আপু জাপানে যেতে চাই, উপায় বাতলে দেবেন?

উচ্চশিক্ষা বা ভাগ্যান্বেষণে প্রবাসে পাড়ি দিতে ইচ্ছুক অনেক স্বপ্নচারীর এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হই। আমি এতটুকু বিরক্ত হই না কারণ আমার খুব মনে আছে আমি নিজে যখন প্রবাসে এসেছিলাম তখনকার মানসিক অবস্থা। আজন্ম আমার এবং আমার বরের খুব একটা আত্মগরিমা ছিল , “I will be the last person to leave our motherland”। জাপানে সরাসরি ভাল চাকরির অফার নিয়েই এসেছিলাম, কিন্তু দেশ ত্যাগ করেছিলাম তো!

Advertisement

উঠতি বয়সে বৈপ্লবিক যে ভাবনা সব অনিয়মের নিয়মকে ভেঙে ফেলবার আর দেশকে ভালবেসে নরক বাসকে স্বর্গের চেয়েও বড় মেনে আকড়ে রাখে, মাটি কামড়ে পড়ে থাকে সেসব ত্যাগ করেই তো এসেছি! তাই আমি খুব ভালই জানি কি পরিস্থিতিতে স্বপ্নভাঙার কত কষ্টে কেউ দেশ ছাড়ে। কারণ, জীবন শুকিয়ে গেলেও স্বপ্ন ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারেনা। এদিকে উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণার কোনো পরিস্থিতি দেশে নাই। তাও আমরা যারা সনাতন পদ্ধতিতে পড়ে এসেছি তারা যখন আজকে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থারও ঘুণে ধরা ধস দেখি তখন নতুন প্রজন্মের জন্য আতংকিত হয়ে নিজেদের অনেকটাই ভাগ্যবান মনে করি ।

তো যাক প্রসঙ্গে আসি। ভাল চাকরি নিয়ে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপে পড়তে এলে টিকেট এবং বাকি ব্যবস্থাপত্র, ব্যয়ভার কোম্পানির জিম্মা। অন্যথায় দেশ ত্যাগ করে আসা অনেক পরিবারের জন্যই নিজেদের সর্বস্ব বর্গা রাখার নামান্তর, ধনে, মানে, স্বপ্নে । কাজেই এই সর্বস্ব বাজি রেখে এসে তার পুনরুদ্ধার না হবার সামান্যতম ঝুঁকি নেয়া যায় না । তাই চেষ্টা করি আমার জানার পরিধিতে সবরকম সম্ভাবনা, আশঙ্কার সবদিক তুলে ধরতে।

প্রথমেই বলি , জাপানে তীব্রতম সমস্যা হলো ভাষা। এই ভাষা বর্ণমালা ভিত্তিক না, একেক শব্দের জন্য একেকটি ছবির মতো আকার যার প্রতিটার একটা করে গল্প আছে, কারণ এদের ভাষা এদের লাইফস্টাইলের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এরকম মোটামুটি ৩০০০ ছবিভিত্তিক শব্দ শিখলে এদের ভাষা শেখা যায়। উল্লেখ্য, আন্ডারগ্র্যাজুয়েশনে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ার মত  বিশ্ববিদ্যালয় এবং  পড়ার বিষয় এখানে অসম্ভব অপ্রতুল।  তাই, যারা কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে এডমিশন নিয়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়তে আসে তারা মাস্টার্স বা পিএইচডি করতেই আসে। এরপরেও বেশির ভাগকেই তাদের দৈনন্দিন জীবনে চালিয়ে নেবার জন্য ৬ মাসের টানা জাপানি ভাষার কোর্স করতে হয়। এতে বর্ণমালা ভিত্তিক দুই ধরনের স্ক্রিপ্ট শেখানো হয় যাতে খুব সামান্যই কাজ চলে। মূলত, স্পিকিং জাপানিজটাই শেখানো হয়, আর কিছু আদব কেতা।

