সকালে ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসেনাদুস-নুদুস শান্ত। মা এসে মুড়িমুড়কি আর তালেরগুড় দিয়ে গেল। খেতে খেতে পড়ে আর আজকেরদিনলিপি নিয়ে চিন্তা করে নিরীহ শান্ত।
আজ শুক্রবার। স্কুল নেই।
পড়া শেষ হলে ভাত খেয়ে বের হল। দুরন্তদেরবাড়ি। দেখা যাক দুরন্ত কি বলে।
দুরন্ত তখনও খাচ্ছে। তার মা শান্তকেও খেতেবলল। শান্ত বলল, “আমি কেবল খেয়ে আসলাম, চাচি।”
“কি খাইলি রে, বাপ? তোর মা কি রান্ধিছে?”
“পুঁটি মাছ ভাজা আর শোল মাছ রান্ধা।”
“কি দিয়ে রান্ধিছে তোর মা শোল মাছ?”
“পুঁইশাক আর কুমড়ো শাক দিয়ে।”
“পুঁইশাক ভাল তরকারি। আমরা নাইল দিয়েজিয়েল মাছ রান্ধিছি, খা আর চারডে।”
“না না, আর খাব না।” দুরন্তর দিকে তাকাল শান্ত।সে এসে পড়ায় গপাগপ গিলছে বেচারা। তবু একটুতাড়া দিল শান্ত, “তুই শিগগির খা। এত দেরি করিসক্যা?”
“কই দেরি করলাম? এই যে কেবল বসলাম আরএই দেখ হয়ে গেল।” তাড়াতাড়ি খেয়ে ওঠে দুরন্ত।তারপর দুজন একসাথে বের হয়।
“আজ কোথায় যাওয়া যায়, কি করা যায় বল তো?”
“তাই তো ভাবছি।”
“আমি কালই ভেবে রেখেছি, বুঝলি?”
“কি করে বুঝব? তুই কি আমারে কইছিস?”
“দাঁড়া, কচ্ছি।”
শান্ত সদর উঠোনে দাঁড়িয়ে। দুরন্ত ঘরে গিয়ে দানিয়ে এল।
“দা দিয়ে কি করবি?”
“চল আমার সাথে।”
তারা পা বাড়াল। বাড়ি থেকে বের হয়ে বাগানেরদিকে। “প্রথম কাজ হল কুঞ্চি আর কলাগাছ কেটে ভেলা তৈরি।”
“ও, বুঝেছি। তারপর সাপের বাসায় মাছ ধরার অভিযান!”
আকাশে থমথমে মেঘ। ফিসফিস বৃষ্টি হচ্ছে। পথ-প্রান্তর ভিজে স্যাঁতসেঁতে। বাগানে পাতা পচা থকথকেকাদা। একটু একটু আন্ধার। ওরা এগোয় যায়।
“এখানে আসলে মনে হয় আমরা আদিম যুগেফিরে গেছি, তাই না?”
“হুঁম! আদিম যুগের জঙ্গলের মত। দিনের বেলায়আন্ধার।”
“এত ভিতরে যাচ্ছিস কেন?” শান্ত বলছিল। দুরন্তওর দিকে হিস করে তাকাল। ধারাল দা উঁচু করে ধরেশান্তর চোখে চোখ রাখে। তার চোখ দুটো চকচককরে।
শান্ত ভয় পায়। তার বুকের ভেতর কেঁপে ওঠে।দুরন্ত তার দিকে এমন করে তাকাচ্ছে কেন? তারমনে পড়ে, গতকাল তাদের গণ্ডগোল বেধেছিল। কিন্তুএমন তো প্রায়ই বাধে। একটু পরে তা আর মনে থাকেনা।
একটা ভুতুম ডেকে উঠল। “ভূত-ভূত-ভূতু-উ-উ-ম! ভূত-ভূত-ভূতু-উ-উ-ম!”
