যদি কাউকে জিজ্ঞেস করা হয় যে দুটি সংখ্যা যোগ করলে হয় ১০, গুণ করলে হয় ২৫, সংখ্যা দুটি কত? যে একটুখানি যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ করতে পারে, সে-ই এক মিনিটের ভেতর সংখ্যা দুটি বের করে ফেলতে পারবে। এখন আমি যদি জিজ্ঞেস করি দুটি সংখ্যা যোগ করলে হয় ১০, কিন্তু গুণ করলে হয় ১২৫, সেই সংখ্যা দুটি কত? আমার ধারণা তাহলে অনেকেই মাথা চুলকে বলবে এ রকম দুটি সংখ্যা থাকা সম্ভব নয়। যারা একটুখানি অ্যালজেবরা শিখেছে, ছোটখাটো সমীকরণ সমাধান করতে পারে, তারা কিন্তু কাগজ-কলম নিয়ে সংখ্যা দুটি বের করে ফেলতে পারবে। শুধু তা-ই নয়, হয়তো অবাক বিস্ময়ে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের এই সংখ্যা দুটির দিকে তাকিয়ে থাকবে।
গণিতের ভেতর একটু পরে পরে এ রকম একটা কিছু বের হয়ে আসে, যেটার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। অথচ আমাদের দেশের ছেলে-মেয়েদের সারা জীবন বলা হয়েছে গণিত হচ্ছে রসকষহীন কাঠখোট্টা একটা বিষয়। এটা মুখস্থ করে ফেলতে হয় এবং পরীক্ষায় উগরে দিয়ে আসতে হয়। গণিতের শিক্ষক যেভাবে শিখিয়ে এসেছেন, হুবহু সেভাবে পরীক্ষার খাতায় লিখে আসতে হবে। নিজের নিয়মে করা যাবে না, কেউ যদি নিজের নিয়মে করতে চায় তার জন্য রয়েছে বড় বড় গোল্লা। আমরা সেগুলো দেখতাম, শুনতাম এবং বড় বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম। আমাদের দেশে গণিত অলিম্পিয়াড নামে বিশাল দক্ষযজ্ঞ শুরু হওয়ার পর আমাদের দুঃখ একটু কমেছে। দেশের সব ছেলে-মেয়েকে গণিতের এই আনন্দময় জগিট আমরা এখনো দেখাতে পারিনি, কিন্তু যারা গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নিতে এসেছে তারা অন্তত এই রহস্যময় জগিটর ভেতর উঁকি দিতে পেরেছে।
এই বছর আমরা প্রথমবার আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে স্বর্ণপদক পেয়েছি, কেউ অস্বীকার করতে পারবে না এটি আমাদের দেশের জন্য অনেক বড় একটা অর্জন। তাই বলে কেউ যেন মনে না করে আমরা বুঝি শুধু পদকের জন্য জীবনপাত করি, এটি মোটেও সত্যি নয়, তাহলে আমরা মোটেও একেবারে ক্লাস থ্রির গেন্দা গেন্দা বাচ্চাদের নিয়ে গণিত অলিম্পিয়াড করতাম না, তাহলে আমরা শুধু কলেজের সত্যিকার প্রতিযোগীদের অল্প কয়েকজনকে ট্রেনিংয়ের পর ট্রেনিং দিয়ে অলিম্পিয়াডে পাঠাতাম। আমরা আসলে পুরো দেশের ছেলে-মেয়েদের গণিতকে ভালোবাসতে শেখাই যেন তারা দেশটাকে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে এগিয়ে নিতে পারে। এর মাঝে যদি মাঝেমধ্যে পদক পেয়ে যাই সেটি বাড়তি পাওনা।
এই বছর প্রথমবার স্বর্ণপদক পাওয়ার পর আমাদের সবার এক ধরনের আনন্দ হচ্ছে, আমার ঘুরেফিরে এই আন্দোলনটি কিভাবে গড়ে তোলা হয়েছে সেটি মনে পড়ছে। ১৯৯৪ সালে আমি মাত্র দেশে ফিরে এসেছি। তখন প্রফেসর মোহাম্মদ কায়কোবাদ আমার বাসায় এসেছেন। দুই-চারটি কথা বলার পরই তিনি বললেন, ‘বুঝলেন জাফর ভাই, পৃথিবীর সব দেশের ছেলে-মেয়েরা ইন্টারন্যাশনাল ম্যাথ অলিম্পিয়াডে যায়, আমাদের দেশের ছেলে-মেয়েরা যেতে পারে না। আমাদেরও যেতে হবে!’
