোট ৪৩টি বই রচনা করেছিলেন—যেগুলো তাকে অমরতার বরপুত্র দিয়েছে। তার রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে বিশ্ব সাহিত্য, গ্রিক ট্র্যাজেডি, মধুসূদন ও নবজাগৃতি, নজরুল প্রতিভা, শিল্পীর ট্র্যাজেডি, রবীন্দ্রনাথ ও অন্তরঙ্গ আলোকেসহ বিভিন্ন নিরীক্ষাধর্মী গ্রন্থ, যা সমাজ ও বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। তার রচিত বাংলাদেশের সন্ধানে গ্রন্থটিতে এ দেশের মানুষের হাজার বছরের ইতিহাস বিধৃত হয়েছে। বইটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে উত্সর্গ করা হয়েছে। এটি একটি অনবদ্য গ্রন্থ। বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে তিনি তুলনা করেছেন একটি জাতির সৃষ্টির উন্মেষলগ্ন হিসেবে। তার অনবদ্য গ্রন্থ বিশ্ব সাহিত্যে তিনি বিশ্বের কালজয়ী ইতিহাসকে একমলাটে বন্দি করতে চেয়েছেন। আবার বঙ্কিম চন্দ্রের ওপর রচিত তার গ্রন্থটি সাবলীল ভাষায় বঙ্কিমের জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা রয়েছে। প্রফেসর মোবাশ্বের আলী ভাষা আন্দোলনের একজন সৈনিক ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তার কুমিল্লার বাসা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল। এ কারণে দুবার পাকিস্তানি বাহিনী তাকে ও তার স্ত্রী খুরশিদা খাতুনকে গ্রেফতার করতে চেয়েছিলেন। প্রফেসর মোবাশ্বের আলী কেবল গবেষক ও সাহিত্য সমালোচক ছিলেন না, একজন সফল অনুবাদকও বটে। তার বহু অনুবাদগ্রন্থ বাংলা একাডেমি এবং বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত তার বইগুলো শেষ হয়ে গেলে আর মুদ্রণ করা হয়নি। বরিস পাস্তারনাকের ওপর তার রচিত গ্রন্থটি বর্তমান যুগেও বেশ সাড়া জাগানো গ্রন্থ। হোমারের ইলিয়াডের মতো অনুবাদকর্ম প্রফেসর মোবাশ্বের আলী কেবল সফলভাবে অনুবাদ করেননি, দেশ ও জাতির মানস গঠনে তিনি অনন্য সাধারণ ভূমিকা রেখেছিলেন। একজন প্রগতিশীল শিক্ষক হিসেবে তার পাঠ ও পঠনভঙ্গি এখনও মনের আয়নাতে জাগরূক রয়েছে।
প্রফেসর মোবাশ্বের আলী বঙ্গবন্ধু হত্যকাণ্ডের পর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে এবং বাসায় মিলাদ করে প্রতিবাদ করে বিপদে পড়েছিলেন। তার পরও আমৃত্যু বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের প্রতি ছিল ভালোবাসা। তিনি বাংলা ব্যাকরণ ও রচনার ওপর দুটো গ্রন্থ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের জন্য রচনা করেছিলেন। অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী প্রফেসর মোবাশ্বের আলী দেশ, জাতি ও বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর কবীর চৌধুরী মোবাশ্বের আলী স্মারক গ্রন্থে মন্তব্য করেছিলেন যে, বাংলা সাহিত্যের বিকাশে তার অবদান অনন্য। তার সম্পর্কে প্রফেসর নীলিমা ইব্রাহীম মন্তব্য করেছিলেন যে, বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধতর করতে এবং ধ্রুপদি সাহিত্যের বিকাশে একনিষ্ঠ অগ্রনায়কের ভূমিকা পালন করে গেছেন। অন্যদিকে প্রফেসর ড. আনিসুজ্জামান স্যার মন্তব্য করেছেন যে, বঙ্কিম চন্দ্রের ওপর রচিত গ্রন্থখানি স্বল্প পরিসরে বঙ্কিমচন্দ্রকে মূলায়িত করেছেন নিষ্ঠা এবং দায়িত্বশীলতার সঙ্গে। মোবাশ্বের আলী অনুবাদ কর্মে নিজের স্বকীয়তা এবং বাংলা সাহিত্য বিকাশ সাধনে এক অগ্রনায়কের ভূমিকা পালন করেছিলেন। তার অনুবাদকর্ম অত্যন্ত সাফল্যমণ্ডিত ছিল। মোবাশ্বের আলী বাংলা সাহিত্যকে নতুন দিগন্তের সূচনা করতে চেয়েছেন। তিনি শিল্পীর ট্র্যাজেডি গ্রন্থে শিল্পীদের জীবনের দুঃখ-বেদনাকে ভাস্বর করেছেন। মোবাশ্বের আলীর বড় গুণ হচ্ছে তার গদ্যরীতির একটি সহজাত প্রতিভা ছিল যা কি না পাঠকের মনোজগতে অনুসন্ধানী চিন্তা চেতনার উদ্রেক করে থাকে। তার রচিত সমগ্র গ্রন্থগুলো এক মলাটে বাংলা একাডেমি প্রকাশ করতে পারত। গ্রিক ট্র্যাজেডিতে তিনি গ্রিক সাহিত্যের সঙ্গে বাঙালি পাঠকদের মনোজগতকে সুনিবিড়ভাবে একইসঙ্গে সমন্বয় সাধনে ব্রতী হয়েছিলেন। তার এই সে রচনা তো এখনো পাঠককে আলোড়িত করে থাকে। মোবাশ্বের আলী সব সময়ে বিশ্বাস করতেন যে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ দেশের সমালোচনা জগত এবং অনুবাদকর্ম কেবল পাঠককে আলোড়িত করবে তা নয় বরং বাংলাদেশের সাহিত্য হবে এ দেশের সাহিত্য কর্মকাণ্ডের উত্সারিত এবং মৌলিক পটভূমি যেখানে তিনি বিশ্বদরবারে বাংলা ভাষাভাষিদের স্থান অনেক উচ্চমাত্রায় হবে বলে বিশ্বাস করতেন। বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে ধ্রুপদি সাহিত্যের বিন্যাস, আধুনিক আলোচনার জগত্ এবং অনুবাদকর্মকে তিনি সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছিলেন। মোবাশ্বের আলী বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার ইতিহাসের প্রধান সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। অথচ আজ তার নিজস্ব পৈতৃক ভূমি অন্যে দখল করার ঘৃণ্য প্রয়াসে লিপ্ত। মধুসূদনের ওপর একাধিক গ্রন্থ তিনি রচনা করেছেন। তবে মধুসূদন ও নবজাগৃতি তার মতে শ্রেষ্ঠ রচনা বলে মনে করতেন। প্রফেসর মোবাশ্বের আলীর মতো ব্যক্তিত্বকে স্বাধীনতা পুরস্কারে (মরণোত্তর) ভূষিত করা হলে দেশের প্রগতিশীল ও মুক্ত বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ খুশি হবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। তাকে আজ মৃত্যু দিবসে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।
লেখকঃ মো. ফেরদৌস হাসান
প্রভাষক, বাংলা, মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ, মিরপুর, ঢাকা
Leave a Reply