ইসলামে ঈদে মিলাদুন্নবী ও জশনে জুলুস উদযাপনের গুরুত্ব-তাৎপর্য – মাওলানা মুহাম্মদ বোরহান উদ্দীন কাদেরী

আল্লাহর নামে শুরু করছি,যিনি পরম দয়ালু ও করুনাময় এবং সকল প্রশংসা মহান রব তাঁরই জন্য। আর অসংখ্য দরূদ ও সালামের নাজরানা পেশ করছি সৃষ্টি কুলের সর্দার দু’জাহানের বাদশা নবী রাহমাতুল্লীল আলামীনের দরবারে। যাঁর পবিত্র বেলাদত বা শুভাগমন ঘটে ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার মা আমেনা ও হযরত বাবা আব্দুল্লাহর কোলে। যিনি সমস্ত সৃষ্টির জন্য রহমত হিসেবে এ ধরাবুকে শুভাগমন করেছেন বলে এই মাস ও দিন অত্যন্ত গুরুত্ববহ, ফজিলতময়। এই কারণেই প্রিয় নবীর পবিত্র বেলাদত শরীফে আনন্দ ও খুশি সমগ্র সৃষ্টিকুল। বিশেষ করে বিশ্ব মুমিন মুসলিম।

এ মাস ও দিনে জশনে জুলুসসহ শোভাযাত্রা, মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার শান-মান সর্ম্পর্কীয় আলোচনা সভা, সেমিনার, দান-সাদকাহ, খয়রাত এবং জাক-জমকপূর্ণ আয়োজন করে দরূদ শরীফ পাঠ, দোয়া-মুনাজাত, হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার শুভাগমনের সময়কার অলৌকিক ঘটনাবলী ও কল্যাণদির ছড়াছড়িত্বের বিবরণ দেয়া, প্রিয়নবীর হাকিকত ও মর্যাদা , আদর্শ এবং বরকতময় জীবনী আলোচনা ইত্যাদির মাধ্যমে পবিত্র ঈদ-এ- মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপন করা হয়। বস্তুত এই ধরণের আয়োজনের পক্ষে পবিত্র কুরআন, হাদিস, সাহাবায়ে কেরাম (রা:), পূর্ববর্তী ইমামগণ এবং বিজ্ঞ আলেম সামজের রয়েছে পূর্ণ সমর্থন। নির্ভরযোগ্য দলীলাদির ভিত্তিতে পবিত্র ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপনের তাৎপর্য আলোকপাত করার প্রয়াস পাচ্ছি।

পবিত্র ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপন প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনুল হাকীমের অসংখ্য আয়াতে কারীমায় মহান আল্লাহ পাক নির্দেশনা ও নির্দেশ প্রদান করেছেন। যেমন ইরশাদ করেছেন- হে নবী আপনি বলে দিন, আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতের উপর খুশী পালন কর; যা তোমাদের সমস্ত ধন-দৌলত অপেক্ষা শ্রেয়। এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুসলমানগণকে তাঁর ফজল ও রহমত প্রাপ্তির উপর খুশী পালন করার হুকুম বা নির্দেশ দিয়েছেন। (সূরা- ইউনুস, আয়াত নং- ৫৮)

অন্য আয়াতে ইরশাদ করেছেন:-এবং যদি তোমাদের উপর আল্লাহর রহমত ও দয়া না হত তাহলে তোমাদের মুষ্টিমেয় ছাড়া অন্যরা সবাই শয়তানের অনুসরণ করতে । (সূরা নিসা, আয়াত- ৮৩) তাফসীরের ইমাম তথা মুফাসসিরিনে কেরামগণ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন- এ আয়াতে আল্লাহর রহমত এবং দয়া একসাথে উল্লেখ করেছেন। এখানে رحمته বা রহমত দ্বারা মূলত হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বুঝানো হয়েছে। আর মুসলমানদেরকে আল্লাহ পাক সম্বোধন করে এরশাদ করেছেন-‘যদি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার আগমন না হতো, তাহলে তোমাদের অধিকাংশই গোমরাহ হয়ে যেতে। ফলে তারা শয়তানের অনুগত হয়ে ধ্বংস হয়ে যেত।

