প্রাচীন ভারতের নালন্দা থেকে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের লাইসিয়াম হলো আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বসূরি। আজ একুশ শতকে এসে অনেক কিছুর সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে সেই উচ্চশিক্ষার প্রথাগত ধারণা। দ্য ইকোনমিস্ট অবলম্বনে এ নিয়ে প্রথম আলোর চার পর্বের ধারাবাহিকের আজ পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তনের দুই অনুঘটক হলো পড়ালেখার খরচ বেড়ে যাওয়া ও শ্রমবাজারের প্রযুক্তিনির্ভরতা। আবার এ বিষয়টি মোটামুটি নিশ্চিত যে শিক্ষাব্যবস্থার যে পরিবর্তন তা নিশ্চিত করবে এই প্রযুক্তিই। ইন্টারনেট হলো সেই প্রযুক্তি, যার কারণে গান থেকে শুরু করে পত্রিকার কাগুজে সংস্করণে, এমনকি ছাপা বইয়ের কেনাবেচার ধরনেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এই একই প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘদিনের ধারণাকে বদলে দিতে যাচ্ছে, যা ইতিমধ্যে পরিচিতি পেয়েছে ‘ম্যাসিভ ওপেন অনলাইন কোর্সেস (মুকস বা MOOCs) নামে।
মুকসের পথ চলা শুরু ২০০৮ সালে। প্রযুক্তির উন্নয়নে প্রথাগত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে মুকস। এ কোর্স পুরোটাই অনলাইনভিত্তিক। খরচও তুলনামূলকভাবে অনেক কম, অনেকটা হাতের নাগালে। ইন্টারনেটে ঢোকার সুযোগ থাকলেই হলো, আর হয়তো সামান্য কিছু ফি। একটি ল্যাপটপ বা ট্যাব এমনকি একটি মোবাইল ফোনও সে সুযোগ দিচ্ছে। নির্দিষ্ট কোনো জায়গায় গিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে ক্লাস করতে হবে—এমন কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই। সুতরাং নতুন এই ধারণা ব্যাপকতা পাবে—এটাই হয়তো অস্বাভাবিক নয়।
হার্ভার্ড বিসনেস স্কুলের ক্লেটন ক্রিসটেনসেন মনে করছেন, মুকস এমনই শক্তিশালী হতে পারে যে, এর প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অদক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশির ভাগ বন্ধ হয়ে যাবে।
২০০৮ সালে কানাডায় মুকসের যাত্রা শুরু হয়েছিল অনলাইন কম্পিউটার কোর্সের মাধ্যমে। ২০১২ সাল পালন করা হয় ‘ইয়ার অব দ্য মুকস’ হিসেবে। তিনটি মক-স্টার edX (হার্ভার্ড ও এমআইটি পরিচালিত একটি ব্যবসায়িক প্রচেষ্টা), coursera ও Udacity যাত্রা শুরু করে ওই বছর। এই বড় তিনটি প্রতিষ্ঠান এখন পর্যন্ত এক কোটি ২০ লাখের বেশি শিক্ষার্থীকে পাঠ দিয়েছে।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, এডেক্সের যত শিক্ষার্থী ছিলেন তার প্রায় অর্ধেক হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশগুলোর। ‘কোর্সেরা’ এশিয়াকে ফোকাস করে কার্যক্রম সম্প্রসারণের চিন্তা করছে।
কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে তাদের সিলেবাসে ডিজিটাল কোর্স অন্তর্ভুক্ত করেছে। ব্রাজিলের ইউনোপার ইউনিভার্সিটি অনলাইন ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করে স্বল্প খরচের ডিগ্রির সুযোগ দিচ্ছে। সেখানে সাপ্তাহিক সেমিনার হচ্ছে। সেমিনার আবার ভূ-উপগ্রহের (স্যাটেলাইটের) মাধ্যমে সম্প্রচার করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বড় কফি কোম্পানি তাদের কর্মীদের এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনলাইনে ডিগ্রি নিতে আর্থিক সহযোগিতার ঘোষণা দিয়েছে।
এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি মূলত দূর-শিক্ষণ শুরু করেছিল শিক্ষকদের জন্য। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এটি এখন ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় দূর-শিক্ষণ প্রতিষ্ঠান। শিক্ষার্থী আছেন প্রায় দেড় লাখ। সারা দেশে প্রায় ৫০০টি কেন্দ্র। আয়েংগুয়েরা ব্রাজিলের বেসরকারি বাণিজ্যিক শিক্ষার একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানেরও দূর-শিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। সাওপাওলোতে তাদের একটি মিডিয়া সেন্টার আছে। এখান থেকে শিক্ষকদের লেকচার ব্রাজিলজুড়ে সম্প্রচার করা হয়। ওই কোম্পানির প্রধান তথ্য কর্মকর্তার ভাষায়, এটি হচ্ছে ৩৯টি চ্যানেলে একটি পে-টিভি চ্যানেল চালানোর মতো।
