শিক্ষকতা জগতের মহান পেশাগুলোর মধ্যে একটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দেশের জ্ঞান বিকাশের কর্ণধার ভাবা হয়। এই দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ লড়াই করেছে। রক্ত দিয়েছে,প্রাণ দিয়েছে। শিক্ষকরা সরাসরি রাজনীতি হয়ত করেন নি কিন্তু রাজনীতিবিদদের পদ দেখিয়েছেন বারংবার।
তবে এখন সময় বদলেছে। আমাদের শিক্ষকরা এখন গবেষণা ও পাঠদানের চেয়ে রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। রাজনীতিবিদদের চেয়েও চমকপদ বক্তব্য দিয়ে তাঁরা মিডিয়ার শিরোনাম হতে ব্যাকুল। একটা সময় দেশের খ্যাতনামা শিক্ষাবিদকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হতো। কিন্তু এখন প্রধানমন্ত্রীর পিএস,এপিএসকে যে যত বেশী উপাহার দেন,যে যত বেশী দলের দালালী করেন,দলাদলি করেন তাদেরকেই উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।
রাজনীতি শিক্ষক-শিক্ষার্থী কারো জন্য নিষিদ্ধ না। কিন্তু দেশের পেশাজীবি বিশেষ করে শিক্ষকরা যখন তাঁদের পেশা ছেড়ে রাজনীতিবিদদের ভূমিকা নেন তখন পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠে।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘সাদা দল’ এর আহবায়ক হয়েছেন এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম। তিনি একই সাথে বিএনপির শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করবেন ,সাদা দল চালাবেন নাকি বিএনপির শিক্ষা দফতরের কাজ করবেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতির চিত্র আরও করুণ আরও ভয়াবহ। সাম্প্রতিক অতীতে দুই দুইবার উপাচার্য বিরোধী আন্দোলন হয় এখানে।
আন্দোলন পরবর্তীতে দেশে নতুন ইতিহাস গড়ে প্রথম নারী হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে দায়ত্ব নেন নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম। কথিত আছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় একজন অধ্যাপকের সিন্ডিকেটে নিয়ন্ত্রিত হয়। ফারজানা ইসলামের উপাচার্যের প্রথম মেয়াদে তিনি অধ্যাপক বড় ভাইয়ের সম্মতিতে প্রশাসন চালিয়েছেন। কিন্তু ২০১৮ সালে তার পুনঃ নিয়োগে সন্তুষ্ট নন অধ্যাপক বড় ভাই।
তাই তাঁর নিয়ন্ত্রিত আওয়ামীপন্থী শিক্ষক সংগঠন বর্তমান উপাচার্যের প্রতি অনাস্থা জানান। উপাচার্য পরিসিস্থিতি সামাল দিতে নিজেই আরেকটি শিক্ষক সংগঠন গড়ে তোলেন। আওয়ামীপন্থী শিক্ষকরা ক্ষমতার লড়াইয়ে দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েন। এরপর প্রতিদিন সংবাদের শিরোনামে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
একজন অধ্যাপক যিনি সাবেক উপাচার্য ছিলেন, র্যাগিং ও সান্ধ্যকালীন কোর্সের বিরুদ্ধে পত্রিকায় ইয়া বড় বড় কলাম লিখতে শুরু করলেন। অথচ তিনি যখন উপাচার্য ছিলেন তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং আরও চরম মাত্রায় ছিলেন। তিনি কোন ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। বর্তমান উপাচার্য প্রশাসনকে তাঁর আয়ত্বে আনতে একদিনে ৯ টি হলের প্রভোস্ট পদে রদবদল করেন। যেখানে তাঁর সমির্থত শিক্ষক সংগঠনে আসেন নি তাদের বাদ দিয়ে তাঁর আস্থাভাজনদের নিয়োগ দেয়া হয়।
এর প্রতিবাদে ধর্মঘট ডাকে সাবেক উপাচর্যের সমর্থিত শিক্ষক সংগঠন। কেননা হল প্রভোস্ট একটি চমকপদ নিয়োগ। তাদের ডাকা ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে শিক্ষকদের দুই গ্রুপ হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সে ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায়। ক্ষমতার জন্য শিক্ষকদের হাতাহাতি !!
