নিজের লাভের জন্য গণতন্ত্র নয়

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ

প্রথম আলোর সঙ্গে এমাজউদ্দীন আহমদের সাক্ষাৎকারের সারাংশ

মোঃ খাইরুল ইসলামঃ গত ৫ মে ২০১৯ইং তারিখ রোববার, দৈনিক প্রথমআলোতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ এর একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। যাতে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে ৫ মে একটি যুগান্তকারী দিন ছিল। শাপলা বিপ্লবে ইসলামী চেতনার একটি আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে বাংলাদেশের ইতিহাসে। আমি যে পত্রিকাটি পড়ি তাতে অবশ্য শাপলা বিপ্লব সম্পর্কে একটি লাইনও এদিন লিখলনা বা আমার চোখে পড়েনি।

যা হোক এমাজউদ্দীন আহমেদর সাক্ষাৎকারের একটি সারাংশ দাড় করার ক্ষুদ্র প্রয়াসে মূলতঃ প্রথমে কলম ও পরে নিজেই কম্পোজ করেছি। আমার এই অতি উৎসাহের বা কষ্ট করারর কারণ হলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ তিনি জাতিকে দিয়েছেন। আর আমারও লেখালেখির অভ্যাসটা একটু ঝালিয়ে নেওয়ারও সুযোগ হলো। যদিও কলামিস্ট বা বড় লেখ হওয়ার যোগ্যতা হয়ত কোনদিন হবে না।

প্রথম আলোর সাথে সাক্ষাৎকারে এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্রহীনতার কারণ হলো- গণতন্ত্রের সৌন্দর্য হচ্ছে রাষ্ট্র থেকে সরকার এবং রাষ্ট্র ও সরকার থেকে দল আলাদা থাকবে। বর্তমান বাংলাদেশে এসব আলাদা নেই। এর অন্যতম কারণ হলো দেশে এখন আমলা তথা সরকারী কর্মকর্তা নিয়োগ হয় দলীয় আনুগত্য দেখে। অথচ মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ হওয়ার কথা। এখানে একথা যোগ করলে অত্যুক্তি হবে না যে, সরকারী চাকুরী নিয়োগের জন্য যে ভেরি ফিকেশন হয়, তাতে নিয়োগকামী প্রার্থী বা তার পরিবার কোন দল করেন তা আগে খুঁজ নেওয়া হয়, যা কখনোই কাম্য নয়। কারণ দল করা মেধার যোগ্যতা নয়। অথচ তা-ই হচ্ছে। ফলে আমলারা জনগণের নিকট জবাবদিহি না হয়ে নিয়োগকর্তার নিকট দায়বদ্ধ হয়ে পড়েছেন।

এমাজউদ্দীন আহমদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্যের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে অতীত স্মরণ করেন এভাবে যে, স্বাধীনতা লাভের তিন বছর না যেতেই জাতি গণতন্ত্র ধারণ করতে পারল না। একদলীয় শাসন কায়েম হলো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রতি বলেছেন, বাকশাল কায়েম হলে ক্ষতি কী ছিল! বক্তব্যটির এভাবেই অর্থারোপের চেষ্টা করেন।

এ মুহুর্তে আমার একটি বইয়ের কথা মনে পড়ছে। যদ্যপি আমার গুরু বইয়ে জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে আহমদ ছফা প্রশ্ন করেছিলেন তার প্রেক্ষিতে দেওয় উদ্বৃত্তিটা এখানে তুলে ধরতে পারার লোভটি সংবরণ করতে পারলাম না। তাই সম্পূর্ণ প্যারাটি হুবহু পাঠকের বুঝার সুবিধার্থে তুলে ধরছি, যা এই আলোচনাকে আরো প্রাণবন্ত করে তুলবে আশা করি।

“জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক স্যারের শিক্ষা সম্পর্কিত আলোচনা শেষ হলে আমি (লেখক আহমদ ছফা) শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে স্যারের মতামত জানতে চাইলাম। তখনও শেখ সাহেব বেঁচে আছেন। স্যার একটু নড়েচড়ে বসলেন। তারপর বললেন নাইনটিন সিক্সটি নাইন থেইক্যা সেভেনটি ওয়ান পর্যন্ত সময়ে শেখ সাহেব যারেই স্পর্শ করছেন, তার মধ্যে আগুন জ্বালাইয়া দিছেন। হের পরের কথা আমি বলবার পারুম না। আমি গভর্মেন্টের কারও লগে দেখা সাক্ষাৎ করিনা। সেভেন্টি টুতে একবার ইউনিভার্সিটির কাজে তাঁর লগে দেখা করতে গেছিলাম। শেখ সাহেব জীবনে অনেক মানুষের লগে মিশছেন ত আদব লেহাজ আছিল খুব ভালা। অনেক খাতির করলেন। কথায় কথায় আমি জিগাইলাম, আপনের হাতে ত অহন দেশ চালাইবার ভার, আপনে অপজিশনের কী করবেন। অপজিশন ছাড়া দেশ চালাইবেন কেমনে। জওহরলাল নেহেরু ক্ষমতায় বইস্যাই জয় প্রকাশ নারায়ণরে কইলেন, তোমরা অপজিশন পার্টি গইড়্যা তোল। শেখ সাহেব বললেন, আগামী ইলেকশনে অপজিশান পার্টিগুলা ম্যাক্সিমাম পাঁচটার বেশী সীট পাইব না। আমি একটু আহত অইলাম, কইলাম আপনে অপজিশনরে একশো সীট ছাইড়্যা দেবেন না? শেখ সাহেব হাসলেন। আমি চইল্যা আইলাম। ইতিহাস শেখ সাহেবরে স্টেটম্যান অইবার একটা সুযোগ দিছিল। তিনি এইডা কামে লাগাইবার পারলেন না।(যদ্যপি আমার গুরু আহমদ ছফা, মাওলা ব্রাদার্স প্রকাশনী, পৃষ্ঠা নং ৭৩)”