শান্তর চোখে জল এসে যায়। ভুতুমটা ডেকেইযাচ্ছে। ভুতুম ডাকা নাকি অমঙ্গলের লক্ষণ। মুরব্বিরাবলে থাকে। শান্তর মনে পড়ল তার মার কথা, দাদিরকথা।
রুবানা খাতুন শান্তকে বাড়িতে না পেয়ে আশপাশেরবাড়িতে খুঁজতে গেল। যেদিন শান্তর স্কুল না থাকেসেদিন সে তাকে সব সময় কাছে রাখতে চায়। কিন্তুশান্ত এখন বড় হয়েছে। আট ক্লাসে পড়ে। সে কিআর সব সময় বাড়ি থাকে।
রুবানা শান্তকে কোথাও খুঁজে পেল না। তার মনখারাপ হয়ে যায়। বাড়ি ফিরে মাটির বারান্দায় চুপকরে বসে থাকে। আহা! তার একটি মাত্র শান্ত। তারশাশুড়ি তার মন ভার দেখে বলল, “কি হইছে, ওবউ?”
“আমার শান্ত!” রুবানা আর কিছু বলতে পারে না।
“হ, তুমার শান্ত। তুমারই তো। তা হইছে কি?”
“কোথাও তালাশ করে পালাম না।”
“তা ছুটির দিন ছায়াল-পায়াল এটটু ঘুরে-ঘেরেবেড়াবে না?”
বাহার বেগম বের হয়ে গেল বাড়ি থেকে। দুই-তিনটে বাড়ি পার হলে বিলের ধারে দুরন্তদের বাড়ি।
“ওগো! আমাগের দুলাল তুমাগের বাড়ি আইছেনাকি গো?”
“কিডা, শান্ত?” দুরন্তর মা বলল।
“হ। আমাগের রুবার দুলাল।”
“ক্যা? কান্দা শুরু কইরে দেছে নাকি রুবা খাতুন?”
“দেয়নি অহনও। দেবে। ছ্যামড়াডা কুহানে গেলতা কিডা জানে।” বারান্দায় উঠে বসল বাহার বেগম।
দুরন্তর মা উঠোনের কোণে বসে একটা করেনারকেলের পাতা চেঁছে শলা তোলে আর কথা বলে।
“উঃমা! আমি দেহি বসে পড়লাম!” বলতে বলতেউঠল বাহার বেগম। মনের অজান্তেই বসে পড়েছিলবুড়ি।
“তা একটু বসফেন না? কত দিন আসেন নাএদিকি।” দুরন্তর মা বলল।
“পরে এক সময় আসফানিরে মা। ছ্যামড়াডাকুহানে গেল এটটু তালাশ করে দেহি।”
“আশপাশেই কোথাও আছে। আপনি খালি খালিব্যস্ত হচ্ছেন। আমার দুরন্তও তো গেছে। সকালেখায়েদায়ে দুইজনে একসাথে গেছে।”
“তা তো গেল। তো গেল কোন জাগা?” বাহারবলল, “তুই কাজ কর। আমি এটটু দেহে আসি কুহানেগেল।”
বাহার বেগম খেলার মাঠে যায় প্রথমে। ছেলেরাকেউ কেউ ক্রিকেট খেলছে, কেউ কেউ ফুটবল নিয়েমেতেছে। সেখানে শান্তও নেই দুরন্তও নেই। ছেলেরাঅন্যান্য যেখানে খেলাধুলা করে সেখানে গেল বাহারবেগম।
শান্তর দিকে তাকিয়ে অবাক হয় দুরন্ত। “কানছিসকেন?”
“তুই দা উঁচু করে এমন করে তাকাচ্ছিস কেন?” শান্তর গলা জড়িয়ে যাচ্ছে।
দুরন্ত থতমত খেয়ে যায়। বলে, “দা উঁচু করেছি তোহয়েছে কি? শুনছিস না যে ভুতুম ডাকছে? যদিহামলা করে? এই ভুতুমগুলো খুব বুনো। যেমন বুনোতেমনি হিংস্র।”
“ভূত-ভূত-ভূতু-উ-উ-ম!”
“ওই শোন! ভূতের মতন ডাকছে।”
“চল, ফিরে যাই।”
“কেন, ভয় পেয়ে গেলি নাকি?”
