ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাকে নিয়ে গত কয়েক দিন থেকে সমগ্র বাংলাদেশে আলোচনার ঝড় বয়ে চলছে । দ্বিতীয়বারের সুযোগ চেয়ে ভর্তিচ্ছুদের যে চলমান আন্দোলন সেই আন্দোলনের খুঁটিকে ভাঙ্গতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন স্ব-নিরাপত্তাবাহিনী দিয়ে তাদেরকে একদফা পিটিয়ে নাকে চুবানি দিয়েছে।
আর সেই ঘটনার পর থেকে পত্রপত্রিকা থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও বাদ পড়েনি এই আলোচনার ছোবল থেকে। পক্ষে কিংবা বিপক্ষে যুক্তির যৌক্তিকতা দেখে স্ট্যাটাস লেখার শক্তি ফুরিয়ে ফেলছি বটে তবে অণুকম্পার তারণায় না লিখে থাকতে পারলাম না।
বাংলাদেশের ৩৪ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় মাধ্যমে প্রতি বছর যে পরিমাণ শিক্ষার্থী ভর্তি করান তার তিনগুন ভর্তিচ্ছু আসন স্বল্পতা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বাদ ভুলে যান। তারপরও কয়েকশ থেকে কয়েকটি শিক্ষার্থীর সাথে প্রতিযোগিতা করে নিজেদের আসন রক্ষা করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা চালিয়ে আসছে তারা। এইগুলো গদবাঁধা কথা কিন্তু মূল কথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ নিয়ে।
এই বিশ্ববিদ্যালয়কে মুরব্বি মেনে চলা অন্যন্য লঘু মুরব্বিরা তা অনুসরণ করে কি না তা নিয়ে। আমি কোন জ্যাঠামি পছন্দ করি না। মোদ্দা কথা হঠাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তটি কেন আসলো আর এর ফলাফলই বা কি সেটা নিয়ে।
প্রথমে আলোচনায় আসি দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষার পক্ষে বিপক্ষে যুক্তিগুলোর বিষয়ে এরপর দেখা যাবে মূল আলোচনা।
পক্ষে যুক্তি
১. এইচএসসি পরীক্ষায় উর্ত্তীন্ন শিক্ষার্থীদের তুলনায় ঢাবির আসন কম তাই দ্বিতীয়বার পরীক্ষায় চান্স পাওয়ার সুযোগ বেশি।
২. ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের কাঠামোর জন্য এইচএসসি পরবর্তী স্বল্প সময়ে প্রস্তুতি সম্পূন্ন হয়ে উঠে না।
৩. ভর্তি পরীক্ষায় ভাল প্রস্তুতি থাকায় প্রতি বছর ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থীয় দ্বিতীয়বার চান্স পায় সেহেতু প্রথমবারের সুযোগটা অনেকটা নেই ভেবে গদবাঁধা ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ
৪. গ্রামের অনেক শিক্ষার্থী মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও প্রথমবার প্রশ্নপত্র সম্পর্কে ধারণা ক্ষীণ থাকায় চান্স না পেলেও দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষায় ভাল করে ফলে গরীব-মেধাবী শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষা অর্জন করতে পারে।
৫. দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেয়ে অনেকে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন এখন দ্বিতীয়বারের সুযোগ না রেখে দেয়ার সিদ্ধান্ত যদি নেয়া হয় তাহলে ওইসব শিক্ষকদের চাকুরিচ্যুত করার যৌক্তিকতা রাখে।
৬. প্রথমবার যারা চান্স পায় না তাদের মধ্যে অনেক বিত্তবানের সন্তানরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ায় ঢাবিতে মূলত নিন্ম ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা পড়ালেখার সুযোগ পাবে।
৭. বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ভর্তি ফরমের ব্যবসা থেকে অর্জিত অর্থ থেকে বঞ্চিত হবেন
বিপক্ষে যুক্তি—
১. মোট আসনের চেয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে বেশি শিক্ষার্থী পাশ করায় চলমান শিক্ষার্থীদের ভর্তি হওয়ার সুযোগ।
২. কোচিং বিদ্যার অভিশাপ থেকে মুক্তি দিয়ে বাবা-মার অর্থকে সঞ্চয় করণ।
৩. দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেয়া সময় সাপেক্ষ ও প্রস্তুতি নিতে ভর্তিচ্ছুদের পরিবারকে অনেক অর্থ ব্যয় করতে হয়।
৪. শিক্ষা বিরতি কমানো যাবে ফলে দ্রুত বের হয়ে কর্মসংস্থানে যোগ দিতে পারে।
৫. তুলনামূলক কম ভর্তির আবেদন পড়বে ফলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করতে হিমসিম খেতে হবে না।
৬. দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার জন্য গ্রাম থেকে আসা মেধাবী তরুণ টাকার অভাবে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে না তার অবশান হবে।