কিন্তু প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থার যে সাধারণ দুর্বলতা, সেটি দেখা গেছে মুকসের ক্ষেত্রেও। প্রতিশ্রুতি পুরোপুরি রাখতে পারেনি পদ্ধতিটি। প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থায় স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য যে আনুষ্ঠানিক পদ্ধতি তার অনুপস্থিতি একটা দুর্বলতা। ঝরে পড়ার হারও অনেক। কিন্তু এ অবস্থারও পরিবর্তন ঘটছে। বেসরকারি বিনিয়োগকারী এবং প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্রমশই ঝুঁকে পড়ছে এ পদ্ধতিটির দিকে। হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল অনলাইনে প্রাক-এমবিএ কোর্স চালু করতে যাচ্ছে শিগগিরি। এতে খরচ পড়বে এক হাজার ৫০০ ডলারের মতো। যুক্তরাষ্ট্রের বড় কফি কোম্পানি স্টারবাকস তো এরই মধ্যে কর্মীদের অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির অনলাইনে ডিগ্রি নিতে আর্থিক সহযোগিতার ঘোষণা দিয়েছে।
মুকস একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একেকরকম প্রভাব ফেলবে। অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যই লাভবান হবে। কারণ উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষ সব সময়ই চেষ্টা করবে সবচেয়ে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। আবার ডিজিটাল অর্থনীতিও বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে দেবে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো সহজেই বিশ্বব্যাপী তাদের বাজারের প্রসার ঘটাবে। কিন্তু ঝামেলায় পড়বে মধ্যমমানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। প্রযুক্তিনির্ভরতার কারণে গত এক বা দুই দশকে খবরের কাগজগুলোর যে দশা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দশাও তার চেয়ে খুব একটা আলাদা কিছু হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় অর্ধেকেরও বেশি নেমে আসবে, শিক্ষা খাতে কাজের সুযোগ কমবে ৩০ শতাংশ এবং সাত শয়ের মতো বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাবে।
নতুন যুগের সূচনা: অন্য সব বিপ্লবের মতো উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রের এই বিপ্লবেও একদল বিরোধিতাকারী আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুকস ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করবে। এগিয়ে থাকবেন ভালো ছাত্রছাত্রীরা, কাঠামোগত শিক্ষাব্যবস্থার অনুপস্থিতির কারণে দুর্বল ছাত্ররা হয়তো পিছিয়ে পড়বেন। একইভাবে দক্ষ শিক্ষকদের আয় চোখ টাটাবে দৌড়ে পিছিয়ে পড়াদের।
রাজনীতিবিদেরা এ পরিস্থিতিতে চাপের মুখে পড়বেন। মুকসের গতি রুখতে তাঁদের ওপর নানামুখী চাপ আসবে। কিন্তু তাঁদের মনে রাখতে হবে রাষ্ট্র অর্থ ব্যয় করে সমাজের সবার উন্নয়নের জন্য, শুধু কিছু শিক্ষককে প্রতিযোগিতা থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য নয়। প্রথাগত ধারণার বাইরের এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বেশির ভাগ মানুষই উপকৃত হবেন, ক্ষতিগ্রস্ত হবেন খুব কমই। মুকস বাঁধাধরা পদ্ধতি অনুসরণ করে না বলে, কিছুটা বয়স্ক ছাত্রদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শুরু হয় ২০ বছর বয়সের মধ্যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ডিগ্রি হচ্ছে চাকরিজীবনে প্রবেশের শর্ত। যুক্তরাষ্ট্রে মুকসের সুবিধাভোগী ছাত্রদের গড় বয়স ৩১ বছর। যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষায় ৩৫-ঊর্ধ্ব বয়সী শিক্ষার্থী বাড়ছে। নব্বইয়ের দশকে এ সংখ্যা ছিল তিন লাখ ১৪ হাজার। আর ২০০০ সালে তা দাঁড়ায় নয় লাখের কাছাকাছি।
ব্রাজিলের মতো উদীয়মান দেশগুলোতে অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা বেশ সাড়া ফেলেছে। উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী ছাত্রদের সংখ্যা এসব দেশে যে হারে বাড়ছে, তা দ্রুতই ছাড়িয়ে যাবে পশ্চিমা দেশগুলোকে। দেশগুলো উচ্চশিক্ষা বিক্রি করবে অনেক সস্তায়। কথাটা শুনতে অবাক লাগলেও এটা মানতে হবে শিক্ষার একটা বৈশ্বিক বাজার আছে।
পূর্বে প্রকাশিতঃ প্রথম আলো ডট কম এ
Leave a Reply