“এই জঙ্গলে আসতে আমার ভাল লাগে না।”
“তুমি আবার চাও অ্যাডভেঞ্চার! অ্যাডভেঞ্চারকরতে হলে সাহস লাগে।”
“চাইই তো। তাই বলে জঙ্গলে আসতে হবে?”
“অ্যাডভেঞ্চারাস লাইফ যারা চায় তাদের জন্যঅজানা-অচেনা ভয়ের এলাকাই তো উপযোগী।”
শান্ত কোনো উত্তর দিতে পারে না। চুপটি করেশান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দুরন্ত বাঁশগাছে উঠল দানিয়ে।
একটা শিয়েল হুক্কা হুয়া করে ডেকে উঠল।
দুরন্ত মোটা মোটা কুঞ্চি কেটে নিয়ে নামে।তারপর দুজন মিলে কুঞ্চিগুলো টেনে নিয়ে যায়।একটা বনবিড়াল মাফ মাফ করে ডেকে উঠল। ওরাচমকে উঠে এদিক-ওদিক চায়। না, কিছু দেখা যায়না। আবার হাঁটতে শুরু করল। চারপাশে বনজঙ্গল।মাথার উপর বড় বড় গাছ ঝোপ মেলে দাঁড়িয়ে আছেমেঘের মত।
“কে?” হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠল দুরন্ত। তারবুকের ভিতর কাঁপছে। শান্তরও বুকের ভিতর ধড়ফড়করে ওঠে।
“কি হইছে?”
দুরন্ত পিছনে তাকায়। শান্তও।
“কই, কেউ তো নেই!”
দুরন্ত কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “কে যেন আমারজামা টেনে ধরল।”
“কই, কাউকে তো দেহিনে!”
শান্ত ভয়ে কাঁপতে লাগল।
“ভূত না তো?” দুরন্তর মনে প্রায় সব বিষয়ে সবসময় খুব সাহস, কিন্তু ভূতের বেলায় ভয়। শান্তরভূতের ভয় নেই। সে বলে, “ভূত বলতে কিছু নেই।”
“তাহলে আমার জামা টেনে ধরল কে?”
শান্ত ভাবতে লাগল। ভূত চোখে দেখা যায় না। সেসব সময় অদৃশ্য। মানুষের মনের মধ্যে লুকিয়েথাকে। তাকে আছে বললে সে আছে আর নেই বললেনেই। কিন্তু এখন শান্তরও খুব ভয় করছে। ভূত ছাড়াএই জঙ্গলে কে ওর জামা টেনে ধরবে।
তারা ভয়ে ভয়ে টালুমালু চায় আশপাশে। চারদিকেচায়। উপরের দিকে চায়। কিন্তু কই, কিছুই তো দেখাযায় না! চারদিকে শুধু বেতঝাড় বাঁশঝাড় নাটাগাছজামগাছ ইত্যাদি।
ভিতরে একটা বিচিকলার ঝাড় আছে। সেদিকেএগোয় ওরা। বিচিকলার গাছ খুব মোটা আর লম্বা হয়।এর কলাগুলোও খুব মোটা আর তার ভিতরে থাকেগিজগিজ করা বিচি।
“জানিস, এই কলা নিয়ে মজার মজার গপ্প আছে।” দুরন্ত বলল।
“কি গপ্প?”
“প্রথম আমলে কলাগুলো ছিল খুব ছোট। তা খেয়েরাজাদের তেমন সুবিধে হত না। একেকবার মুখেদেওয়ার জন্য চার-পাঁচটা করে কলা ছুলতে হত। এতকলা ছুলবে কে?