জাপানি ভাষাটা একাডেমিকালি যারা শেখে তারা জাপানি ভাষার স্কুলের মাধ্যমে ২ বছরের ভিসা নিয়ে আসে। এরা মোটামুটি ভালই শিখে নেয়, এবং যেহেতু এই কোর্সে কোন স্কলারশিপ নাই, তাই মাসখানেকের মধ্যেই প্রাথমিক কাজ চালাবার মত জাপানিজ তাকে শেখানো হয়, যাতে স্কুলের বা কোন পরিচিতর রেফারেন্সে সে কোথাও খ্ণ্ডকালীন চাকরি জুটাতে পারে। এসব চাকরি সবই কায়িক পরিশ্রমের কাজ, কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয় জাপানে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের বিষয়টা অতি উঁচু বলেই হয়তো কোনদিন এসব কাজকে কেউ অড জব বলেনা। এই টার্মটাই এখানে শুনিনি। কিউশ্যু বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিজীবীদের কোয়ার্টারে প্রতিবেশি মেডিকেল ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র প্রফেসরের স্ত্রী ষাট বছর বয়সে এক কমিউনিটি হলের কিচেনে কাজ করতো । এ নিয়ে বলতে তাকে কোনদিন কোন সংকোচ দেখিনি, খুব স্বাভাবিক বিষয় এটা। এবং এসব কাজে ঘ্ন্টাভিত্তিক বেতন ন্যূনতম ৮২৩ ইয়েন বা ৫৬০ টাকা / ঘন্টা যা সব কাজেই সমান। তাই দেখতাম আমাদের অফিসের বৃদ্ধা সুইপার মহিলার গাড়ি আমার প্রথম গাড়িটার চেয়ে অনেক ভাল ছিল।

একজন শিক্ষার্থী বা কারো ডিপেন্ডেন্ট ভিসায় আগত কেউ সপ্তাহে ২৮ ঘন্টা কাজ করতে পারে। আর রেফারেন্স ছাড়া এখানে কোন চাকরিই প্রায় নেই বিদেশিদের। কারণ, জাপানিরা বিদেশিদের ব্যাপারে অসম্ভব সন্দিগ্ন। দেখা হলে খুব বিনয়ের সাথে আগ্রহ করে কথা বলবে, জানতে চাবে কেন এসেছ, কবে যাবে? এদের দৃঢ় বিশ্বাস এদের সাংস্কৃতি আদবকেতা বিদেশি কেউ কোনদিন শিখতে পারবে না , অযথা এদেশে থেকে গেলে সব নষ্ট করবে। তাই কোথাও চাকরি বা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলে মেনে নিতে হবে আপনি জাপানি প্রতিযোগীদের সাথে ১০০ নম্বরের পরীক্ষা ৮০ তে দিচ্ছ্নে।

ভাষা শিখতে আসা শিক্ষার্থীরা ২ বছর পর ভর্তি হয় ২ বছরের ডিপ্লোমা বা ৪ বছরের আন্ডারগ্র্যাজুয়েশনে। এর পর হয়তো অফিস জব পায় । তো এই ২+ ২ বা ২ + ৪ বছর পার্টটাইম করেই নিজের এবং পড়ার খরচ জোগাড় করতে হয়, যা বছরের রিএডমিশনের ক্ষেত্রে প্রায় অসাধ্য হয়ে যায়। দেশ থেকে সাপোর্ট আনতেই হয়। ইউনিভার্সিটিতে যারা মনবশু বা এমন কোন ভাল ফান্ডে সফল হয়ে আসেন, তাদের অন্তত এই অর্থনৈতিক  দুশ্চিন্তা থাকেনা, যা পাওয়া যায় তাতে জাপানের খরুচে সমাজেও ছেলেপুলেনিয়ে সংসার মোটামুটি চলে যায়।