নবীজি রহমত হওয়া সম্পর্কে কুরআনে পাকের ঘোষণা – হে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমি আপনাকে সমগ্র জাহানের জন্য একমাত্র রহমত হিসাবে প্রেরণ করেছি। (সূরা- আম্বিয়া, আয়াত নং- ১০৭)
অর্থাৎ রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার শুভাগমন সমগ্র বিশ্বের মানব-দানব ও মুমিনের জন্য সবচাইতে বড় নেয়ামত ও দয়া।

আর আল্লাহ পাক তাঁর রহমত ও দয়া প্রাপ্তিতে শুকরিয়া করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন- তোমরা আমাকে স্মরণ কর আমি তোমাদের স্মরণ করব আর আমার (নেয়ামতের) শুকরিয়া আদায় কর এবং আমার নেয়ামতের অস্বীকার কর না। (সূরা- বাকারা, আয়াত নং- ১৫২)
তাই আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতের জন্য যারা আনন্দ প্রকাশ করে আল্লাহ ঈমানদারদের শ্রমফল বিনষ্ট করেন না।
তাছাড়া সামান্য নেয়ামত লাভ করলেও তার জন্য ঈদ বা আনন্দোৎসব করার দৃষ্টান্ত আমরা কুরআনে পাকেও দেখতে পাই। যেমন ইরশাদ হচ্ছে- ‘ঈসা ইবনে মরিয়াম আলাইহিস সালাম বললেন, হে আল্লাহ, হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের জন্য আকাশ থেকে খাদ্য ভর্তি খাঞ্ছা নাযিল করুন, যা আমাদের পূর্ববর্তী ও আমাদের পরবর্তী সকলের জন্য ঈদ তথা আনন্দ (উৎসবের কারণ) হবে। আর আপনার পক্ষ থেকে অন্যতম নিদর্শন এবং আপনিতো সর্বোত্তম জীবিকা দাতা। (সূরা- মায়েদা-১১৪)

এই আয়াতে পাক হতে প্রতীয়মান হয় যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের যুগে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে খাঞ্ছা ভরা আসমান থেকে খাদ্য আসলে, তা যদি হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের ভাষায় সৃষ্টির আদি হতে অন্ত পর্যন্ত সকলের জন্য ঈদ তথা আনন্দ উৎসবের উসিলা ও আল্লাহর নিদর্শন হয়। তাহলে আকা মাওলা রাহমাতুল্লীল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার মত মহান নেয়ামতের শুভাগমনের দিন-মাস কতই না মর্যাদাপূর্ণ, গুরুত্ববহ ও আনন্দ উৎসবের দিন যা বলার অপেক্ষা রাখেনা। সুবহানাল্লাহ! সুবহানাল্লাহ।

বুঝা গেল যে, মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পালন করা সুন্নাতে ইলাহী। আল্লাহ তাআলা যে দিন হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামাকে প্রেরণ করেছিলেন, সে দিন নবীপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামাকে পেয়ে সৃষ্টি জগতের সকলেই খুশি-আনন্দিত হয়েছিল। তবে ইবলিসের দল ব্যতীত। বর্তমানেও বহু হিংসুক মুসলমান নামধারী ইবলিসের অনুসারী আমার দেখতে পায়। যাঁরা মিলাদুন্নবীর বিরোধিতা করে। আল্লাহ তাদেরকে বুঝার তাওফীক দান করুক।

হুজুর করীম (দ:) এর শুভাগমন উপলক্ষ্যে শরীয়ত সম্মত উপায়ে আনন্দ ও খুশি উদ্যাপনের বৈধতার পক্ষে হাদীসে পাকে ও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বহু প্রমাণ বিদ্যমান। যেমন- হাদীস শাস্ত্রের প্রখ্যাত ইমাম আবু ঈসা মুহাম্মদ তিরমিযী (র:) তাঁর সংকলিত ‘সুনানে তিরমিযী শরীফে “মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শিরোনামে একটি অধ্যায় প্রণয়ন করেছেন এবং বর্ণনা করেছেন, তিনি (ক্বায়স ইবনে মাখযমা) বলেন “আমি এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘আমুল ফীল’ অর্থাৎ বাদশাহ্ আব্রাহার হস্তী বাহিনীর উপর গজব নাযিল হওয়ার বছর জন্ম গ্রহণ করেছি।” আর হযরত ওসমান ইবনে আফ্ফান (রা:) বনী ইয়া’মর ইবনে লাইস-এর ভাই কুবাস ইবনে আশ্ইয়ামকে বললেন, “আপনি বড়, না রসূলুল্লাহ তাআলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম? তখন তিনি বললেন, “রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমার চেয়ে অনেক বড়; (অর্থাৎ মর্যাদায়) আর আমি জন্ম সূত্রে হুযূরের আগে মাত্র। (তিরমিযী শরীফ: ২য় খন্ড, পৃষ্ট- ২২৪-২২৫)