“রাজাদের তো চাকর-বাকরের অভাব ছিল না, কিন্তু চাকর-বাকরের হাতের ছোলা কলা কি আরখাওয়া যায়? তাহলে কি করা যায়? রাজার গুণী-জ্ঞানীলোকেরা তো মহা দুশ্চিন্তায় পড়ল! মন্ত্রীরা সব মাথায়হাত দিয়ে বসল। বসল তো বসলই।
“রাজার রাজকাজ সব অচল। আবার তার কলাখাওয়াও হচ্ছে না। রাজা অভিমান করল। মোটা মোটাবড় কলা ছাড়া আর খাবে না। সবাই খুঁজতে বেরোল।কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না মোটা মোটা বড় কলা।
“এই সময় এক ফকির এসে বলল, ‘কামরুক্ষাদেশে এক ফকির আছে। সে সবকিছু করতে পারে।’
“রাজা বলল, ‘সে কি ছোট কলা বড় বানাতেপারে?’
“ফকির বলল, ‘সে সব পারে।’
“রাজা তার মন্ত্রীকে বলল, ‘সেই ফকিরকে ডেকেআনুন।’
“মন্ত্রী বলল, ‘জ্বি, জাঁহাপনা।’ তারপরে একবার্তাবাহককে খবর দিয়ে পাঠাল সেই ফকিরেরকাছে। বার্তাবাহক টগবগিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলকামরুক্ষার পথে। পাহাড়, পর্বত আর জঙ্গলের পথ।দুর্গম পথ। চলা যায় না। ঘোড়া চলতে পারে না। তবুতাকে চলতে হবে। রাজার আদেশ। ফকিরকে সংবাদনা দিলে রাজা হয়ত তার মাথাটাই খেয়ে খাবে কলারবদলে।
“অনেক কষ্ট করল বার্তাবাহক। তারপর পৌঁছালসেই ফকিরের বাড়ি। ফকির তার ঝুলি কাঁধে বের হল।
“ফকির মন্ত্র পড়ে কলাগাছে ফুঁ দিল। আর কি।অমনি সব কলাগাছ হয়ে গেল বড় বড়। যেমন লম্বাহল তেমনি হল মোটা। বড় গাছের কলাও হল বড়আর মোটা।
“আগেকার ছোট কলায় বিচি ছিল না। কলা যেমনবড় হল তেমনি তার ভিতরে আসল বিচি। আরবিচিকলা খাওয়ার পর রাজার কি হল? তার পেটেরভিতরে হয়ে গেল কলার গাছ। এ তো মহা মুশকিল।ফকির তখন কি করল? আবার মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিলকলাগাছে। তখন কলার বিচি হয়ে গেল অবীজ। সেইথেকে কলার বিচিতে আর গাছ হয় না।”
“আষাঢ়ে গপ্প।”
“গপ্প তো গপ্পই।”
তারা গপ্প করতে করতে ভয়ে ভয়ে কলাগাছ কাটে।ভুতুম, শিয়েল, বনবিড়াল কোলাহল করে যাচ্ছে।ভুতুম বলছে, “ভূত-ভূত-ভূত-উ-উ-ম!” শিয়েল বলছে, “হুক্কাহু-উ-উ-! হুক্কা হুক্কা হুক্কা-আ-আ-আ হু-উ-উ!” বনবিড়াল বলছে, “মাফ! মাফ!”
তারা মোটা মোটা পাঁচটা গাছ কাটে। পাতাপুতি সবছেঁটে ফেলে একটা একটা কলাগাছ দুইজন ধরাধরিকরে টেনে নেয় ডোবার ধারে। শেষবার যখন তারাকুঞ্চিগুলো আর দা নিতে এল, তখন শিয়েলের গুমাখাল দুরন্তর হাতে। শান্ত হি হি করে উঠল।
তারা যখন গাছগুলো টেনে টেনে নিচ্ছিল তখনএকটা দুষ্টু শিয়েল এসে ঠিক কুঞ্চিগুলোর উপর হেগেদিয়ে গেছে।
শান্ত হেসে উঠলে দুরন্ত বলল, “জানিস, শিয়েলেরগু মাখলে কি হয়?”
