রেহানা খালার জন্য সবার একটা টান। এত নরম একটা মানুষ। কথা বলেন গলা নামিয়ে। খুব বেশি আওয়াজ পছন্দ করেন না, নিরিবিলি থাকেন। সারাক্ষণ কী জানি ভাবেন, কেউ ডাকলে প্রথমে অনেক সময় খেয়াল করেন না। পরে ঠিকই খেয়াল করেন। ওনার সঙ্গে কথা বলতে হয় গলা উঁচিয়ে। কিন্তু উনি ঠিকই গলা নামিয়েই জবাব দেন।
সাইমনের অফিসে ভালো লাগে, পার্টিতে ভালো লাগে, দাওয়াতে ভালো লাগে। কিন্তু নিজের বাসায় কারও কথা শুনতে খিটখিট লাগে। বাইরে সবাই এত ভালো করে কথা বলে, বাসায় সব ম্যাঁও ম্যাঁও। কী যে বলে বোঝাই যায় না। হেডফোনে গান শুনতে ভালোবাসে সে। আজকাল আবার স্মার্টফোনগুলোর হয়েছে এক জ্বালা। ভলিউম বাড়িয়ে শুনতে নিলেই ওয়ার্নিং মেসেজ দেখায়। অথচ কম ভলিউমে শুনে কি কোনো মজা আছে?
তারিনের প্রেগন্যান্সিতে কানে একটু অস্বস্তি ছিল। পরে সেটা চলে যায়। আজকাল আবার কানের ভেতর কেমন জানি মেশিন চলার বা কেটলিতে পানি ফোটার শাঁই শাঁই আওয়াজ হয়। হঠাৎ হঠাৎ আজকাল মাথাটাও কেমন জানি চক্কর দিয়ে ওঠে।
রেহানা খালা, সাইমন বা তারিনের ক্ষেত্রে ভালো করে খেয়াল করুন। নিচু গলায় কথা বলা রেহানা খালা গলা নামিয়ে কথা বলেন, কারণ উনি ওনার নিজের গলার স্বর বড় করে শুনতে পান। সাইমন কোলাহলে ভালো শোনে, কারণ ওখানে সবাই উঁচু গলায় কথা বলে। আর বাসায় স্বাভাবিক স্বরে কথা বলে বিধায় সে ঠিকমতো শুনতে পায় না, আর তার মেজাজ খিঁচড়ে যায়। এদিকে আবার হেডফোনে চড়া সুরে গান শুনতে ভালো লাগে। অর্থাৎ তার অগোচরেই আস্তে আস্তে কানে কম ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ শোনার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। আবার তারিনের ক্ষেত্রে বাড়তি একটা শব্দ শোনার সমস্যা তৈরি হয়েছে, যাকে টিনিটাস বলা হয়। এ ছাড়া মাথা ঘোরানোটাও আছে। এই যে সমস্যাগুলো, কারও কারও ক্ষেত্রে সব কটি বা কারও কারও ক্ষেত্রে কয়েকটি থাকলেই যে রোগের আশঙ্কা আছে বলে মনে করা হয়, তাকে বলা হয় অটোস্কলেরোসিস (Otosclerosis)।
অটোস্কলেরোসিস কী? আমাদের কানের ভেতর রয়েছে দেহের সবচেয়ে ছোট তিনটি হাড়—ম্যালিয়াস, ইনকাস ও স্টেপিস। এই স্টেপিসের রয়েছে একটি ফুট প্লেট। অর্থাৎ পায়ের কাছটায় বাটির মতো একটা অংশ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই ফুট প্লেটটি শুধু অথবা এই তিনটি হাড়ের সব কটিরই গঠনগত পরিবর্তন হওয়া শুরু হয়। এই পরিবর্তনের ফলে হাড়গুলো স্বাভাবিক অবস্থার মতো শব্দ পরিবহন করতে পারে না। এরপর আস্তে আস্তে বধিরতা বাড়তে থাকা, টিনিটাস, মাথা ঘোরানো ইত্যাদি শুরু হয়।
অটোস্কলেরোসিসের চিকিৎসা কী? এখন পর্যন্ত এমন কোনো ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি, যা দিয়ে এই রোগ থেকে পুরোপুরিভাবে আরোগ্য লাভ করা যায়। অল্প যে কয়েকটি ওষুধ আছে, যেগুলো ব্যবহার করে এই রোগ যাতে আর না বাড়ে বা দুই কানেই যাতে না হয়, সেই চেষ্টা করা যায়। এতে সমস্যা হলো, ঘন ঘন চিকিৎসকের কাছে আসতে হয়, পরীক্ষা–নিরীক্ষা করাতে হয়, যা সময়সাপেক্ষ, ব্যয়সাপেক্ষ তো বটেই।
অপরদিকে বর্তমানে এ দেশেই এর সার্জারি হচ্ছে। ঢাকাতেই বেশ কয়েকটি হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা সফলতার সঙ্গে সার্জারি করে আসছেন দীর্ঘদিন থেকে। এই সার্জারিতে আক্রান্ত হাড় ফেলে দিয়ে তার জায়গা গ্রাফট বা প্রোস্থেটিক বসিয়ে দেওয়া হয়। এতে দুটি উপকার হয়। প্রথমত, আক্রান্ত হাড় ফেলে দেওয়ার ফলে রোগটিকে দেহ থেকে দূর করা যায় এবং দ্বিতীয়ত, শ্রবণশক্তি কিছুটা হলেও ফিরিয়ে আনা যায়।
নিজের প্রতি যত্নবান হোন। কানের যেকোনো সমস্যা হালকাভাবে নিতে নেই। শ্রবণশক্তি কমে আসার ক্ষেত্রে একটা বাজে দিক হলো, নিজে নিজে এটা বোঝার উপায় কম। আস্তে আস্তে এই পরিবর্তনটা বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে গুরুতর আকার ধারণ করে। তাই যখনই স্বাভাবিক কথাবার্তার শব্দে আপনার মেজাজ খিটখিটে লাগবে, নিচু গলার কথাবার্তা বিরক্ত লাগবে, আপনার সঙ্গে কথা বলতে এলে কাউকে বারবার একই জিনিস বলতে হবে, ইলেকট্রনিক ডিভাইস আপনাকে কোনো ওয়ার্নিং মেসেজ দেখাবে, টিনিটাস বা মাথা ঘোরানো বাড়বে—তখন বিন্দুমাত্র দেরি না করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। কোথায়, কার কাছে দেখাবেন, তা বুঝতে না পারলে অন্তত একজন জেনারেল ফিজিশিয়ান দেখান।
ভালো থাকুন।
Leave a Reply