উক্ত কিতাবে তিনি আরো উল্লেখ করেছেন- হযরত ওরওয়া ইবনে যোবায়র (রা:) বলেন, সুয়াইবাহ্ আবূ লাহাবের দাসী ছিলেন। আবূ লাহাব হুযূর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার বেলাদত তথা দুনিয়াতে শুভাগমন হয়েছে এই সুসংবাদ দেওয়ার কারণে (আনন্দিত হয়ে) -দাসী সুয়াইবাহকে আযাদ বা মুক্ত করে দিয়েছিল। অত:পর সেই সুয়াইবাহ্ হুযূর (দ:) কে দুধ পানও করিয়েছিলেন। আবু লাহাবের মৃত্যুর এক বছর পর তার ঘনিষ্টদের কেউ (হযরত আব্বাস) তাকে স্বপ্নে শোচনীয় অবস্থায় দেখে তার উদ্দেশে বললেন, ‘তোমার অবস্থা কেমন?’ তখন আবূ লাহাব তদুত্তরে বললো, “তোমাদের নিকট থেকে আসার পর থেকে আমি কোন প্রকার শান্তি পাই নি, কেবল আমি যে, আল্লাহর হাবীবের জন্ম-সংবাদ বা মীলাদ শরীফের খুশীতে আমার নিজের বাদী সুয়াইবাহ কে (আমার তর্জনী ও মধ্যমা এ দু’টি আঙ্গুলের ইশারায়) আযাদ করেছিলাম, ওই কারণে (প্রতি সোমবার আঙ্গুল দু’টির মধ্যে কিছু পানি জমে থাকে) যখন পিপাসাত্ব হই তখন আমি ওই পানি চুষে থাকি ও এ কারণে প্রতি সোমবার আমার উপর আযাবকে হাল্কা বোধ করে থাকি। (সহীহ বোখারী শরীফ: ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৭৬৪)

এই হাদীসের পাদটীকায় বর্ণিত আছে- সুয়াইবাহ্ আবু লাহাবকে হুযূর (দ:) এর জন্মের সুসংবাদ দেওয়ার কারণে আবূ লাহাব তাকে আযাদ করে দিয়েছিল। অত:পর এ আযাদ করাটা (পরকালে) আবূ লাহাবের উপকারে এসেছে। এ কাজ তার উপকারে আসার অর্থ হলো – তার এ কর্ম অবশিষ্ট ছিলো, অন্যান্য কাজের ন্যায় বিনষ্ট হয়ে যায় নি। তাও হুযুর (দ:) এরই বরকতে। (হাশিয়া:ই সহীহ বোখারী শরীফ: ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৭৬৪)
সুতরাং কেউ যদি এর অপব্যখ্যা দিয়ে বলে যে-“ আবূ লাহাবের পরকালীন শান্তি পাওয়া সুয়াইবাহকে আযাদ করার কারণে ছিলো, নবী করীম (দ:) এর জন্মে খুশী হওয়ার কারনে নয়। এর উত্তর হচ্ছে, “কাফির ও মুশরিক কোন ভাল কাজ করলে তা পরকালে তাদের কোন উপকারে আসে না। এর বিনিময় তারা দুনিয়াতেও পেয়ে যায়।

কিন্তু, এখানে আবূ লাহাব কর্তৃক সুয়াইবাহ্ কে আযাদ করা উপকার তার জন্য পরকালেও আছে, বরং অন্যান্য কাজের মতো তা বিনষ্ট হয়ে যায় নি। তাও কিন্তু হুযূর (দ:) এর শুভাগমনের খুশীতেই সুয়াইবাহকে আযাদ করেছিল বলে। তাহলে ঐ মুমিন মুসলমানদের অবস্থা কি হবে? যে ঈদে মিলাদুন্নবী (দ:) তে খুশী উদযাপন করে, জশনে জুলুস সহ শোভাযাত্রা, মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্ম্পর্কীয় আলোচনা সভা-সেমিনার, দান-সাদকাহ, খয়রাত এবং জাক-জমকপূর্ণ আয়োজন করে দরুদ শরীফ পাঠ ও দোয়া মুনাজাত, হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার শুভাগমনের সময়কার অলৌকিক ঘটনাবলী ও কল্যাণদির ছড়াছড়িত্বের বিবরণ দেয়া এবং প্রিয় নবীর আদর্শ-জীবনী আলোচনা ইত্যাদির মাধ্যমে সাধারণত পবিত্র ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপন করে থাকেন।