সেই থেকে শুরু। একটা দেশ থেকে আন্তর্জাতিক অলিম্পিয়াডে কিভাবে টিম পাঠাতে হয়, সেই টিম কিভাবে তৈরি করতে হয় আমরা তার কিছুই জানি না। প্রথমে চেষ্টা করা হলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগকে দিয়ে। সেখানকার প্রফেসর গৌরাঙ্গ দেব রায় আমার খুবই বন্ধুমানুষ। তাঁকে নিয়ে নানা জায়গায় চিঠিপত্র লেখা হলো, যোগাযোগ করা হলো, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই করা গেল না। এভাবে বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে।
তখন একদিন প্রফেসর কায়কোবাদ ও আমি ভাবলাম সত্যিকারের গণিত অলিম্পিয়াড যদি শুরু করতে নাও পারি এই দেশের ছেলে-মেয়েদের গণিতে উৎসাহী করতে শুরু করে দিলে কেমন হয়? আমরা ঠিক করলাম কোনো একটা পত্রিকায় আমরা প্রতি সপ্তাহে পাঁচটা করে গণিতের সমস্যা দেব, ছেলে-মেয়েরা সেগুলো করবে, গণিতকে ভালোবাসবে। পরিকল্পনা করে আমরা আর দেরি করলাম না, দুজনে মিলে তখন-তখনই প্রথম আলো অফিসে হাজির হয়ে সম্পাদক মতিউর রহমানকে বললাম, আপনারা পত্রিকায় বিনোদনের জন্য, খেলাধুলার জন্য কত কিছু করেন! গণিতের জন্য একটা কিছু করবেন? সপ্তাহে এক দিন পত্রিকার এক কোনায় ছোট একটু জায়গা দেবেন, সেখানে আমরা পাঁচটা করে সমস্যা দেব। সেটাই হবে আমাদের গণিত অলিম্পিয়াড।
প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন এবং সেটাই ছিল গণিত অলিম্পিয়াডের শুরু। আমরা এর নাম দিলাম নিউরনে অনুরণন এবং প্রথম সমস্যাটি ছিল এ রকম—একজন লোক তার বাড়ি থেকে উত্তর দিকে ১০ মাইল গিয়ে একটা ভালুকের মুখে পড়ল। অনেক কষ্ট করে ভালুকের কবল থেকে মুক্তি পেয়ে প্রথমে ১০ মাইল দক্ষিণ দিকে তারপর আবার পূর্বদিকে ১০ মাইল গিয়ে তার বাড়িতে ফিরে এলো। ভালুকের গায়ের রং কী? (না, এটি তামাশা না, এটি সত্যিকারের একটি সমস্যা)!
আমাদের দেশের ছেলে-মেয়েরা নিশ্চয়ই গণিতকে অনেক ভালোবাসে। কারণ আমরা লক্ষ করলাম অনেক ছেলে-মেয়ে নিউরনে অনুরণন নামে এই সাপ্তাহিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নিতে শুরু করেছে। তখন গণিত অলিম্পিয়াডের ইতিহাসের দ্বিতীয় এবং সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটল। একদিন আমার বাসায় একজন তরুণ এসে হাজির হয়ে বলল, সে এই গণিত অলিম্পিয়াডটি নিয়ে কাজ করতে চায়। তরুণটির নাম মুনির হাসান।
এত দিন ধরে আমরা বয়স্ক মানুষেরা শুধু কথাবার্তা বলেছি, আলোচনা করেছি, শলাপরামর্শ করেছি, পরিকল্পনা করেছি, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করতে পারিনি। মুনির হাসান এসেই কাজ শুরু করে দিল। সে ঠিক করল, ছেলে-মেয়েদের নিয়ে সে একটা সত্যিকারের গণিত অলিম্পিয়াড করে ফেলবে। কিন্তু সেখানে আসবে কে? মুনির হাসান বাড়ি বাড়ি গিয়ে মা-বাবাদের বুঝিয়েসুঝিয়ে তাঁদের বাচ্চা বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের ধার নিয়ে এলো, বড় একটা হলঘরে বসিয়ে তাদের নিয়ে সত্যি সত্যি একদিন ছোটখাটো গণিত অলিম্পিয়াড হয়ে গেল। অলিম্পিয়াড শেষে মুনির হাসান আবার বাচ্চাকাচ্চাদের তাদের বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে এলো!
