পৃথিবীতে মানুষের নিঃস্বার্থ বন্ধু কতজন মেলে! আমার জীবনে অনেকের সাথে সহজেই পরিচয় ঘটেছে। বন্ধুত্বও হয়েছে খুব সহজে। তারমধ্যে নিঃস্বার্থ একজন বন্ধু ছিল। নাম এমি। আমার এলাকায় তার সাথে পরিচয় হয় যখন আমি ক্লাস ফোর এ পড়ি। ও তখন ক্লাস ফাইভে। দু’জন দুই স্কুলে। তার সাথে প্রথম পরিচয় এক খেলার মাঠে ঝগড়া দিয়ে। চিকনা লম্বা ছেলেটা, সবসময় একটু হাসি লেগেই থাকতো। আমার থেকে একফুট লম্বা। তারপর আস্তে আস্তে বন্ধুত্ব। একসময় বন্ধুত্ব টা এতটাই গভীরে যায় যে আমরা কেউ কাউকে ছাড়া থাকতেই পারি না। ওর বাবা ছিল বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) এর একজন উর্ধতন কর্মকর্তা। আমি একেবারেই গরীব একটা কিশোর। কিন্তু তারপরও ও আমার সাথে এমনভাবে মিশতো যেন নিজের ভাই। অনেকসময় আমাদের বাসায় থেকে ও অনেক রাত করতো। আমার মা ধমকে ওকে ওর বাসায় পাঠাতো। ওর মা ছিলেন খুব রাগি। খুব শাসন করতেন। ওর একটা সহজ সরল বড় ভাই ছিল।
যাই হোক আমার সাথে এমির নিবির বন্ধুত্ব হলো। কোথাও গেলে আমাকে সাথে নিতো। ওর সব খেলার জিনিস আমার সাথেই শেয়ার করতো। আর ও আর আমি সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটার ভক্ত ছিলাম, সেটা হলো মাছ ধরা আর পুকুরে ডুব সাঁতার দিয়ে গোসল করা। আপনারা জানেন শহরাঞ্চলে তেমন পুকুর নেই। আমাদের আর.কে. মিশন রোড এলাকায় নাসিরাবাদ গার্লস স্কুলে একটা পুকুর। আমরা বেশিরভাগ সময় ওখানেই ধাপাধাপি করতাম। আর বাসায় এসেতো উত্তম মধ্যম মিলতই। এমনি করেই দিন কাটতো।
একদিনের একটা মজার ঘটনা। গেলাম নাসিরাবাদ স্কুলের পুকুরে গোসল করতে। আমাদের গোসল মানেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে ডুবাডুবি করা। তো পুকুরে নামার আগেই ভাবতে লাগলাম। এখান থেকে ভিজে পোষাকে বাসায় গেলে কি শাস্তি হতে পারে! তবুও গোসলতো করতেই হবে এইখানে। তারপর বিকল্প রাস্তা খুঁজতে লাগলাম। তারপর আমি আর এমি আবিস্কার করলাম পুকুর পারেই দুইটা নজরকারা সুন্দর লুংগি শুকাতে দিয়েছে কে যেন। আল্লাহর রহমতে আমাদের পোষাক খুলে লুংগি দুইটা পড়েই পুকুরে ঝাঁপ দিলাম। আমরা যখন গলাসমান পানিতে ডুবাডুবি করছি, তখনি স্কুলের দপ্তরি জনাব শফিক মিয়া এসে উপস্থিত হলেন। উনি পুকুর পাড়ে কি যেন খুঁজতে লাগলেন। এরপর ওখান থেকে চলে গেলেন কিছুক্ষণ পর আবার আসলেন। আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন, “মিয়ারা এইহানে দুইডা লুংগি লাড়া দেখছো?” আমারা একে অন্যের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলাম। ভাবলাম, “এই সেরেছে! কি জানি কি হয়!” কারণ শফিক মিয়া ছিলেন অনেক রাগি। দুস্টুমির জন্য অনেক ছেলেরা এমনকি এমিও উনার হাতে মার খেয়েছে ইতোপূর্বে। তাই এমি এই গলাসমান পানিতে ভয়ে কেঁদেই ফেলল প্রায় এবং আমার নিষেধজ্ঞা সত্বেও বলে দিল লুংগি দুইটা আমাদের পড়নেই। তারপর যা ভেবেছিলাম তা হয়নি। শফিক মিয়া আমাদের শুধু কিছু ধমক দিয়ে ছেড়ে দিলেন। এর কিছুদিন পর এমির পরিবার আমাদের এলাকা ছেড়ে চলে গেল বাঘমারা এলাকায়। তারপর ওর সাথে বন্ধুত্বের দুরত্বটাও যেন বাড়তে লাগলো। এমির সাথে তেমন দেখাও হয়না। শুধু স্কুলে যাওয়ার সময় মাঝে মাঝে দেখা হতো। পড়াশুনার ব্যস্ততায় কথাও হতো না তেমন।
ওর সাথে যখন আমার শেষ দেখা, তখন আমি ক্লাস সেভেন কি এইটে পড়ি। সার্কিট হাউজের এখানে। ও ছয়ফুট লম্বা হয়ে গেছে। আমাকে দেখে সেই চিরচেনা হাসিমাখা মুখে প্রশ্ন করলো, “কিরে ইমন, আছোস কেমন?” উত্তর করলাম, “বালাইরে, তুই?”…… এই এই কিছু আলাপ সালাপ! তারপর আর কথা হয় নি ওর সাথে।
একদিন সকালটা আমার কেমন যেন মনমরা লাগছিল। বাসার আশেপাশের মানুষ কি যেন বলাবলি করছিল। কিছুটা আন্দাজ করতে পারলাম। তারা বলছিল, “এই এলাকায় একটা ছেড়া আছিলো না, এমি! হেইতো গতকাইল বাঘমারা এক পুস্কুনিত ডুইব্বা মইরা গেছেগা।” কথাটা আমার মোটেও বিশ্বাস হলো না। আমি তখনি বাঘমারার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। গিয়ে যা দেখলাম, তা বলতে আমার কষ্ট হচ্ছে। সেখানে অনেক মানুষ ভীর করে একটা লাশ দেখছে। লাশের খাটিয়ায় যে শুয়ে আছে, সে আমারই বন্ধু এমি। আমি এতটাই অবাক হলাম যে কাঁদতেই ভুলে গেলাম। শুধু একবুক করুণা নিয়ে ওর দিকে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। তারপর আস্তে আস্তে সব ভুলেই গেলাম। এখন আমি ভার্সিটি স্টুডেন্ট। আর এমি সেই যে চলে গেল না ফেরার দেশে। আজ হটাৎ কেন তার স্মৃতিটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো!!!!!
Leave a Reply