বাবা এখন মুক্তিযুদ্ধের গল্প আর বলে না।

সময় ঠিক রাত ১২.১৫ সময়টা নিদিষ্ট করে বলতে পারছি কারন হাত ঘড়িটা নষ্ট হয়ে গেছে বলে পকেট থেকে মোবাইল বের করে সময় দেখলাম। আজকের রাতটা অন্যরকম লাগছে ঠিক কেমন লাগছে তার ব্যাখ্যা আমি দিতে পারব না।

প্রতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহ আমি বাড়ি যাই কারণ আর এক সপ্তাহ পর মাস শেষ তাই বাড়ি থেকে সকল খরচের টাকা নিয়ে আসি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়ন করি বলে অনেকেই মেধা নিয়ে প্রশ্ন তুলে। বাড়িটা আমার সিলেট শহরে, এই শহরটা আমার কখনোই ভালো লাগেনাই কারণ শহর বলতে বুঝেছি ঢাকাকেই। রাজধানী ঢাকার এই তীব্র যানজট আমার খুব ভালোলাগে মনে হয় কিছুক্ষণ এর জন্য শহরটা থমকে গেছে। বাড়ির মেঝো ছেলে বলে আদর যত্ন সব দুই দিয়ে ভাগ হয়ে যায়। আমারা ভাই বোন চার জন। বোন সবার বড় এরপর আমরা তিন ভাই। বোন বড় বলে কখনো মায়ের ভূমিকা পালন করে যদিও হয় না তবুও তার তীব্র চেষ্টা। বাবা ব্যাবসা করতো এখন আর কিছু করে না, কিছু না করলেও পরিবারে অভাব কি জিনিস তা ১২.১৫ এর আগে জানতাম না।

বয়সটা আমার বেশী না এই দেশটার শুরু থেকে দেখি নাই মুক্তিযুদ্ধ আমার জন্মের আরো ১৯-২০ বছর আগে। ছেলে সন্তান ছিলাম বলে বাবা প্রথম খেলনাটা একটি গাড়ি ও বন্দুক কিনে দেয়। হিন্দি কোনো সিনেমার এক ভিলেনকে দেখিয়ে বাবাকে বলে ছিলাম বাব দেখো আমাকে ওই ভিলেনটার মতো লাগছে না? বাবা বলেছিল না তোমাকে মুক্তিযোদ্ধার মতো লাগছে। বুঝিনাই মুক্তিযোদ্ধা মানে কি ওই বয়সে বুঝার কথা না। এরপর যতবার মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনেছি অধিকাংশ বাবার মুখে। গল্প বলার সময় বাবার এক আলাদা অঙ্গভঙ্গি করতো কখনো চোখে মুখে তাঁর তীব্র রাগ আবার কখনো মুখে হাঁসি তবে হ্যাঁ গল্পের শেষটা হতো উচ্চ হাসি দিয়ে।

১২.১৫ মোবাইলে ফোন আসলো সিলেট শহরে আমাদের সর্বশেষ যেই জমিটা ছিল তা বিক্রি ব্যবস্থা হয়েছে। বাবা এই জমিটা কিনেছিলো আমাদের ভাই বোনদের জন্য কিন্তু তা আজ বাবার চিকিৎসা জন্য লাগবে। বিগত পাঁচ মাস ধরে বাবা অসুস্থ, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন। বাবা বর্তমানে ঢাকার এক পাঁচতারা হাসপাতালে আছেন। পাঁচতারা হাসপাতালে চিকিৎসা করার মতো অর্থ বা সাহস কোনটি আমাদের নাই। তবে ডাক্তার সাহেবের প্রতি আমাদের ভরসা অটুট। তিনি যাই বলছেন আমারা তাই করছি। পাঁচতারা হাসপাতালে বাবার চিকিৎসার দ্বিতীয় ধাপ। প্রথম ধাপ ছিলো সরকারি হাসপাতাল, আমার পরিষ্কার মনে আছে বাবাকে যেইদিন প্রথম হাসপাতালে নিয়ে যাই দালালের ভীড়ে কে ডাক্তার কে দালাল আমার চিনতে ঘণ্টা দুই এর মতো সময় লেগেছে। বাবার যেই মাটি নিয়ে গর্ব ছিলো সেই মাটিতে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলো এক দিন। পরবর্তীতে বেড দিলেও ভয়ে ছিলাম দালালেরা কখন বুঝি নামিয়ে দেয়।

হাসপাতালে ছয় দিন ছিলাম, এই ছয় দিনে ছয় হাজার বার বাবা যে মুক্তিযোদ্ধা তাঁর পরিচয় দিয়েছি। আমার মনে হয়ছে মুক্তিযোদ্ধা বাবাদের চিকিৎসা বুঝি এইভাবেই হয়। যখন দেখলাম নির্দিষ্ট চিকিৎসা হচ্ছে না তখন শুধু-শুধু মশার কামড় খাবার মানে নেই। বাবাকে বাসায় নিয়ে গেলাম। আসলাম ঢাকায় গেলাম সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে, কিন্তু ব্যক্তিগত চেম্বার ছাড়া কেউ চিকিৎসা দিচ্ছে না। তাই এই নিয়মের উর্ধ্বে মুক্তিযোদ্ধারাও নয়। লম্বা লাইন ও সিরিয়াল পেরিয়ে রাত এগারোটায় বাবার নাম ডাকা হলো তাৎক্ষণিক আমার মনে হলো স্কুলের বার্ষিক ক্রিয়া প্রতিযোগিতায় বাবা প্রথম স্থান অধিকার করেছে। ডাক্তার সাহেব তার মূল্যবান পাঁচ মিনিট সময় ব্যয় করে বেল চাপ দিলেন পরবর্তী রোগী পাঠানোর জন্য। ডাক্তার সাহেব খুব দ্রুত তার সম্মানী চেলেন, আমি খুব দ্রুত তার সম্মানী প্রদান করলাম। ডাক্তার সাহেবের সম্মানী রাখার ঝুড়ি দেখে আমার মনে হয়েছিল এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ফান্ড।

এইভাবে বেশ কিছুদিন কেটে গেলো অনেক চিকিৎসা হলো, আবার ঢাকার একটি পাঁচতারা হাসপাতালে বাবার অপারেশন হলো। অপারেশনের খরচটা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কিছুটা মানবিক কারণে কর্তন করেছে কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে নয়। বাবা এখন মুক্তিযুদ্ধের গল্প আর বলে না।





Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*