হাতাহাতির বছরে ইউজিসি গবেষণায় স্বর্ণ পদক তালিকায় জাহাঙ্গীরনগরের কোনো শিক্ষকের নাম নেই । নিন্দুকেরা অবশ্য বলছে তাঁরা হাতাহাতি করে কুল পাই না আবার গবেষণা করবে কখন! তবে আরেকটি পক্ষ বলছে ইউজিসিতে আমাদের কোন লবিস্ট নেই তাই আমরা স্বর্ণপদক পাই না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন অনুষদের ডিন হওয়ার কথা ছিল আইন ও বিচার বিভাগের শিক্ষক রবিউর ইসলামের। কিন্তু ‘ডিগবাজি’ টা তিনি ঠিক মতো দিতে জানেন নি। তিনি ক্ষমতাসীনদের নতুন দলে ভিড়েন নি বা ভিড়তে পারেন নি। তাই ডিন তিনি আর হলেন না। মাঝখানে আইনের শিক্ষক হয়ে রাজনীতি শিখে গেলেন। এই আইন অনুষদের ডিন নিয়োগ নিয়ে রাজনীতির জল বহুদূর গড়াল। প্রশাসনিক ভবন অবরোধ হলো বেশ কয়েকবার। বিভাগের ‘রুম দখল’ নাটক মঞ্চত্ব হলো। এরপর আসল ‘রেকর্ড ফাঁস বিতর্ক’। রেকর্ড ফাঁস বিতর্ক নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো রবিউল ইসলামের বিরুদ্ধে।
আইন অনুষদের ডিন পদ নিয়ে আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের দুই পক্ষ ই এত এত রাজনীতি করছে। কিন্তু আইন ও বিচার বিভাগে সমস্যা নিয়ে তাঁদের কোন মাথাব্যথা নেই। বিভাগে ছয়টি ব্যাচ এখন পড়াশোনা করছেন। ছয়টি ব্যাচের জন্য তিনটি ক্লাস রুম তাও আবার দুই ভবনে। বিভাগের জন্য নির্দিষ্ট কোন ভবন বা রুম বরাদ্ধ হয় নি বিভাগ প্রতিষ্ঠার ছয় বছরেও। শিক্ষার্থীদের জন্য কোন লাইব্রেরী নেই। কোন দলীয় পাঠকক্ষ নেই। এসব নিয়ে শিক্ষকদের কোন পক্ষের ই মাথাব্যথা নেই। তাঁদের দরকার ডিনশীপ। তবে আইন বিভাগে এতদিনেও যথেষ্ট কক্ষ না পাওয়ার পিছনে বিভাগের ছয় জন শিক্ষকের চার ধরনের মতও অনেকাংশে দায়ী।
ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যন্ত স্বনামধন্য একটি বিভাগ। বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় শিক্ষক রাজনীতির হাওয়া গিয়ে পড়েছে এই বিভাগে। অধ্যাপক মনজুরুল হাসান আদালতের রায়ে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পান। কিন্তু বিভাগের বেশীরভাগ শিক্ষক তাঁকে নিয়ে সন্তুষ্ট নন। তাঁরা আবার উপাচার্য বিরোধী শিক্ষক সমাজের সমর্থক। এক সময়ের জাতীয়তাবাদী অধ্যাপক মনজুরুল এই সুযোগে প্রশাসনের অনুকম্পা পান। তাঁকে অসহযোগিতা করতে একের পর এক চলতে থাকে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন। সেই রাজনীতিতে ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা যে পক্ষে শিক্ষক বেশী সে পক্ষের ঢাল হওয়া শুরু করল। কারণ তারা জানে তাদের টিউটেরিয়াল এসাইনমেন্টের নাম্বারের কথঅ মাথায় রেখে ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে স্বানতকোত্তর পর্বে ফলাফলে অনিয়মের একটা অভিযোগ পেলাম। সেই অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে কেচোঁ কুড়ঁতে সাপ বের হয়ে আসল। বিভাগে তৃতীয় বর্ষের দিকে পছন্দের শিক্ষার্থী ঠিক করে শিক্ষক বানানোর পরিকল্পনা ঠিক করেন শিক্ষকরা। এরপর নিজজের পছন্দ মতো মার্কিং করেন। কি ভায়াবহ এই চিত্র। তাহলে ভাবুন কারা আমাদের আগামী দিনের শিক্ষক হচ্ছেন। কেন আমাদের শিক্ষকরা ইউজিসির স্বর্ণপদক পায় না। খোঁজ নিয়ে দেখুন আমাদের কতজন অধ্যাপকের পিইচডি নেই। শিক্ষকরা অধ্যাপক হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু গবেষণা করেন। এরপর আর এসব নিয়ে মাথা ঘামান না। হয়ে পড়েন পুরোদুস্তর রাজনীতিবীদ। অবশ্য ব্যতিক্রম যে নেই তাও নয়। আহমেদ শরীফ বেশি দিন আগে মারা যান নি। যিনি অধ্যাপক হওয়ার পরও গবেষণা করেছেন এমনকি অবসরে যাওয়ার পরও। সিরাজুল ইসলাম সত্তরের ঘরে পা দিয়েও এখনো এশিয়াটিক সোসাইটিতে বসে কাজ করে যাচ্ছেন।
কিন্তু বেশির ভাগ শিক্ষক, বিশেষ করে ঢাকা অথবা তার কাছাকাছি যাঁরা আছেন, তাঁরা গবেষণা, অধ্যাপনা এবং লেখার কাজ করেন সামান্যই। উপার্জনেই তাঁদের আগ্রহ। একজন শিক্ষক একবার আমাকে বলেছিলেন,তাঁর অনেক বন্ধু নাকি যারা পেছনের বেঞ্চে বসত তাঁরা এখন বিসিএস ক্যাডার ও ব্যবসায়ী হয়ে কোটি টাকার মালিক। কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে কেন তিনি শিক্ষক হতে এসেছেন জানি না। হয়ত এখন শিক্ষক ও কোটিপতি হওয়ার একটা চমকপদ পেশা। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের লেখা,আর্টিকেল ও গবেষণা এই দেশেকে এই জাতি পথ দেখাবে । কিন্তু শিক্ষকরা মনে করছেন রাজনীতি করে,রাজনৈতিক দলের প্রতি অন্ধ আনুগত্য করায় তাদের দেশব্রত। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ বানিজ্য তো রয়েছে। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে এখন শিক্ষকদের দেখা যায় না। অথচ এই শিক্ষকদের হাতের মায়ায় তাঁদের শাসন বারণ পরামর্শে আমরা একটা সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখি।
……………………..
লেখকঃ শাহাদাত হোসাইন স্বাধীন
নৃবিজ্ঞান বিভাগ,জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
Leave a Reply