আজ থেকে তিনদিন পর ৪৯তম বিজয় দিবস। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনব্যাপী সঙ্কল্প ছিল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে মাথা তুলে বিশ্ব দরবারে উচ্চ স্থানে পৌঁছে দেয়ার। এ প্রয়াস বাঙালী জাতির উত্থানপর্বকে ত্বরান্বিত করেছে। বঙ্গবন্ধু বিশাল নেতৃত্ব গুণে একজন প্রজ্ঞাবান রাজনৈতিক নেতা হিসেবে স্বাধীনতা অর্জনের ঘোষণা দিয়েই ক্ষান্ত হননি, বরং পাকিস্তানের কারাগারে থেকে মৃত্যু ঝুঁকি নিয়েও অভীষ্ট সিদ্ধি অর্জনে অটল ছিলেন। তাঁর মতো মহৎ নেতা আসলে ক্ষণজন্মা পুরুষ। নচেৎ যার ধান-জ্ঞান ছিল বাঙালীর মুক্তি সাধন, তাঁকে কতিপয় কুচক্রী সপরিবারে হত্যার মতো জঘন্য কাজ করার সাহস পেত না। বঙ্গবন্ধু যেন বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর সেই কবি, যিনি প্রতিটি স্তরে স্বপ্ন দেখেছেন কেমন করে বহুমুখীভাবে রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে হয়। একদিকে কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, খেটে খাওয়া মানুষ থেকে আরম্ভ করে বহুধাবিভক্তকরণের মাধ্যমে দেশের এ অগ্রযাত্রা মানবিক কল্যাণে সম্পৃক্ত। এমনকি যা কিছুতে বাঙালীর ভাল সাধিত হবে, তা বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধু সদা সর্বদা প্রয়াস নিয়েছিলেন। তাই তো স্বনির্ভর আন্দোলন তিনি শুরু করেছিলেন। আজ যারা দেশে-বিদেশে দরিদ্র মানুষের কথা বলে বিভিন্ন পুরস্কার নিচ্ছেন, মডেল তৈরি করছেন, তা মূলত কুমিল্লা কোপারেটিভ, যেটি তিন স্তরবিশিষ্ট ছিল, সেটির মাঝে সংযোজন-বিয়োজনের মাধ্যমে বাহবা কুড়াচ্ছেন অনেকে। তিনি তাঁর অকৃত্রিম ন্যায়-নিষ্ঠার কারণে পেট্রোবাংলা, বাপেক্স স্থাপন করেছিলেন। দুঃখ লাগে বঙ্গবন্ধু পরবর্তীতে পেট্রোবাংলা এবং বাপেক্সকে অর্বাচীনের মতো কেটে হাত-পা বেঁধে কাজ করতে দিয়েছে জিয়া শাহী এবং তার অনুগত এরশাদশাহী। এদিকে বঙ্গবন্ধু যে আদর্শ নিয়ে কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তা ছিল সে সময়ের তুলনায় অনেক অগ্রগামী। কৃষি ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান অত্যন্ত দক্ষ। কিন্তু ব্যবস্থাপনা পরিচালক তার কার্যক্রম পরিচালনায় কৃষকদের উপযুক্ত নতুন কোন উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দিতে পারছেন না। যদি পারতেন তবে কৃষিজাত পণ্যের মূল্য সহায়ক রাখার ক্ষেত্রে একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারতেন। অথচ ’৯৬-এর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কৃষি ব্যাংক দেশে মূল্য বৃদ্ধি ভয়াবহ বন্যার সময়ও ঠেকাতে সক্ষম হয়েছিল। একটি উদাহরণ দেইÑ দেশে পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় প্রফেসর ড. এ কে এম এনামুল হকের নেতৃত্বে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কেন্দ্র কর্তৃক ‘বর্ষার পেঁয়াজ’ বলে পেঁয়াজ বীজ উদ্ভাবন হয়েছিল, সেটি যাতে কৃষকেরা বপন করেন, সেজন্য বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাকাবের প্রতিটি শাখা ব্যবস্থাপকের মাধ্যমে আলাপ-আলোচনা করে বপন করে তা থেকে উৎপাদিত পেঁয়াজ বাজারে আনার জন্য সাংগঠনিক কার্যক্রম এবং উৎপাদক হিসেবে কৃষকদের সহায়তা প্রদানে এগিয়ে আসা উচিত ছিল। নচেৎ কেবল মুখে মুখে বড় কথা বলার জন্য, এ ধরনের আমলাতান্ত্রিক মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তি বিকেবি এবং রাকাবে রাখার কোন দরকার আছে কি? এ দুটো ব্যাংকই তো বিশেষায়িত ব্যাংক। একজন সাবেক ব্যাংকার হিসেবে জানি, ব্যাংকারদের কাজই হচ্ছে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করা। সময় এসেছে কৃষি মন্ত্রণালয় কর্তৃক খোঁজ-খবর নেয়া তারা কিভাবে কৃষি খাতে নতুন নতুন প্রকল্প এনে ভারতের মতো এদেশেও কৃষিবান্ধব হিসেবে আদৌ কাজ করছেন, না কি সুটেড-বুটেড হয়ে ব্যাংক কর্মকর্তারা লোক দেখানো কাজ করে মূল কাজ থেকে বিচ্যুত হয়ে ফরেন এক্সচেঞ্জ ট্রেডিংয়ে চলে গিয়েছেন। বিকেবি এবং রাকাবের উচিত ছিল যখন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট পেঁয়াজের বিকল্প উদ্ভাবন করল তখনই নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করে ‘চিভেস’ (ঈযরাবং) উৎপাদন, পণ্য বাজারজাতকরণ এবং ভোক্তাকে জ্ঞাত করা এবং সাপ্লাইন চেন ম্যানেজমেন্টে সহায়তায় ব্যাংকের অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের এগিয়ে আসা।