“হাত পচে যায়। আবার পণ্ডিতও হওয়া যায়। তুইঅবশ্য পণ্ডিতই হবি।” মিটিমিটি হাসে শান্ত।
দুরন্ত বুঝতে পারে ওকে অত সহজে ঠকানো যাবেনা। ঠকাতে হলে ওর হাতেও শিয়েলের গু মাখিয়েদিতে হবে। কিন্তু তার মন সায় দিল না। সে সুতরাংগাছের পাতায় মুছে ফেলল। তারপর দুইজনকুঞ্চিগুলোর গোড়া ধরে টেনে নিয়ে গেল ডোবারধারে।
এখান থেকে একটা নালা চলে গেছে বিলের দিকে।ডোবার পাড়ে তারা কলাগাছ আর কুঞ্চি দিয়ে ভেলাবানায়। তারপর তললা বাঁশের আগা দিয়ে বানায় দুটোচোড়।
এবার ভেলাটা ঠেলে পানিতে ভাসাতে হবে।তারপর একবার বাড়ি গিয়ে ফুলকোচ আর লম্বা দানিতে হবে।
“শান্ত—ও—ও—!” রুবানার কণ্ঠ ভেসে আসছে।
দুরন্ত-শান্ত চকিতে ফিরে চায় বাড়ির দিকে।
“আমার মা না?” শান্ত বলল।
“হঅ, তাই তো মনে হচ্ছে।”
“শান্ত—ও—ও—!”
“ওই যে আবার!”
“যা, শুনে আয় কি কয়।”
“না, একবার গেলে আর আসতে দেবে না। আমিএই বাগানে দাঁড়ায় থাকি। তুই গিয়ে নিয়ে আয়সবকিছু।”
“আচ্ছা, তাই দাঁড়া।”
দুরন্ত এক দোড়ে বাড়ি যায়। বাগানের মধ্য দিয়ে।যাতে কেউ না দেখে। বাড়ি থেকে ফুলকোচ, জুতিআর একটা লম্বা দা নিয়ে আবার ফিরে আসে।তারপর কলার ভেলায় ভাসল দুই অভিযাত্রী।
ভেলা বেয়ে ডোবার নালা দিয়ে বিলে যায় তারা।বিরাট বিল। পানি থইথই করছে। বন্যার পানি এসেবিল ভাসিয়ে দিয়েছে। বিলের মাঝখানে, বহু দূরে, একটা ঝোপের মত দেখা যাচ্ছে।
“পানি নাকি বাড়ছে, এবার গ্রামও ভাসবে।”
“খুব মজা হবে, তাই না?”
“হুঁ। ঘরে বসেই মাছ ধরা যাবে।”
দেখতে দেখতে বিলের ভিতরে অনেক দূরে চলেযায় তারা। দক্ষিণি বাতাস বেড়ে যাচ্ছে।
“উজান ঠেলা কঠিন কাজ।” শান্ত বলল।
“হঅ! এ তো আর মার কোলে বসে বসে চাল ভাজাখাওয়া না!”
“তুই খুব পাকা পাকা কথা বলিস।”
“আমি কি তোর মত কচি খুকি?”
“খুকি বললি কেন?”
“আচ্ছা, খোকাই না হয় বললাম।”
শান্ত রেগে যায়। “খোকাও বলবি না।”
উত্তর দেওয়ার আর সুযোগ পেল না দুরন্ত। তারবুকের ভিতর ধড়াশ করে ওঠে। সামনে কুমিরের মতকি যেন একটা ভেসে আসছে। “কি রে ওটা?” ভয়েভয়ে বলল, “এদিকেই আসছে, তাই না?”
“হুঁউ!” শান্তও তাকায় সেদিকে। তারও বুকের ভিতরকেঁপে ওঠে।
দুজনই সেদিকে চোখ হিঙিয়ে শক্ত করে ভেলাধরে বসে পড়ল। যদিও তারা জানে, কুমির শুধুসুন্দরবনেই আছে।
কুমিরের মত জিনিসটা তাদের কাছাকাছি এগিয়েএল। তারপরে দেখা গেল, ওটা একটা মরা গরু। ওরাহাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
“একটা মরা গরু দেখে ভড়কে যাও আর তুমিআসো চিতল ধরতে!”
“তুইও তো!”
“তুইই তো। আমাকে তো তুইই ভড়কে দিলি। বাপরে! এখানে কত পানি! আমার চোড় মাটি পাচ্ছে না।”
“দেখছিস না চারপাশে কত পানি? মাটি পাবেকিভাবে?”
