শিক্ষা যদি হয় জাতির মেরুদণ্ড। তবে শিক্ষক হচ্ছে তার প্রাণ। কেননা শিক্ষক তাঁর নিজের অর্জিত শিক্ষা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে গড়ে তোলেন তাঁর শিক্ষার্থীকে। নিজের সমস্ত জ্ঞান তিনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। উন্নত জাতি বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন শিক্ষক। সমৃদ্ধ জাতি গঠনে দরকার পর্যাপ্ত শিক্ষক। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক সংকট এখন স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৬ সালের পূর্বে ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হত। কমিটি মোটা অঙ্কের আর্থিক অনুদান গ্রহণ করে শিক্ষক নিয়োগ দিত। আর্থিক লেনদেন তথা ঘুষ বাণিজ্য রোধে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষক নিয়োগ ক্ষমতা এনটিআরসিএ এর কাছে হস্তান্তর করা হলে ঘুষ বাণিজ্য বন্ধ হয়েছে। যা প্রশংসার দাবি রাখে। ২০১৬ সালে এনটিআরসিএ ১৬০০০ পদের বিপরীতে প্রথম গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। প্রথম গণবিজ্ঞপ্তিতে প্রার্থীরা স্ব স্ব জেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আবেদন করেন। কিন্তু পদ্ধতিগত ভুলের কারণে একই ব্যক্তি একাধিক প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত হন। শিক্ষক সংকট থেকেই গেল। এরপর ২০১৮ সালের শেষে স্কুল-কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মোট ৩৯ হাজার ৫৩৫ শূন্য পদে শিক্ষক নিয়োগের লক্ষ্যে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে এনটিআরসিএ। দ্বিতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে বেশ কিছু পরিবর্তন আসে নিয়োগ পদ্ধতির। এ বিজ্ঞপ্তিতে চাকরি প্রত্যাশীদের দেশের সকল প্রতিষ্ঠানে আবেদনের সুযোগ প্রদান করা হয়। সেই সাথে সফটওয়্যারকেও এমন নির্দেশনা দেওয়া হয় যেন একই ব্যক্তি একাধিক প্রতিষ্ঠানে সুপারিশ না পান। দ্বিতীয় নিয়োগ চক্রে চূড়ান্তভাবে প্রায় ৩৪ হাজার শিক্ষক দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুপারিশ পান। নিয়োগ চক্রের এ নিয়মে চাকরি প্রত্যাশীরা অনেকটাই খুশি। কিন্তু বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বদলি ব্যবস্থা না থাকা ও সীমিত বেতন হওয়ায় দূরে নিয়োজিত শিক্ষকগণ পড়েন চরম বিপাকে। তারপর ২০২০ সালের ৩১ মার্চ প্রায় ৫৪ হাজার পদের বিপরীতে প্রকাশ করা হয় তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তি। বদলি ব্যবস্থা না থাকায় দ্বিতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকসহ নতুনরাও আবেদন করেন তৃতীয় নিয়োগ চক্রে। তৃতীয় চক্রেও এমপিওভুক্ত ও নন এমপিওসহ ৩৬৫৪০ জন শিক্ষক চূড়ান্ত সুপারিশ পান। যার মধ্যে পূর্বের ইনডেক্সধারীর সংখ্যা ২১৮৭৩ জন। আর নতুন সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষক মাত্র ১৪৬৬৭ জন।
সামনে আবারও প্রায় সত্তর হাজার পদের বিপরীতে চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তি হতে যাচ্ছে। গণবিজ্ঞপ্তি দিলে ষোড়শ নিবন্ধনধারীদের মধ্য থেকে কিছু উচ্চ নম্বরধারীর চাকরি হলেও কম নম্বরধারীরা বেকার পড়ে থাকবেন। যেহেতু বদলি ব্যবস্থা নেই তাই চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে ইনডেক্সধারীরা আবারও আবেদন করবেন। মোট পদের দুই তৃতীয়াংশ পদই দখল করবেন ইনডেক্সধারীরা। ফলে শিক্ষক সংকট থেকেই যাবে। অথচ শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতির একটু পরিবর্তনই পারে শিক্ষক সংকট দূর করতে। এজন্য প্রয়োজন ইনডেক্সধারী ও নতুন চাকরি প্রত্যাশীদের জন্য দুটি আলাদা নিয়োগ পদ্ধতির। শূন্যপদ সংগ্রহ শেষ হওয়ার পর ইনডেক্সধারীদের জন্য আলাদা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ইনডেক্সধারীদের নিয়োগ সম্পন্ন করতে হবে। পরবর্তীতে ইনডেক্সধারীদের ছেড়ে আসা পদ ও নতুন শূন্যপদসহ নতুনদের জন্য একটি গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হবে। এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে বদলি প্রত্যাশী ইনডেক্সধারী শিক্ষকগণ প্রত্যাশা পূরণের মাধ্যমে তাদের কাঙ্ক্ষিত স্থানে যেতে পারবেন। আবার অধিক সংখ্যক নতুন চাকরি প্রত্যাশী শিক্ষক হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হবেন। প্যানেল প্রত্যাশীদেরও একটা বিরাট অংশ চাকরি পাবেন। হ্যাঁ একথা সত্যি যে, এতে একটু বেশি সময় লাগবে। যা নতুন গণবিজ্ঞপ্তি প্রত্যাশীদের ধৈর্যচ্যুতির কারণ হবে। যাদের নম্বর বেশি তারা ইনডেক্সধারীদের জন্য আলাদা বিজ্ঞপ্তির ঘোর বিরোধিতাও করবেন। কেননা বেশি নম্বরধারীরা একরকম নিশ্চিত যে, তারা নিয়োগ পাবেনই। কিন্তু যাদের নম্বর তুলনামূলক কম, তাদের কী হবে? তারা তো আবারও নিয়োগ বঞ্চিত থেকেই যাবেন। তাই চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির আগে ইনডেক্সধারীদের জন্য প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের জন্য আলাদা বিজ্ঞপ্তি দিলে বদলি প্রত্যাশী, গণবিজ্ঞপ্তি প্রত্যাশী, প্যানেল প্রত্যাশী, কম নম্বরধারী সকলের জন্যই কল্যাণকর হবে।
সদিচ্ছা থাকলে ইনডেক্সধারীদের জন্য কাঙ্ক্ষিত গণবিজ্ঞপ্তি তথা নিয়োগ প্রক্রিয়া এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। ইনডেক্সধারীদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের জন্য আলাদা বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পর আবেদনের জন্য মাত্র দশদিন সময় দিলেই যথেষ্ট। তারপর দশদিন যাচাই বাছাই শেষে ফলাফল প্রকাশ সম্ভব। যেহেতু ইনডেক্সধারীদের পুলিশ ভেরিফিকেশন করাই আছে তাই পরের দশ দিনেই যোগদান প্রক্রিয়া শেষে করতে সমস্যা হবে না। এরপর দেড় মাসের মধ্যেই শুরু হবে চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির কাজ। চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তি কেবল নতুনদের জন্য। ইনডেক্সধারীদের আবেদনের সুযোগ থাকবে না।
সূতরাং একথা বলাই যায় যে, এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক সংকট দূর করতে চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির আগে ইনডেক্সধারীদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের জন্য বিজ্ঞপ্তি দিলে বদলি প্রত্যাশী ও নতুন চাকরি প্রত্যাশী উভয়ের জন্যই কল্যাণকর। সেই সাথে শূন্যপদ পূরণের মাধ্যমে দূর হবে শিক্ষক সংকট। চাকরি পাবেন অধিক সংখ্যক বেকার।
Leave a Reply