সবাই মিলে তখন ঠিক করা হলো সারা দেশের সবাইকে নিয়ে একটা ন্যাশনাল গণিত অলিম্পিয়াড করা হবে। আয়োজন করা হবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে। এটার নাম কী হবে সেটা নিয়ে নিজেদের ভেতর ছোটখাটো বিতর্ক হয়ে গেল। আমরা সবাই অঙ্ক বলে অভ্যস্ত, কথায় কথায় বলি অঙ্ক বই, অঙ্ক স্যার, অঙ্ক পরীক্ষা—সেই হিসেবে আমরা কি অঙ্ক অলিম্পিয়াড বলব? নাকি এর নাম হবে গণিত অলিম্পিয়াড। প্রফেসর গৌরাঙ্গ দেব রায় আমাদের বোঝালেন বিষয়টির নাম হচ্ছে ‘গণিত’, সমস্যাগুলোকে বলি অঙ্ক। কাজেই এর সঠিক নাম হবে ‘গণিত অলিম্পিয়াড’। অঙ্কের মতো সহজ শব্দের বদল ভারিক্কি গণিত শব্দটি সবাই গ্রহণ করবে কি না সেটা নিয়ে আমার নিজের ভেতর একটু সন্দেহ ছিল, কিন্তু দেখা গেল আমার সন্দেহ পুরোপুরি ভুল, গণিত অলিম্পিয়াড কথাটি সবাই খুব সহজেই মেনে নিয়েছে।
আমার যতটুকু মনে পড়ে ২০০২ সালে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম জাতীয় গণিত অলিম্পিয়াডের ঘোষণা দেওয়া হলো। এই অলিম্পিয়াডে আমাদের সঙ্গে থাকবে প্রথম আলো, সেভাবেই আয়োজন চলছে। অলিম্পিয়াড যখন কাছাকাছি চলে এসেছে তখন হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাত। মুনির হাসান আমাকে জানাল প্রথম আলো বলেছিল অলিম্পিয়াডের জন্য দুই লাখ টাকা দেবে, কিন্তু এখন আর দিতে চাইছে না! আমি কি সম্পাদক মতিউর রহমানকে ফোন করে একটু চেষ্টা করে দেখতে পারি?
কারো কাছে টাকা চাওয়ার মতো গ্লানির ব্যাপার আর কী হতে পারে? নিজের জন্য চাইছি না, তার পরও নিজেকে খুব ছোট মনে হয়। কিন্তু কিছু করার নেই, তাই লজ্জার মাথা খেয়ে ফোন করলাম, ফোনে কাজ হলো না এবং তখন আমি খুব একটা নাটকীয় কাজ করে ফেললাম। রেগেমেগে ফোন রেখে দেওয়ার আগে ঘোষণা করলাম যেহেতু গণিত অলিম্পিয়াড করব বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, আমরা সেটি করেই ছাড়ব। এর জন্য টাকা জোগাড় করতে দরকার হলে আমি জমিজমা বিক্রি করে ফেলব।
আমার উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় চলার সময় আমার স্ত্রী কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করছিল। সে অবাক হয়ে বলল, ‘তুমি জমিজমা বিক্রি করে ফেলবে মানে? তোমার তো কোনো জমিই নেই!’ আমি গলার স্বর আরো উঁচু করে বললাম, ‘আমার জমি নেই তো কী হয়েছে? কায়কোবাদ সাহেবের জমি আছে, সেই জমি বিক্রি করে ফেলব!’
তবে শেষ পর্যন্ত প্রফেসর কায়কোবাদের জমি বিক্রি করতে হয়নি, প্রথম আলো তাদের দুই লাখ টাকা দিতে রাজি হলো এবং আবার প্রথম জাতীয় গণিত অলিম্পিয়াডের কাজ শুরু হলো। (আমার স্ত্রী ঠিক করে রেখেছিল যেদিন আমরা প্রথম স্বর্ণপদক পাব, সেদিন সে সবাইকে আমার নির্বুদ্ধিতার এই গল্পটি শোনাবে! সে যেহেতু নিজের মুখে গল্পটি শোনানোর সুযোগ পায়নি, তার পক্ষ থেকে আমিই গল্পটি শুনিয়ে দিলাম।)
নির্দিষ্ট দিনে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক উৎসাহ নিয়ে প্রথম গণিত অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত হলো। সারা দেশ থেকে ছেলে-মেয়েরা এসেছে। ক্যাম্পাসে তাদের শোভাযাত্রার আয়োজন করা হলো। বিকেলে আমাদের অডিটরিয়ামে প্রশ্নোত্তর পর্ব। সেখানে গণিত নিয়ে ছেলে-মেয়েদের নানা ধরনের প্রশ্ন। একজন জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার তৈলাক্ত বাঁশের একটা অঙ্ক আছে যেখানে একটা বানর তিন ফুট ওপরে উঠে দুই ফুট পিছলে যায়। সেই বাঁশটায় তেল মাখিয়েছে কে?’ (উত্তর : তোমার মতোই একজন দুষ্টু ছেলে!)