“শুধু চারপাশে না, নিচেও।”
“তুই একটা গাধা। নিচে মোটে আট-দশ হাত। আরচারপাশে কমপক্ষে দুই মাইল।”
চারপাশ আর নিচের মধ্যে কি একটা পার্থক্যআছে, শান্তর মনে হল। কিন্তু পার্থক্যটা কি বা কিধরনের তা সে বুঝে উঠতে পারে না। সে হার মানে।কিন্তু বলে, “চারপাশ আর নিচে কি এক হল?”
“একই তো! নিচেও যেমন দাঁড়ানোর জন্য মাটিপাওয়া যায় না, তলায় যেতে হয়, তেমনি এত দূরসাঁতার কেটেও চারপাশের কোনো পাশে যাওয়া যায়না।” দুরন্ত বলল। যদিও তার মনে সন্দেহ থেকে যায়।তার মনে হল, কথাগুলো ঠিক নাও হতে পারে।
একটা উঁচু ঢেউ তাদের দিকে খুব জোরে তেড়েআসছে। ভেলাটা যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। শান্ত ভয়েভয়ে বলল, “তলায় যাব রে! এবার তলায় যাব!”
“বাপ রে! ঢেউটা কি উঁচু!”
“নদীর কাছে চলে এসেছি, তাই না?”
“তাই তো মনে হচ্ছে!”
শান্ত তার চোড় রেখে দিল। ভেলার কুঞ্চি জব্দকরে ধরতে ধরতে বলল, “চোড় রেখে দে। কুঞ্চি ধরেবসে থাক!”
দুরন্ত তাই করল। আশপাশে তাকাল একবার।চারদিকে খালি পানি আর পানি। বিল-নদী ঘোলা-পানিতে একাকার।
শান্ত বলল, “আমার মত করে ধর!”
নদী গর্জে উঠল।
“দেখ, ঢেউটা কি রকম ফুলে ফুলে উঠছে!”
“হঅ! গোখরা সাপের মতন!”
“কেউ যেন তাকে খোঁচা দিয়েছে।”
“চোড়টা পা দিয়ে চেপে ধর!”
“এক হাত দিয়ে ধরেছিস কেন? দুই হাত দিয়ে ধর!”
“আমি তোর মত অত ভিতু না।”
শান্তর ভয় করতে লাগল। বলল, “ধর না! আমারমত করে ধর! দুই হাত দিয়ে কষে মুঠ করে ধর!”
দুরন্ত তখন কিছুতেই রাজি হয় না। কিন্তু পরেযখন ঢেউটা একদম কাছে এসে পড়ে, বাঘের মতগর্জে ওঠে, তখন তার টনক নড়ে। পা দিয়ে চোড়চেপে ধরে আর দুই হাতে কষে মুঠ করে ধরে ভেলারকুঞ্চি। অমনি এক দঙ্গল ঢেউ আছড়ে পড়ল তাদেরগায়ের উপর। খ্যাপা বাঘের মত আছাড় খায়। তাদেরনিয়ে ভেলাটা এমন করে উপরের দিকে লাফিয়েওঠে, বিলের পানি যেন পাগলা ঘোড়া। আবার তখনইঢাউস করে নিচে চলে যায়। ভূমিকম্পে যেমন করেবাড়িঘর মাটির নিচে চলে যায়।
তাদের পিলে চমকে যায় প্রথমে। তারপরে দুরন্তরমনে হল সে মরে ভূত হয়ে গেছে।
শান্তর মনে হল, আজরাইল তার জান কবচকরেছে। জানটা নিয়ে আল্লার কাছে চলে যাচ্ছে। তারমনে হল, আল্লা তাকে দোজখে পাঠাতে বলবে।কারণ, তার মনে হল, সে তো তার মার কথা সবশোনে না। তার খুব কান্না পায়। কান্না কান্না গলায়বলল, এখন থেকে সে সব সময় মা যা বলবে তাইকরবে।
হঠাৎ ফু-উ-উ-স করে ভেসে উঠল ভেলাটা।ঢেউয়ের নিচে থেকে। কিন্তু—! দুরন্ত কই?