সহীহ্ বুখারী শরীফে উল্লেখ রয়েছে- হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হুযুর রসুল করীম (দ:) মদীনা শরীফে তাশরীফ আনলেন। অত:পর ইহুদীগণকে আশুরার দিন রোযা রাখতে দেখলেন। তখন তিনি বললেন – এটা কি? অর্থাৎ এ রোযা কি কারণে? তখন তারা বললো, “এটা এমন একটি দিন, যেদিন আল্লাহর ঈসা (আ:) কে নাজাত দান করেছেন এবং এদিনে ফিরাউনকে নীল নদে ডুবিয়ে মেরেছেন। সুতরাং হযরত মূসা (আ:) শোকরিয়া স্বরূপ এদিন রোযা পালন করেছেন। তখন হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন, “আমরা মূসা (আ:) এর বিষয়ে তোমাদের তুলনায় বেশী হক্বদার। অত:পর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওই দিন রোযা রাখলেন এবং ওইদিনে সাহাবায়ে কেরামকে রোযা রাখার নির্দেশ দান করলেন।

আলোচ্য হাদীসের পাদ/পার্শ্বটীকায় উল্লেখ রয়েছে যে, আলোচ্য হাদীস শরীফ দ্বারা নির্দিষ্ট দিনে, সুনির্দিষ্ট কারণে নির্দিষ্ট ইবাদত পালনের পক্ষের আলিমগণ দলীল পেশ করেছেন। যেমন ওফাত দিবসে মৃতদের জন্য সাদ্ক্বাহ খায়রাত করা। অন্য দিকে, হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আশুরার দিনকে রোযার জন্য নির্দিষ্ট করেছেন। আর সোমবারকেও একইভাবে। কারণ, ওই দিন তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঠিক শুভাগমন করেছেন এবং ওই দিনে তাঁর প্রতি ওহী অবতীর্ণ হয়েছে। (সহি বুখারী শরীফ: ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ১৬৮) এই ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (দ:) নিজেই এরশাদ করেছেন- হযরত আবূ ক্বাতাদাহ্ (রা:) হতে বর্ণিত তিনি বলেন – রসূল করীম (দ:) এর মহান দরবারে সোমবার রোযা পালন সম্পর্কে আরজ করা হলো। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে ইরশাদ ফরমালেন- ঐ দিন আমি শুভাগমন করেছি এবং ঐ দিন আমার উপর পবিত্র কুরআন নাযিল হয়েছে। (মুসলিম ও মিশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা- ১৭৯) আলোচ্য হাদীস শরীফ দ্বারা সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হয় যে, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার পবিত্র মিলাদের দিবস অর্থাৎ প্রতি সোমবার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। এতে আরো প্রমাণিত হয় যে, হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং প্রতি সোমবার মীলাদে পাকের শোকরিয়া স্বরূপ পালন করতেন। আর মুমিন মুসলমানগণ তো বছরে একবার “ঈদে মিলাদুন্নবী” সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপন করছে পবিত্র রবিউল আউয়াল মাসে। আর আলোচ্য হাদিস তো প্রতি সোমবার মীলাদুন্নবী উপলক্ষ্যে রোযা পালন করা, দান- সদকাহ্ সুন্নাত প্রমাণ করছে।

খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে পবিত্র ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি ছিল ? এ প্রসঙ্গে আল্লামা শাহাবুদ্দীন ইবনে হাজর হায়তামী (রহঃ) তার কিতাবে উল্লেখ করেছেন- খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগেও ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পালন করার রীতি প্রচলন ছিল। যেমন হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বলেছেন- “যে ব্যক্তি ‘মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঠ করার জন্য এক দিরহাম অর্থ খরচ করবে, সে ব্যক্তি বেহেশেতে আমার সাথী হবে”। হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বলেছেন- “যে ব্যক্তি ‘মিলাদুন্নবী’র ইবাদত করে এবং সম্মান করে, আল্লাহ তাকে শান্তি দান করেন, তিনি ইসলামকে বাঁচিয়ে রাখেন।” হজরত উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বলেন- “যে ব্যক্তি ‘মিলাদুন্নবী’ পাঠে এক দিরহাম ব্যয় করে, আল্লাহ তাকে শান্তি দান করেন। যেন তিনি বদর ও হোনাইনের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।” হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বলেছেন- “যে ব্যক্তি ‘মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্মান করবে এবং মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঠ করার উদ্যোক্তা হবে, সে দুনিয়া থেকে (তওবার মাধ্যমে) ঈমানের সাথে বিদায় হবে এবং বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে”। (সূত্রঃ আন নে’মাতুল কোবরা আলাল ফি মাওলিদি সাইয়্যেদ ওলদে আদম ৭-৮ পৃষ্ঠা)

প্রখ্যাত তাবেয়ী, ইমাম ও ফকীহগণের মতে ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদ্যাপন: বিশিষ্ট তাবিয়ী, ইমামুশ শরীয়ত ওয়াত তরীক্বত, যিনি শতাধিক সাহাবায়ে কিরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম উনাদের সাক্ষাত মুবারক লাভ করেছিলেন, সেই বিখ্যাত ইমাম হযরত হাসান বছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন- ‘আমার একান্ত ইচ্ছা হয় যে, আমার যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ থাকতো তাহলে তা পবিত্র মীলাদুন্নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপলক্ষে ব্যয় করতাম।’ সুবহানাল্লাহ! (আন নি’মাতুল কুবরা আলাল আলাম ৮ পৃষ্ঠা)। শাফেয়ী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম হযরত ইমাম শাফিয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন- ‘যে ব্যক্তি পবিত্র মীলাদুন নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উদযাপন উপলক্ষে লোকজন একত্রিত করলো, খাদ্য তৈরি করলো, জায়গা নির্দিষ্ট করলো এবং এ জন্য উত্তমভাবে তথা সুন্নাহ ভিত্তিক আমল করলো তাহলে উক্ত ব্যক্তিকে আল্লাহ পাক হাশরের দিন ছিদ্দীক্ব, শহীদ সালিহীনগণের সাথে উঠাবেন এবং উনার ঠিকানা হবে জান্নাতে নায়ীমে।’ সুবহানাল্লাহ!( আন নি’মাতুল কুবরা আলাল আলাম ১০ম পৃষ্ঠা)।
সাইয়্যিদুৎ ত্বায়িফাহ হযরত জুনাইদ বাগদাদী ক্বাদ্দাসাল্লাহু সিররাহু রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন- “যে ব্যক্তি পবিত্র মীলাদুন নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার আয়োজনে উপস্থিত হবে এবং উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করবে সে বেহেশতি হবে।” সুবহানাল্লাহ! (আন নি’মাতুল কুবরা আলাল আলাম ৮ পৃষ্ঠা)।
এ ব্যাপারে যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আল্লামা শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী বলেন-আমি ইতিপূর্বে মক্কা শরীফের রাসূলে পাকের বেলাদতের তারিখে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার মাহফিলে উপস্থিত ছিলাম, মক্কাবাসীগণ নবীজির উপর দরূদ শরীফ পাঠ করেছে, তাঁর শুভাগমনের পবিত্র মুহুর্তে সংগঠিত আলৌকিক ঘটনাবলী বয়ান করতেন। ঐ মাহফিলে আমি নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার নূরকে দেখতে পেয়েছি। (ফযুযূল হারামাইন, পৃষ্ঠা-৮০-৮১)।