দেশ স্বাধীন হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। কিন্তু সে স্বাধীন দেশে কর্মকর্তারা যদি মনে করেন পায়ের ওপর পা তুলে আমলাতান্ত্রিক মন-মানসিকতায় কাজ করবেন, জনগণের পক্ষে না দাঁড়িয়ে কেবল রুটিন ওয়ার্ক করবেন, সেটা যথাযথ নয়। উচিত হচ্ছে জনকল্যাণে সম্পৃক্ত হওয়া। এদিকে দেশে উদ্যোক্তা শ্রেণী তৈরির জন্য জননেত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি নারী দিবসে যে বক্তব্য রেখেছেন তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। নেত্রী সব সময় পেটে-ভাতের রাজনীতির-অর্থনীতির দর্শনে বিশ্বাসী সুযোগ্য পিতার সুযোগ্য কন্যা। নেত্রীর আদর্শ বুকে ধারণ করে দেশে উদ্যোক্তা অর্থনীতি স্নাতক (সম্মান), পোস্ট গ্র্যাজুয়েট এবং মাস্টার্স প্রোগ্রাম ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনক্রমে আমরা চালু করেছি। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বর্তমানে কেউ কেউ এক ধরনের চটজলদি ব্যবসা ফেঁদে চলেছেন। এদিকে উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ শিক্ষার জন্য প্রয়োজন হচ্ছে তত্ত্বীয় জ্ঞানের পাশাপাশি প্র্যাকটিক্যাল ল্যাবের। এই প্র্যাকটিক্যাল ল্যাব স্থাপনে ব্যাংকসমূহ তার সিএসআর ফান্ডের আওতায় যাতে এগিয়ে আসে সেদিকে বিশেষ নির্দেশনা প্রয়োজন। আজ দেশের যে উন্নয়ন হচ্ছে, বিজয় দিবসের প্রাক্কালে এর জন্য জানাই সাধুবাদ। তবে উন্নয়নকে ধরে রাখতে হবে। পা পিছলে হড়কে গেলে আখেরে সাধারণ জনমানুষেরই ক্ষতি সাধিত হবে। বাংলাদেশে রফতানি পণ্য বহুধাবিভক্তিকরণ করা প্রয়োজন। সমস্যা হলো, বিদেশে বাংলাদেশী দূতাবাসসমূহ থেকে যথাযথভাবে কি পণ্যের কতটুকু চাহিদা আছে, তা পর্যালোচনা করে দেশে পাঠানো হচ্ছে না। আবার বর্তমান অবস্থায় বাংলাদেশের রফতানিকারকদের বিদেশী ক্রেতাদের ধরে রাখতে হলে বিশেষ ধরনের সাবসিডি দেয়া প্রয়োজন। নচেৎ টাকার অবমূল্যায়ন হলে আমদানিতব্য পণ্যের দাম অনেক বেড়ে যাবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশে ধোলাইখালে যে শিল্প কাঠামো গড়ে তোলার কথা ছিল, তা পরবর্তীতে ধামাচাপা পড়ে গেছে। কিন্তু আমরা এখনও যদি আমদানি বিকল্পায়ন শিল্প প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হতে না পারি, তবে আমাদের উন্নয়ন কাঠামোয় ক্ষতির সমূহ সম্ভাবনা থাকে। কেননা সবাই যদি রফতানি করে, তবে আমদানি করবে কে? অবশ্য কাউটারভেলিং ট্রেড মেকানিজমের কথা আমরা জানি। আমাদের দেশের কতিপয় স্বার্থান্বেষী ব্যবসায়ীর জন্য আন্তর্জাতিকমানের পণ্য তৈরি না করে নিম্নমানের পণ্য তৈরি করছি। আমরা যদি আমদানি বিকল্পায়ন শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এক ধরনের সমঝোতা ঘটাতে না পারি, তবে আখেরে তা দেশের ক্ষতির কারণ হবে। আমদানি যত কম করে দেশীয় পণ্যের ওপর নির্ভরতা বাড়ানো যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কেবল পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভরতার দিন ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে যখন আমরা মোকাবেলা করতে চলেছি, তখন আমাদের নারী শ্রমিকরা যাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, আইওটি (ওঙঞ) সম্পর্কে জ্ঞান পায়, সেজন্য বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালকে প্রশিক্ষণের হাত বাড়াতে হবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় সচরাচর কারিগরি শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে অবহেলা করে চলেছে। আমরা স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে যখন ২০২১ সালে পড়ব, তখন অবশ্যই দক্ষ জনসম্পদ থাকতে হবে। যারা গিরগিটির মতো রং পাল্টিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক চেতনাকে পরিপুষ্ট করে, অর্থাৎ মেড ইন পাকিস্তান, তাদের বাংলাদেশে স্থান হওয়া উচিত নয়।
পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে দাম নির্ধারিত হয়। যখন বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন করেন, তখন মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ১.৫%-এর কম ছিল। তাঁর সুযোগ্য কন্যার নেতৃত্বে তা আজ ৮.৩৮%। কিন্তু দেশের উন্নয়নের যে চালচিত্র, তাতে ধীরে ধীরে প্রযুক্তির উৎকর্ষ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষের ব্যবহার, অন্তর্ভুক্তিকরণও কমে আসছে। ইউনাইটেড নেশনস হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেস্ক বা ঐউও অনুসারে বাংলাদেশের অবস্থা ০.৬১৪ এবং ১৮৯টি রাষ্ট্রের মধ্যে বাংলাদেশের সংখ্যা ১৩৫তম। এদিকে গিনি সহগের মান ধীরে ধীরে কেন বাড়ছে, সেদিকটি তদন্ত সাপেক্ষ। কেননা গত ১১ বছরে অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় দেশের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। গবাদিপশু পালনে আমরা সক্ষমতা অর্জন করেছি। তবে এক্ষেত্রে একটি কথা রয়েছে, আমরা কখনও কস্ট কাটিং টেকনিক পালন করিনি। যত্রতত্র খামার করে গবাদিপশু অপরিকল্পিতভাবে লালন-পালন করতে গিয়ে গরুর মাংস, ছাগলের মাংসের দাম আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কাছাকাছি চলে গেছে। এক্ষেত্রে কৃষি ব্যাংক এবং এনজিওগুলো বিদেশের টেকনিক, বিশেষত নিউজিল্যান্ড থেকে সবুজ ব্রিক এনে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করলে যেখানে দৈনিক গবাদিপশু লালন-পালনে প্রতিটিতে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা লাগে, তা হ্রাস পেয়ে দৈনিক ২০ থেকে ২৫ টাকা হতো। আসলে যে কোন ব্যবসা শুরুর আগে কস্ট-বেনিফিট এনালাইসিস করে দেখা দরকার, যাতে সামাজিকভাবে ক্রেতারাও লাভবান হয়। অতিরিক্ত খরচে গবাদিপশু লালন-পালন করতে গিয়ে যেখানে ২০১৭ সালে প্রতি কেজি গরুর মাংস ছিল ২৭০ টাকা, এখন তা খোলাবাজারে ৫৬০ টাকা প্রতি কেজি। ভোগ্যপণ্যে অতিরিক্ত খরচ হলে সঞ্চয়-বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনায় ক্ষতি হয়ে থাকে। ফলে জিডিপি বৃদ্ধির হারও কমে।
বর্তমান সরকার সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ সম্পর্কে জিরো টলারেন্স দেখিয়ে থাকে। সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেল একটি ঘটক সংস্থা আদ্ব-দীন শর্ত দিয়েছেÑ পাত্রকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লেই কেবল তাদের পাত্রীরা বিবাহ করবে। এটি একটি দেখার বিষয়। একমাত্র গোয়েন্দারাই বলতে পারবে বিয়ের নামে তারা কোন ধরনের তথাকথিত ‘আল্লার দল’-এর সদস্য সংগ্রহ করছে কি না!
বিজয় দিবসের প্রাক্কালে আশা করব, দেশে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরে আসুক। এজন্য ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় যাতে ব্যাংকাররা দুর্নীতিমুক্ত হন, সমস্ত সার্কুলার মুখস্থ রাখেন এবং নতুন উদ্যোক্তা তৈরির জন্য সহায়তার হাত বাড়ান। প্রয়োজনে প্রধান কার্যালয় ঢাকা থেকে বিকেন্দ্রীকরণ করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দেয়া দরকার। কেন এত দেরি হচ্ছে সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিট করতে, তার ওপর একটি প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে প্রত্যাশা করছি। অর্থমন্ত্রীকে আগামী এক বছরে কিভাবে ঋণ ভারে জর্জরিত ব্যাংক এবং ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে শৃঙ্খলা আনবেন তার রূপরেখা প্রদান করে একটি প্ল্যান তৈরি করে অভীষ্ট লক্ষ্য নিয়ে বাস্তবায়নে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের অগ্রযাত্রা সুন্দর হোক- মহান বিজয় দিবসের প্রাক্কালে এই প্রত্যাশা। আর বীর শহীদদের এবং বীর নারীদের প্রতি রইল শ্রদ্ধার্ঘ।
Leave a Reply