কুরআন-হাদীসের আলোকে কুরবানীর গুরুত্ব ও তাৎপর্য

যিলহজ্জ মাস হলো হিজরী সনের দ্বাদশ মাস এবং সর্ব শেষ মাস। আর এ মাসেই রয়েছে বিত্তবানদের ওপর ফরজ হজ্ব এবং মানব ইতিহাসের অবিস্মরণীয় ঘটনা তথা আপন সন্তানকে কোরবানী করার ইতিহাস।

কুরবানীকে আরবী ভাষায় “উদ্বহিয়্যাহ” বলা হয়। এর অর্থ হল-ওই পশু যা কুরবানীর দিন যবেহ করা হয়। আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট পশু যবেই করাই কুরবানী।

কুরবানীর বিধান যুগে যুগে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ হতে অবতীর্ণ সকল শরীয়তেই বিদ্যমান ছিল।

যেমন পবিত্র কুরআন শরীফে এরশাদ হয়েছে- এবং প্রত্যকে উম্মতের জন্য আমি একটা কুরবানী নির্ধারিত করছি যেন তারা (যবেহ করার সময়) তাঁর প্রদত্ত বাকশক্তিহীন চতুস্পদ পশুগুলোর উপর আল্লাহর নাম নেয়; তোমাদের উপাস্য একমাত্র উপাস্যই। (শুধু তাঁরই নামে যবেহ কর); সুতরাং তাঁরই সম্মুকে আত্মসমর্পন কর। (নিষ্ঠার সাথে অনুগত অবয়বে)।
[সূরা হাজ্ব- আয়াত -৩৪]

হাদীসে পাকে উল্লেখ রয়েছে- হযরত যায়েদ ইবন আলক্বাম (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসূল (দ:) কুরবানী কী ? তিনি বল্লেন এটা তোমাদের পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ:) এর সুন্নাত সাহাবীরা আবার জিজ্ঞেস করলেন-এতে আমাদের কী উপকার রয়েছে- ? আল্লাহর রাসূল এবার উত্তর দিলন- কুরবানীর পশুর প্রত্যক পশমের পরিবর্তে একটি করে নেকী রয়েছে। তা যদি ছাগল, ভড়া ও দুম্বা হয়ও।
[মসনদে আহমদ, ইবনে মাজাহ, মিশকাত শরীফ ২২৬]

হযরত ইব্রাহীম (আঃ এর সন্তানন ) কুরবনীর ইতিহাস ও রহস্য, মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর সাথে সম্পৃক্ত। মহান আল্লাহ তাঁকে একের পর এক পরীক্ষা করে সর্বশষে খলীলুল্লাহ বা নিজের বন্ধু হিসেবে ঘোষণা দেন।
প্রথমত: নমরুদের মাধ্যমে অগিকুন্ড নিক্ষেপের পরীক্ষা। যা হযরত ইব্রাহীম (আ:) চরম ধর্য্যের সাথে মহান আল্লাহর উপর দৃঢ় বিশ্বাস এবং আস্থার কারণে সেই পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হন। এর পর নিজের স্ত্রী ও দুগ্ধপেষা সন্তানকে মরুভুমিতে নির্বাসনের নির্দেশ দেওয়া হলে, তিনি সেই পরীক্ষায়ও উর্ত্তীণ হলেন।

এভাবে বড়বড় ত্রিশ(৩০) উর্ধ্ব পরিক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন তিনি। আর প্রতি পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হয় আল্লাহর বন্ধুত্বর আসন সমাসীন হত সক্ষম হন।

সর্বশেষ পরীক্ষা নেওয়া হয়-নিজের প্রাণপ্রিয়, কলিজার টুকরা আদরের সন্তান কে কুরবানী নির্দেশের মাধ্যম।

পবিত্র হাদিসে পাকে বর্ণিত রয়েছে- হযরত ইব্রাহীম (আ:) আল্লাহর রাস্তায় ১ হাজার বকরী, ৩শ গাভী এবং একশ-উট কুরবানী দিয়েছিলেন।

মহান আল্লাহর প্রতি ভালবাসার এমন নিদর্শন দেখে মানুষ তো বটেই ফেরেশতারাও অবাক হয়ে গিয়েছিলন। এ অবস্থায় হযরত ইব্রাহীম (আ:) আরো আবেগাপ্লুত হয়ে বল্লেন- “আমার রবের জন্য আমি যা দিলাম তাতাে কিছুই নয়! বরং আমার কাছে যদি আরো একটা সন্তান থাকতো তাকেও আমি আল্লাহর রাস্তায় কুরবানী দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতাম।

এদিকে অনেকদিন অতিবাহিত হয়ে গেল। আর এ কথাটিও তাঁর ম্মরণের অগােচরে চলে যায়। যখন পবিত্র মক্কায় পর্দাপন করলেন আল্লাহর পাকের দরবারে একটি সন্তানের আবেদন করলেন।

আল্লাহ তায়ালা তাঁর পবিত্র ফরিয়াদ কবুল করলেন এবং পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দেন। ফলে শিশুপুত্র হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম’ এর জন্ম হয়।

অতি আদর যত্নে লালিত-পালিত শিশু ইসমাইল (আ:) এর বয়স যখন ৭ বছর বা ১০ বৎসর হলো। তখন হযরত ইব্রাহীম (আ:) কে স্বপ্নে বলা হলো- ওহে ইব্রাহীম! এবার তুমি তােমার নিকট সর্বাপেক্ষা প্রিয় বস্তুটি আল্লাহর দরবারে কুরবানী করো! এভাবে তিন দিন একই স্বপ্ন দেখে নিশ্চত হলেন , আল্লাহ তাঁকে স্বীয় পুত্র ইসমাঈলকে কুরবনীর নির্দেশ দিয়েছেন।