এবার আসি, উচ্চশিক্ষায় মনবশু পাবার মতন ভাল রেজাল্ট, বয়স ( ৩৫ বা এর নিচে ) বা ভাগ্য যাদের সহায় নেই, তাদের কথায়। তারা নির্দিষ্ট বিষয় ঠিক করে ইউনিভার্সিটি ওয়েবে বাছাই করে সংশ্লিষ্ট বিভাগের অধ্যাপকদের লিখতে থাকবেন। ইমেইলে সে কি করতে চায় এবং কেন এ বিষয়ে গবেষণা জাপান বা বিশ্বের জন্য জরুরি তার একটা সম্পর্ক টানা। এক্ষেত্রেও রেফারেন্স কিছু ত্বরান্বিত করলেও বেশির ভাগই রেফারেন্স ছাড়াই এসেছে। অনেক ধৈর্য্য রাখতে হবে। ধরেই নিতে হবে ১০ টা ইমেইলে ১টার জবাব আসলেই বিরাট ব্যাপার, কারণ , ঐযে বললাম , বিদেশি শংকা, আর জাপানিরা এমনিতেই রক্ষণশীল এবং আত্মকেন্দ্রিক । ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে প্রফেসরের মাধ্যমে মনবশু বা ল্যাবের ফান্ড নিশ্চিত করেই সে এডমিশন নিয়ে আসবে। অন্যথা প্রফেসর বলেন যে নিজের খরচে এসে যাক, তিনি পরে দেখবেন। আর কিছু না হলে পার্টটাইম আছে। তবে পিএইচডি করে পার্টটাইমে খরচ জোগানো সত্যিই অমানবিক কষ্টের।

কাঙ্খিত ডিগ্রি হয়ে গেলেই প্রায় ৯৯% ই দেশে ফিরে যায়। কারণ ঐ – এরা অভিবাসী অবান্ধব, নৃতাত্ত্বিক ভাবে জাপানি না হলে আপনি কোনদিনই এদের অংশ হতে পারবেন না, তা সে আপনি আজন্মই থাকুন আর নাগরিকত্বই পান। চাকরি যদিবা  পেয়েও যান ক্যারিয়ার গড়া পরম সৌভাগ্যের বিষয়, যা নিজের দেশে বা ভাষার সমস্যামুক্ত দেশে অনেক সুলভ। এ কারণেই বিদেশি বা বাংলাদেশি আবাসিক এখানে হাতে গোনা তবে, দীর্ঘস্থায়ী যারা হতে চান তারা ৫ বছর বসবাস আর ট্যাক্স পে ইনকাম ৩ বছর করলেই জাপানি নাগরিকত্বের জন্যে আবেদন করতে পারেন। আর পার্টটাইমাররাও ১০ বছর বাস করলেই পার্মামেন্ট রেসিডেন্স এর জন্য আবেদন করতে পারেন।

এমনকি নাগরিকত্ব না থাক- পেনশন , স্বাস্থ্য বীমা ইত্যাদি সুবিধা আপনি এবং আপনার পরিবার একই রকমভাবেই পাবেন। এমনকি আপনার ষাটোর্ধ্ব বাবা-মাও। আর এদের ভাষা শুধু শিখতে পারলেই হবে না, সব আত্মস্থ করতে কমপক্ষে ১০-১৫ বছর লেগেই যাবে। তবে হ্যা, একবার এদেশে থেকে গেলে , এদের বিনয়, সন্মান, ভদ্রতা, নিপুণতায় অভ্যস্ত হয়ে গেলে পৃথিবীর কোথাও গিয়ে খাপ খাওয়ানো খুবই কষ্টকর। আর মনবশু ( মনবুকা গাকুশো, MEXT Scholarship) এর সার্কুলারের জন্য মার্চ থেকে বাংলাদেশ এডুকেশন মিনিস্ট্রির ওয়েবসাইটে চোখ রাখুন। আর প্রফেসর রেকমেন্ডেশনে আসতে চাইলে ডিসেম্বর থেকেই। নিন, এবার বুঝে নিন, জাপানে পাড়ি দেবার কথা ভাববেন কিনা।





About তানজীনা ইয়াসমিন চৌধুরী 3 Articles
তিনি সাবেক রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়, ফুকুওকা, কিউশু, জাপান। বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, জাপান।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*