সন্ধ্যাবেলা গণিত অলিম্পিয়াডের ছেলে-মেয়েদের জন্য চমৎকার একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। অতিথিরা বুঝতে পারেনি, কিন্তু আমরা খুবই দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলাম। তখন জামায়াত-বিএনপি সরকার, নাচ-গানকে ভালো চোখে দেখা হয় না। এখন যে রকম ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্যে সবার জীবন দুর্বিষহ, তখন ছাত্রদল-শিবিরের সেই রকম দৌরাত্ম্য। অনুষ্ঠানের মাঝখানে উদ্ধত ছাত্রনেতারা ঠেলেঠুলে ঢুকে সামনে গ্যাঁট হয়ে বসে গেল। ভাইস চ্যান্সেলরকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে, তাঁর বিন্দুমাত্র সহযোগিতা নেই, গণিতের ওপর বক্তব্য দিতে হবে—মনে হয় সেই ভয়ে অনুষ্ঠানেও এলেন না। ভালোয় ভালোয় অনুষ্ঠান হয়ে গেল, আমরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। আমরা যারা হাজির ছিলাম তখন তারা সবাই মিলে আমাদের জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে সভাপতি করে একটা কমিটি করে ফেললাম। যারা প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করেছে, তারা সবাই জানে তিনি কোনো কমিটির সভাপতি থাকলে কাউকে আর কিছু নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। আমরাও আর চিন্তা করি না।
কিছুদিনের ভেতরেই ডাচ্-বাংলা ব্যাংক আমাদের টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করতে রাজি হলো। প্রফেসর কায়কোবাদের জমি বিক্রি করার আর প্রয়োজন নেই। সবাই মিলে তখন পুরো দেশ নিয়ে গণিত অলিম্পিয়াড করার পরিকল্পনা করা হলো। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আয়োজন করা হলে ছাত্র-মাস্তানরা উৎপাত করতে পারে বলে ভবিষ্যতে শুধু স্কুলগুলোতে আয়োজন করা হবে বলে ঠিক করা হলো। তবে আমি মনে করি আমরা আরো একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিলাম, যেটি মনে হয় সারা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নিতে পারে শুধু কলেজের কিংবা স্কুলের বড় ক্লাসের ছেলে-মেয়েরা। কিন্তু আমরা আমাদের এই অলিম্পিয়াডটি করব একেবারে ক্লাস থ্রির বাচ্চা থেকে শুরু করে। যখন কোথাও গণিত অলিম্পিয়াডের আয়োজন করা হয়, তখন এই ছোট ছোট বাচ্চারা যখন গম্ভীর মুখে হাতে একটা রুলার বা জ্যামিতি বক্স নিয়ে হাজির হয়, সেই দৃশ্য থেকে সুন্দর দৃশ্য পৃথিবীতে আর কিছু হতে পারে না।
এই বিশাল দক্ষযজ্ঞ চালিয়ে নেওয়ার জন্য আরো মানুষ দরকার। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি ছোটখাটো কাজ মানুষকে বেতন দিয়ে করিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু যদি অনেক বড় কোনো কাজ করতে হয় তাহলে দরকার ভলান্টিয়ার। যারা কাজ করবে নিজের আনন্দে, নিজের উৎসাহে, একজন তখন দশজনের কাজ করে ফেলবে। আমরা খুব সহজে ভলান্টিয়ার পেয়ে গেলাম, প্রথম আলোর বন্ধুসভার ভলান্টিয়ার এবং গণিত অলিম্পিয়াডের ভলান্টিয়ার—প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী যাদের নাম দিয়েছেন মুভার্স।