ভয়ে কাঠ হয়ে যায় শান্ত। দুরন্ত কি ডুবে গেল? তার গা কাঁপতে থাকে। গলা শুকিয়ে যায়। তবু চিল্লায়, “দুরন্ত—ও—ও!” বারবার চিল্লায়, “দুরন্ত—ও—!”
ভেলার উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চারদিকে টালুমালুকরে তাকায় শান্ত। তার পা কাঁপতে থাকে। বেশিক্ষণআর দাঁড়াতে পারে না। বেশি জোরেও আর ডাকতেপারে না। এমন সময় দুরন্ত তার পিছন দিক থেকেখলবল করে এগিয়ে এল। তার নাম ধরে ডাকল।
দুরন্তর দিকে ভেলা নিয়ে এগিয়ে যায় শান্ত।
ভেলায় ওঠে দুরন্ত। একটু একটু লজ্জা করে তার।কোথায় তার বাহাদুরি। কিভাবে যেন হাতেরআঙ্গুলগুলো সব খুলে গেল! কিন্তু তাই বলে তো আরশান্তর কাছে ছোট হওয়া যায় না। সে একটা বুদ্ধি বেরকরল। গামছা চিপড়ে গা মুছতে মুছতে বলল, “তুইএকটা হাবা!”
শান্ত অবাক। “কেন?”
“আবার বলিস “কেন!” ঢেউ যখন ঝাঁকি মারলতখন যদি ভেলাটা উলটে যেত আর যদি তার নিচেচাপা পড়তি?”
“তা—তা—আর কিইবা করতে পারতাম?”
“এই জন্যই তো তোকে বললাম হাবা!”
“তুই কি করলি শুনি?”
“দেখতেই তো পাচ্ছিস। কুঞ্চি ছেড়ে দিয়ে আমিমাটিতে চলে গেছিলাম।”
“ইচ্ছে করে ছেড়েছিলি?”
“হুঁউ!”
“তারপর?” শান্তর চক্ষু চড়ক গাছ।
“তারপর আর কি, মাটি কামড়ে পড়ে থাকলামযতক্ষণ ঢেউ থাকল। তারপর উঠলাম।”
শান্ত তার বুদ্ধি দেখে সত্যি সত্যি অবাক হয়। তারচোখের দিকে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। “তাই তো, ঠিকইকরেছিস! এমন বুদ্ধি তো আমার মাথায়ই আসেনি।”
“সব সময় বুঝেসুঝে কাজ করতে হয়।” দুরন্তবলে। সে মনে মনে সুখ ভাঁজে। যাক! লজ্জা তো আরপেতে হল না!
আবার চোড় ধরে দুই অভিযাত্রী। অদূরে সেইঝোপ। শেওলা আর হোগলা-শোলার ঝোপ। যেখানেরুই চিতল শোল গজাল ভিড় জমায় বর্ষাকালে। কিন্তুলোকেরা কেউ সাহস পায় না সেখানে যেতে। সাপআর জোঁকের ভয়।
সেখানে একটা হিজল গাছও আছে। সেই গাছেএসে সাড়গুলো চাকা হয়ে ঝুলে থাকে। জোঁকেরামাছের পেটে মুখ বসিয়ে রক্ত খায়। সাপেরা ব্যাঙখেয়ে পেট চালায়। সেখানে এগিয়ে যায় শান্ত আরদুরন্ত।
ঝোপের কাছে এগিয়ে ওরা জুতি দা আর ফুলকোচনিয়ে তৈরি হয়। কোথা থেকে একটা লাশ ভাসতেভাসতে আসছে। তাকে খুচে খাচ্ছে একদল চিতল-গজাল। কি বীভৎস চেহারা হয়েছে লাশটার! ফুলেঢোল হয়েছে।
একটা ছোটখাটো ঢেউ এসে লাশটাকে ওদেরভেলার উপর তুলে ফেলল। গা শিউরে উঠার মতদৃশ্য। শান্ত তাকাল দুরন্তর দিকে, দুরন্ত তাকাল শান্তরদিকে। ওদিকে বেলা দুপুর হয়ে যাচ্ছে।
বাহার বেগম শান্তকে কোথাও খুঁজে পেল না। একবারবাড়ি গেল শান্ত এতক্ষণে ফিরে এল কিনা দেখারজন্য।
রুবানা প্রায় কেঁদে ফেলল। “আমার শান্ত! বেলাদুফোর হয়ে গেল। এখনও আসল না। কোথায় গেলতা আললায় জানে।”
বাহারও ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কত কাল দেখে না সেতার নাতিটাকে। আবারও দুরন্তদের বাড়ি গেল লাঠিভর দিয়ে।
শান্তর বাবা আমিন সরদার পাটের ব্যাপারি। পাশেরগ্রাম মঙ্গলগাঁয় পাট কিনে বাড়ি ফিরল দুপুরে।খেয়েদেয়ে যাবে রামপুরের হাটে।
কিন্তু রুবানা বলল, “সেই সকালে বার হইছে, আরখবর নেই!”