বর্তমান শাসক দলের কথাবার্তার আলোকে এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, একটাই দল ক্ষমতায় থাকবে আমরা সম্ভবতঃ এমন একটা অবস্থায় চলে গেছি। কিন্তু এ অবস্থা এক সময় টিকবেনা। ঐ গণতন্ত্রেই ফেবৎ যেতে হবে। কেননা সুশাসনের ভিত্তিতে স্বশাসন মানে গণতান্ত্রিক ব্যবহার দরকার পড়বে। আইনের শাসনের রাজত্ব লাগবে। যদি ব্যক্তির ইচ্ছা বা খেয়াল খুশির প্রাধান্য থাকে তাহলে অগ্রসর হওয়ার পথ দেখছেননা বলে এমাজউদ্দীন আহমদ উল্লেখ করেন। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে উন্নতি দেখছি তাকে সংহত করতেও স্বশাসন লাগবে। জবাবদিহিতামূলক আমলাতন্ত্র থাকলেই সংবিধানে যে জনগণের মালিকানা লেখা আছে সেটা কায়েম হবে।

যে প্রশ্নটির কারনে আমি এই লেখাটির সারাংশ করছি তাহলো ইতিহাস কী এটাই বলে যে, সুশাসন শাসকের অনুকম্পার বিষয়? প্রশ্ন কর্তা  মিজানুর রহমান খান পাঠকের মনে ধাক্কা দেওয়ার মতই প্রশ্ন করেছেন। এই জায়গায় এমাজউদ্দীন আহমদ অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় বলেছেন, নিজের লাভের জন্য গণতন্ত্র নয়। রাজনীতি হলো সৃজনশীল প্রক্রিয়ায় জাতীয় অগ্রগতি সাধন। এর বাইরে যা রাজনীতির নামে ঘটে তা রাজনীতি নয়।

গত ১০ বছরে অনেক কারসাজি ঘটেছে। বিশ্বকে বোঝানো হয়েছে ২৯ ডিসেম্বর নয় ৩০ ডিসেম্বর ভোট হয়েছে। বাংলাদেশে সম্প্রতি একটি ঘটনাকে তিনি খুব আশান্বিত করে বলেছেন, রাজনীতিতে মেরুকরণ হবে। ইতিমধ্যে ডাকসু নির্বাচনে সেই মেরুকরন শুরু হয়েছে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এমাজউদ্দীন তার বক্তব্যে এমন একটি বিষয় উল্লেখ করেছেন, যাতে রাজনীতিবিদদের বিবেক নাড়িয়ে দেয়। তাহলো রাজনৈতিক সহকর্মীদের বা প্রতিপক্ষের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব। তিনি আশা প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া দুজন দীর্ঘ পথচলায় বাজনৈতিক সহকর্মী। এখানে একজন আরেকজনকে সুযোগ করে দিলে রাজনীতির জন্যই মঙ্গল। দেশের জন্য মঙ্গল হবে। দোষের কিছু নয়। যেহেতু খালেদা জিয়া অপেক্ষাকৃত প্রবীণ অসুস্থ্য সহকর্মী। এখানে এমাজউদ্দীন অত্যন্ত সুন্দরভাবে প্রতিপক্ষ রাজনীতিককে সহকর্মী হিসেবে ভাবার সুযোগ সৃষ্টি করেছেন বলে আমি মনে করি।

পরিশেষে আমার মতামত হলো, এমাজউদ্দীন আহমদ আমলা বা প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা নিয়োগে দলীয় করনের যে প্রসঙ্গটি টেনেছেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, রাজনীতিবিদ বা এমপি মন্ত্রীরা ক্ষণস্থায়ী। আর আমলারা দীর্ঘদিন প্রজাতন্ত্রের সেবায় নিয়োগ পান। তারা হবেন মেধার বা যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রাপ্ত। এসব আমলারা যদি দলের আনুগত্য করেন তবে প্রজাতন্ত্রের জনগণের সাথে তা হবে প্রতারণার শামিল। অর্থাৎ আমলারা দলীয় আনুগত্যের অধীনে না থেকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও রাষ্ট্রের বা জনগণের কল্যাণে কাজ করবেন। সবশেষে হৃদয়ে বাংলাদেশ এই হউক আমাদের সবার স্লোগান।

(সমাপ্ত)

সাক্ষাৎকারটি পেতে প্রথম আলোর অনলাইন লিংকে যানঃ
https://www.prothomalo.com/opinion/article/1592261/





About Md. Khairul Islam 7 Articles
মোঃ খাইরুল ইসলাম ইতিহাস বিভাগে অধ্যয়ন করেছেন ময়মনসিংহের প্রখ্যাত আনন্দ মোহন কলেজে। তিনি পড়ালেখা অবস্থায় লেখালেখির সাথে যুক্ত রয়েছেন। ফেসবুকে নানান ধরণের লেখালেখি করে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। তিনি সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে বেশ ভালভাবেই যুক্ত রয়েছেন। ফেসবুক ব্যবহার করে সামাজিক উন্নয়নমূলক প্লাট ফর্ম তৈরি করেছেন। ঈদ্গাহ বন্ধু সমাজ(ইবিএস) সংগঠনের চীফ কোঅরডিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পোশাক শিল্পে মানবসম্পদ ও প্রশাসন বিভাগে একটি কারখানায় সহ ব্যবস্থাপক হিসেবে চাকুরী করেন।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*