বিশ্ববিখ্যাত ইমাম আল্লামা জালাল উদ্দিন সূয়ুতী (র:) এর কাছে জানতে চাওয়া হয়- মীলাদে মুস্তাফা এর শরীয়তের বিধান কি? তিনি উত্তরে বলেন, আমার নিকট এর জবাব হচ্ছে: ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলো- প্রিয়নবী (দঃ) এর ভূ-পৃষ্ঠে শুভাগমনের প্রাথমিক অবস্থাদির বর্ণনা সম্বলিত হাদীস সমূহ ও হুযূরের পবিত্র বেলাদত শরীফের সময় যেসব অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিলো সেগুলো আলোচনা করা, মাহফিলে আগত মেহেমানদের মধ্যে লম্বা দস্তরখানা বিছিয়ে খাদ্য পরিবেশন করা এবং তাতে অপচয় পরিহার করা। এমনই ভাল কাজের যে আয়োজন করে সে সাওয়াব পাবে। কারণ তাতে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)‘র দুনিয়াতে পবিত্র শুভাগমন কে উদ্দেশ্য করে খুশি প্রকাশ করা হয়। (আল হাভী লিল-ফাতাওয়া: ১ম খন্ড,পৃষ্ঠা-২৫২ ও হুসনুল মকাসিদ ফী আমলিল মওলিদ ইত্যাদি)।

পক্ষান্তরে রবিউল আউয়াল মাসে সিরাতুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপন করা, ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অস্বীকার করার নামান্তর। সিরাত শব্দটি কেন, কোন ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে সে জ্ঞানও বিরোধিতা কারীরা রাখেনা। তারা শুধুমাত্র ঈদে মিলাদুন্নবীর প্রতি বিদ্ধেষ পোষণ করে বিরোধিতা করতে সিরাতুন্নবী পালন করে। কিন্তু সিরাতুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পালনের নামে তারা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দোষ-ত্রুটি খোঁজে বেড়ায়। যা গর্হিত ও ঈমান বিধ্বংসী। প্রকৃত অর্থে যারা পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবীতে খুশি হতে পারে না, বিরোধীতা করে তারা মূলত শয়তানের অনুসারী, উত্তরসূরী। কারণ ইবলিশ শয়তান তার জীবনে ৪বার খুব বেশি কেঁদেছে বা আফসোস করেছে। তাহলো- ১. আল্লাহ যখন তাকে অভিশপ্ত হিসেবে ঘোষণা দিলেন, ২. যখন তাকে বেহেশত থেকে বিতাড়িত করা হল, ৩. নূর নবীজীর দুনিয়াতে আগমনের সময় এবং ৪. সূরা ফাতিহা নাযিল হবার সময়। [সূত্রঃ ইবনে কাসির, আল আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা – ১৬৬]

আসুন মিথ্যা ভ্রান্ত সমালোচনা বর্জন করে, অপরের শোনা কথায় পরোচিত না হয়ে, শুধুশুধু বিরোধিতা না করে প্রত্যেকে নবীপ্রেমে বিভোর হয়ে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার শুভাগমনের দিন জশনে জুলুসসহ শোভাযাত্রা, মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্ম্পর্কীয় আলোচনা সভা ও সেমিনার, দান-সাদকাহ, খয়রাত এবং জাক-জমকপূর্ণ আয়োজন করে দরূদ শরীফ পাঠ, মাহফিল ও দোয়া মুনাজাত, হুযুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শুভাগমনের সময়কার অলৌকিক ঘটনাবলী ও কল্যাণদির ছড়াছড়িত্বের বিবরণ দেয়া এবং প্রিয় নবীর আদর্শ জীবনী আলোচনা ইত্যাদির মাধ্যমে পবিত্র ঈদ-এ- মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদ্যাপন করে তার প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা প্রকাশে প্রয়াসী হই। কেননা তা সুন্দরতম আমল, অতীব বরকতময় সমৃদ্ধ এবং পূর্ণময় সাওয়াবের কাজ। এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করার কোন অবকাশ নেই। আল্লাহ পাক আমাদেরকে বুঝার ও আমল করার তাওফিক দান করুক। (আমিন)





About মাওলানা মুহাম্মদ বোরহান উদ্দীন 51 Articles
তিনি বর্তমানে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মহিলা ফাযিল মাদরাসা, ষোলশহর, চট্টগ্রামে শিক্ষকতা করছেন এবং মসজিদ- এ রহমানিয়া গাউসিয়া, শীতলঝর্ণা আ/এ, অক্সিজেন, বায়েজিদ, চট্টগ্রাম-এ সম্মানিত খতিব হিসেবে নিযুক্ত আছেন। এর আগে তিনি মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া তাহেরিয়া সুন্নিয়া দরসে নেযামী, মোহরা, চট্টগ্রামে ৫ বছর শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*