“ছেলেপেলে মানুষ। ছুটির দিন আজ। কোথায়খেলাধুলা করে বেড়াচ্ছে।” আমিন সরদার খেয়েদেয়েহাটে উদ্দেশে পা বাড়াল।
বাহার বেগম দুরন্তদের বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে ডাকল, “ও নিহার! নিহার লো!”
দুরন্তর মা ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বলল, “কিখবর, চাচি?”
“তোর ছায়াল অহনও আসেনি?”
“না। তাই তো ভাবতিছি। সেই সয়ালবেলা বারহইছে, আর দেহিছেন খোঁজ আছে নাকি?”
“কিসব ভাদামে ছায়াল-পায়াল তাই দেখ। সেইসকাল থেকে ঘুরতে ঘুরতে আমার মাজামোড় সবব্যথা হয়ে গেল। আর সে নেই তো নেইই। আবারওদিকি ওর মা তো কান্দাকাটি লাগাইছে। দুফোরগড়ায় গেল!”
“হঅ। দুফোরে খাতিটাতি তো আসফে, তাওদেখেন কোনো খবর নেই।”
মা মা করতে করতে দৌড়ে এল সাত-আট বছরেরএকটা ফুটফুটে মেয়ে। নিহারকে জড়িয়ে ধরল।নিহার তার আদুরে মেয়েকে আদর করতে করতেবলল, “তোর ভাইয়া কুহানে দেহিছির?”
“না। ভাইয়াটা খালি ভো ভো করে বেড়ায়।”
“উঃমা! এ মেয়ে তো দেখি পাকা পাকা কথা শিখেফেলিছে।” একটুখানি হেসে মেয়েটার গাল টিপে দিলবাহার বেগম।
মেয়েটি বলল, “আমি পাকা!”
“হঅ, তুমি পাকা বুড়ি! তুমি পেকে গেছ!” আবারহাসে বাহার বেগম।
নিহারের দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। কোথায় গেল ছেলেদুটো। বাহার বলল, “আমি অহন কি করি ক তোদেহি? ওদিকে ওর মা কান্দে। আর আমি অহনকুহানে যাব তারে তালাশ করতি?”
“কি যে কই আর কি যে করি, আমি তো কিছুইবুঝতে পারছি নে।”
“দেহি, আমি দেহি ওই পাড়ায় একটা ঘুরলি দিয়েআসি সব জাগা।”
বাহার আবার বের হল। নিহার মেয়ের মাথায় হাতবোলাতে বোলাতে বলল, “তোর ভাইয়া কুহানে কতো?”
“ভাইয়া আমাকে যা রাগ করে!”
শিলা মুখ ভার করল। ফ্রকের ফিতে ধরে একটাআঙ্গুলে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে খুলতে লাগল। নিহারমেয়ের দিকে আদরমাখা চোখে তাকাল একবার।
সাপের বাসায় চিতল মাছ ২ / তারেক খান
দ্বিতীয়
Leave a Reply