মহান আল্লাহর নির্দেশ মতো শিশুপুত্র হযরত ঈসমাঈল (আ:) কে কুরবানী করার জন্য মিনা নামক প্রান্তে শায়িত করে ধারালো ছুরি দিয়ে বারংবার যবেহের প্রচেষ্টা চালনাের পরও শিশু ইসমাঈল (আ:) এর কােমল চামড়া কাঁটা যাচ্ছিল না।

এমতাবস্থায় মন আরো হতাশ হৃদয়ে ভেঙ্গে পড়লেন। তখনি এক পর্যায়ে অনুভব করছিলেন কুরবানীর হয়ে গেছে। বাঁধা চক্ষুযুগল যখন খুল্লেন, দেখতে পেলেন সামনে একটি দুম্বা যবেহ হয়ে আছে; যা দেখে আরাে বেশি হতবাক হয়ে গেলেন।

তখন আওয়াজ এলো-“হে ইব্রাহীম! নিশ্চয় তুমি তােমার স্বপ বাস্তবায়ন করেছো । আর এভাবেই আমি পূণ্যবানদের পুরস্কৃত করি।

সে দিন বেহশত থেকে দুম্বা এনে শিশু ইসমাঈল (আ:) এর স্থলাভিষিক্ত করে কুরবানী কবুল করলেন ।

বস্তুত হযরত ইব্রাহীম (আ:) এর প্রিয় সন্তান হযরত ইসমাঈল (আ:) কে কুরবানী দেওয়ার এ-অবিস্মরণীয় ঘটনাকে প্রাণবন্ত করে রাখার জন্যই উম্মত মুহাম্মদী (দ:) এর উপর কুরবানী কে ওয়াজিব করা হয়েছে ।

কুরবানী প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- হে নবী “আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুন এবং কুরবানী করুন। (সুরা কাউসার-২)

অপর এক হাদীসে এসেছে – “কুরবানী পশু ক্রয়ের জন্য যে ঘর হতে বের হয়, তার প্রত্যক কদমের পরিবর্তে একটি করে নেকী আল্লাহ তায়ালা তার আমল নামায় লিপিবদ্ধ করে দেন।”

হাদীসে পাকে আরো এসেছে – তােমরা কুরবনীর পশুকে সম্মান করো, কেননা ওটা পরকালে পুুলসিরাতের উপর তােমাদের বাহন হবে।”

কুরবনীর ফযিলত সম্পর্ক অন্য হাদীস এসেছে- প্রিয়নবী ইরশাদ করেছেন- “কুরবানীদাতার পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার পূর্বেই তার কুরবানী আল্লাহর দরবার কবুল করা হয়। যদি অন্তরের নিয়ত পরিশুদ্ধ হয়।”

মহনবী (দ.) আরো বলেছেন “তােমাদের মধ্যে যারা কুরবনী দিবে এবং যারা কুরবানী দিত অক্ষম তারা যেন জিলহজ্বের ১ম দিন হতে ১০ম দিন কুরবানীর পশুর গলায় চুরি দেওয়া পর্যন্ত নিজের চুল, নখ, পশম ইত্যাদি কাটা থেকে বিরত থাক। এটা মুস্তাহাব আমল, এর ফলে আল্লাহ তায়ালা কুরবানী অক্ষম ব্যাক্তিকেও কুরবানীর সাওয়াব দান করেন।

পরিশেষে বলা যায়- কুরবানীর বিশাল নি’মাতের মূল কারণ হলো, এতে বান্দার পক্ষ থেকে মহান আল্লাহর প্রতি মুহাব্বতের এক প্রােজ্জ্বল নিদর্শন পরিলক্ষিত হয়। তাই কুরবানী হতে হবে লৌকিকতামুক্ত, ফলে তার সাথে যবেহ হবে মনের পশুত্ব!

আর তা করতে না পারলে কুরবানী করার মধ্য কোন সার্থকতা আমাদের কপালে নসীন হবে না। আল্লাহ তায়ালা আমাদের প্রত্যকের কুরবানী কে যেন কবুল করে অফুরন্ত সাওয়াব দান করেন।

আমীন

 

লেখক: উপাধ্যক্ষ,

মাদরাসা-এ তৈয়্যাবিয়া তাহরিয়া সুন্নিয়া দরসে নেযামী কমপ্লেক্স , চট্টগ্রাম।

খতিব, মসজিদ-এ রহমানিয়া গাউসিয়া , বায়েজিদ, চট্টগ্রাম।

০১৮১৬-৩৭৩৫০৩





About মাওলানা মুহাম্মদ বোরহান উদ্দীন 51 Articles
তিনি বর্তমানে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মহিলা ফাযিল মাদরাসা, ষোলশহর, চট্টগ্রামে শিক্ষকতা করছেন এবং মসজিদ- এ রহমানিয়া গাউসিয়া, শীতলঝর্ণা আ/এ, অক্সিজেন, বায়েজিদ, চট্টগ্রাম-এ সম্মানিত খতিব হিসেবে নিযুক্ত আছেন। এর আগে তিনি মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া তাহেরিয়া সুন্নিয়া দরসে নেযামী, মোহরা, চট্টগ্রামে ৫ বছর শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*