তখন দেশব্যাপী গণিত অলিম্পিয়াড শুরু হয়ে গেল। প্রথম প্রথম কেউ ব্যাপারটি জানে না, তাই এটিকে পরিচিত করার জন্য আমরা এক শহর থেকে অন্য শহরে ঘুরে বেড়াই। আমাদের মধ্যে প্রফেসর গৌরাঙ্গ দেব রায় সবচেয়ে ঘুমকাতুরে। যখন গভীর রাতে ফিরে আসছি তখন তিনি মাইক্রোবাসের পেছনের সিটে শুয়ে ঘুমিয়ে যাচ্ছেন। অল্প বয়সে ক্যান্সারে মারা গেছেন। তাঁর অভাবটি খুব অনুভব করি। তাঁকে অনেক বলেকয়ে গণিতের ওপর একটি বই লিখিয়েছিলাম। বইটির নাম ‘একটুখানি গণিত’ (সময় প্রকাশনী)। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর যদি কোনো ছাত্র-ছাত্রী দেখে তার জ্ঞানের ঘাটতি আছে, তখন এই বইটি খুব কাজে লাগে।
সারা দেশ ঘুরে ঘুরে গণিত অলিম্পিয়াড করে করে একসময় আবিষ্কার করেছি যে দেশের মানুষ মোটামুটিভাবে গণিত অলিম্পিয়াডের নাম জেনে গেছে। মুনির হাসান সঞ্চালন করেছে এ রকম একটি গণিত অলিম্পিয়াডে যে ছেলে বা মেয়েটি অংশ নিয়েছে, আমার ধারণা সে সারা জীবন সেটি মনে রেখেছে। আমরা শুধু যে গণিতের কথা বলেছি তা নয়, আমরা সেখানে দেশের কথা বলেছি, দেশের মানুষের কথা বলেছি, মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেছি। সব সময় লক্ষ রেখেছি এই অনুষ্ঠানে আসছে কম বয়সী ছেলে-মেয়েরা। তাই তারা যে ধরনের অনুষ্ঠান দেখতে চায় সেটি উপহার দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। অনুষ্ঠান শেষে গণ্যমান্য লোকজনকে দাওয়াত দেওয়া হতো, বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পেলে তাঁরা লম্বা লম্বা বক্তব্য দিয়ে ছোট ছোট বাচ্চাদের জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলার আশঙ্কা ছিল, কিন্তু সেটি কখনো হয়নি। একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ যখন বক্তব্য দেওয়ার জন্য মাইক্রোফোন নিয়ে দাঁড়াতেন তখন মুনির হাসান বাচ্চাদের জিজ্ঞেস করত, ‘ইনি কতক্ষণ বক্তব্য দেবেন?’ বাচ্চারা উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করে বলত ‘এক মিনিট’। আমি ঘড়ি ধরে দেখেছি বাচ্চাদের বেঁধে দেওয়া সময়ের আগেই সবাই বক্তব্য শেষ করে ফেলবেন! কী মজা!
আমাদের গণিত অলিম্পিয়াড টিমে একসময় মাহবুব মজুমদার এসে যোগ দিয়েছে। অসাধারণ মেধাবী এই ছেলেটিকে আমি শিশু হিসেবে আমেরিকার সিয়াটল শহরে দেখেছি। বহুকাল পরে তার বাবা যখন আমাকে অনুরোধ করলেন দেশের কোথাও তাকে সময় কাটানোর ব্যবস্থা করে দিতে, আমি তাকে গণিত অলিম্পিয়াড টিমের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি। সেই থেকে সে আমাদের সঙ্গে আছে, সে গণিত অলিম্পিয়াড টিমের কোচ। এ রকম অসাধারণ একজন কোচ আছে বলেই আমরা এত দ্রুত এতগুলো মেডেল পেয়ে যাচ্ছি। আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি যে গণিত অলিম্পিয়াডের এই টিমটির কত বড় সৌভাগ্য, ঠিক যখন যে মানুষটির প্রয়োজন, কিভাবে কিভাবে জানি সেই মানুষটি চলে আসছে!
কয়েক দিন থেকে খুব ফুরফুরে মেজাজে আছি। বলা যেতে পারে বাংলাদেশ প্রথমবার সত্যিকারের একটা আন্তর্জাতিক প্রতিযেগিতায় সর্বোচ্চ পুরস্কারটি ঘরে এনেছে। অন্য অনেক দেশের সঙ্গে প্রথমবার বাংলাদেশের পতাকাটি সর্বোচ্চ পুরস্কারের সম্মানটি নিয়ে এসেছে এবং সেটি এনেছে একটি কিশোর। আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরীকে অভিনন্দন আমাদের দেশটিকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ আসনে অন্যদের পাশে বসিয়ে দেওয়ার জন্য। তার সঙ্গে অন্য যারা ছিল তাদেরও অভিনন্দন।
এখন সবার বিশ্বাস হয়েছে তো যে আমরা যেটাই চাই, সেটাই করতে পারি?
Leave a Reply