কথাগুলো আপাতমস্তুক সত্য না হলেও পক্ষে বিপক্ষেদের এইসব যুক্তি ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি এইসব যুক্তি আশে পাশে নেই। সরল কথা বলতে গেলে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা নেয়ার পিছনে কিংবা না নেয়ার পিছনে কোন যুক্তি খণ্ডাতে রাজি নই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজ ঘোষণা করেছে কাল হয়তে রাবি, চবি জাবিরা করবে যেমনটি হয়েছিল ২০০৭ বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায়। এরপর থেকে অন্যান্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও একই শাসনে শাসিত হয়ে আসছে।
কিন্তু দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেয়া-নেয়ার লাভ ক্ষতি যেমনই হোক না কেন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার কোন পথে হাটছে সেই কথায় ভাবা মূখ্য জরুরী। প্রথমবার কিংবা দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে যেমন কয়েক হাজার শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে ঢাবির ইংরেজী বিভাগে ২জন সৌভাগ্যবানদের আটকাতে পারেনি তেমনি স্ব-ঘোষিত প-িতদের পা-ত্বময় প্রশ্নপত্র আটকায়নি। ভর্তি পরীক্ষায় যে প্রশ্নপত্র করা হয়েছে সেটি এইচএসসি ফল পরবর্তী দেড় মাসের প্রস্তুতিতে কথা যথার্থ ছিল তা ভাবার প্রয়োজন।
মূল প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের পরিবর্তন কোথায় দরকার? গুনগত শিক্ষার চেয়ে যেমন পরিমাণগত শিক্ষার তুলণা করে রাত পার করা যায় ঠিক তেমনি ভর্তি পরীক্ষার নাড়ি-নক্ষত্র ভেঙ্গে দিয়ে মাসের পর মাস তর্ক করা যায়। উচ্চ শিক্ষায় আমরা একধাপ এগিয়ে গেছি যেমন কথাটি সত্য ঠিক তেমনি দুই ধাপ পিছিয়ে পরেছি সেই কথাটিও সত্য।
২০১৪ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় পাশের হার যেমন ৭৮ দশমিক ৩৩ ভাগ পাওয়া গেছিল ঠিক তেমনি উচ্চ শিক্ষায় ভর্তি হতে সুযোগ মেলনি প্রায় ৭৫ শতাংশ। এই সাড়ে ৩ শতাংশ ভর্তিচ্ছুদের ভর্তি করিয়ে গর্ব করে যেমন উজির নাজিররা মুখে ফেনা তুলে ফেলছে ঠিক তেমনি দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ভর্তিচ্ছুরা আনন্দ অশ্রু বিসর্জন করছে। আর বাকী ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় দ্বিতীয়বার সুযোগ চেয়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে পরিমানগত গুনধর কথিত শিক্ষার্থীদের হাত মার খেয়ে চান্সকৃতদের মত অশ্রু বিলিয়ে বেড়াচ্ছে।
মূল সমস্যা সমাধান না করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কেন এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তা তারা ভাল বলতে পারবে তবে আমরা যারা আমজনতা কিবোর্ডে খট খট শব্দ করে নিজেদেরকে নিজের খেয়ে রাখাল ভাবি তাদের কাছে
দ্বিতীয়বার পরীক্ষা নেয়ায় বাবা-মার অর্থ যেমন লোপাট হয় তেমনি একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে মূল্যবান একটি বছর আত্বগোপন করে সেই জায়গা থেকে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেয়ার রীতি তুলে নেয়া যেতে পারে তবে
১. যে বছর দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হবে না ঠিক দুই বছর আগে থেকে যেন ঘোষণাটি দেয়া হয় যেতে পারে।
২. ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কৌশলের পরিবর্তন আনা যাতে করে মেধার মূল্যায়ন হয়।
৩. জিপিএ দিকে না তাকিয়ে আবেদনের যোগ্যতা ঠিক রেখে এইচএসসি ফলাফলের ওপর অর্পিত পূর্ণমান তুলে দিয়ে কেবল ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল সামনে আনা
৪. ফলাফল প্রকাশের পর অন্তত ৩ মাসের প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ রাখা।
৫. বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসন সংখ্যা বাড়ানো যেতে পারে।
৬. এইচএসসি সিলেবাসে সংস্কার আনা যাতে করে ভর্তি পরীক্ষার মতো যেকোন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। যাতে পরিমানগত শিক্ষার পাশাপাশি গুণগুত মানও বাড়ে।
মন্দকর বিষয় হলো যে আমাদের চিল্লাচিল্লিতে তাদের কর্ণের মধ্যমাংশে পৌঁছাবে না। কারণ তারা তো বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা শেষ করেছেন আর তাদের সন্তানরা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে লেখাপড়া করতে গেছে। তারা তো দ্বিতীয়বারে সুযোগ নিয়ে মস্তিষ্কের লিপিড ভাঙ্গেবে না। এরপরও অবোধগম্য বিষয় নিয়ে আমার কয়েকটি প্রস্তাবণা তুলে ধরলাম।
মূল লেখক : নাদিম মাহমুদ
শিক্ষার্থী : ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান
সাবেক শিক্ষার্থী, রাবি
সাংবাদিক
পূর্বে প্রকাশিতঃ ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম
Leave a Reply