এইচ এস সি পরীক্ষার্থীদের জন্য জীবন থেকে নেয়া গল্প

বন্ধুরা, খুব শিঘ্রই হয়তো আপনাদের পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়ে দেবে। ইতিমধ্যে অনেকেই ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেছেন। যারা ভালো রেজাল্ট করবেন তাদের জন্য আমার শুভ কামনা। আর যাদেরে রেজাল্ট আশানুরুপ হবে না তাদের জন্যও আমার শুভ কামনা। আজ হঠাৎ বসে থাকতে থাকতে চিন্তা করলাম, আপনাদের কিছু বিনা পয়সায় উপদেশ দেই। প্রথমেই বলব, শিক্ষাই জাতীর মেরুদন্ড, শিক্ষা ছাড়া জীবনে কোন উপায় নেই, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। একটা সুন্দর জাতী গড়তে শিক্ষাই প্রধান। এসব কথা শুনতে শুনতে হয়তো ইতিমধ্যে অনেকেই বোর হয়ে গেছেন। কারন এগুলা হলো কমন কথা। তবে আমার কথা কিন্তু কমন নয়। আমি আজ আপনাদের ভিন্ন কিছু পরামর্শ দেবো।

প্রথমেই আমার পরিচয় দিয়ে নিচ্ছি। আমি সাধারন একজন ছেলে, বলতে পারেন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। একটা মাল্টিন্যাশনাল কম্পানিতে এখন জব করি। আমি এস এস সি দিয়েছি ২০০২ সালে । এর পর পড়াশুনা ছেড়ে দিয়েছিলাম। ২০০৭ সাথে এসে চিন্তা করলাম জীবনে পড়াশুনাটা হয়তো খুবই জরুরী। বিশেষ করে বিয়ে করতে গেলে পাত্রীপক্ষ জানতে চাইবেন, ছেলের পড়াশুনা কতদুর, তখন হয়তো উত্তর দিতে হবে, ছেলে মেট্টিক পাস। বেপারটা কেমন যেন হয়ে গেলো। এরপর ২০০৭ সালে আবার পড়াশুনা শুরু করি। এইচ এস সি তে আমার রেজাল্ট খুব একটা ভালো না, পরীক্ষার তিন মাস আগে পড়াশুনা শুরু করেছিলাম, তাই সাইন্স থেকে টেনেটুনে কোন রকম পাশ করেছিলাম। এর পর ঢাকায় এসে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হই। বাবার টাকা পয়সাগুলো গায়ে বাতাস লাগিয়ে ভালোই খরচ করেছিলাম। যেখানে সেমিষ্টার ফি দেয়া লাগতো ৩০ হাজার টাকা সেখানে বাবার কাছ থেকে নিতাম কম হলেও ৫০ হাজার টাকা। বেশ আরামেই আমার দিন কাটত।
আমার মা বাবার একমাত্র ছেলে আমি, তাই আমার বাবা কোন কিছুর অভাব রাখেনি। টাকা চাইতাম আর পেয়ে যেতাম। গার্লফ্রেন্ড, আড্ডাবাজি, আর মন চাইলে ক্লাশ করতাম না চাইলে না। এভাবে অনার্সটাও কোন ভাবে টেনেটুনে পাশ করি। এবার সময় এলো বাস্তবতাকে মেনে নেয়ার। অর্থৎ জব করতে হবে। চাকরীর প্রতি আমার তেমন কোন আগ্রহ ছিলো না, কারন চাইলেই তো বাবা টাকা দিতো। চাকরীর কি দরকার। মনে চাইলে কোথাও সিভি দিতাম মন না চাইলে দিতাম না। এভাবে পড়াশুনা শেষ করেও তিন বছর বেকার জীবন পার করলাম। ইতিমধ্যে বাবাও টাকা দেয়া কমিয়ে দিয়েছে। কি করব, সেমিষ্টার ফি তো দেয়ার সুযোগ নেই যে বেশি টাকা আনব। কোন রকম চলার জন্য টাকা পেতাম। গার্লফ্রেন্ড নিয়ে দামি কোন রেষ্টুরেন্টে বসব তারও উপায় নেই।
এরপর সিরিয়াসলি সিভি জমা দিতে শুরু করলাম, যখন যেখানে সুযোগ পেতাম ইন্টারভিউ দিতাম। কিন্তু কোথাও চাকরী হতো না। তাই বাধ্য হয়ে দুই একটা টিউশনী করানো শুরু করি। ঢাকাতে চলতে হবে তো। ইতিমধ্যে গার্লেফ্রেন্ডের সাথেও অনেকটা দুরত্ব চলে এসেছে। আগে যেখানে সপ্তাহে দুই এবার দেখা করতাম, এখন মাসে একবার বা দুই বার হতো। ধানমন্ডি লেক বা আশেপাশে কোথাও বসে সময় কাটাতাম।
২০১৪ সালে সত্যিই আমি হতাস হয়ে পড়ি। বাবাও তেমন টাকা দিচ্ছে না, টিউশনির টাকাতে কোন ভাবে চলতে হচ্ছে। আবার কোন ভাবেই চাকরী হচ্ছে না। এক কথায় আমি হতাস হয়ে পড়ি। টুকটাক নেশাও করা শুরু করি। এই হলো ২০১৪ সাল পর্যন্ত আমার জীবন।
ঐ সময়ে একটু একটু করে আমার বিবেক কাজ করতে শুরু করে, কিছুটা অনুভব করতে শুরু করি আমার জীবন চলার পথটা ছিলো খুবই অস্বাভাবিক। ঐ বছরই জানতে পারি, আমার বাবা আমাকে এতদিন যে টাকা পয়সাগুলো দিয়ে আসছিলো তার সবটাই তার জমি বিক্রি ও পেনশনের টাকা। এখন আর অবশিষ্ট তেমন কোন টাকা নেই যা আমাকে দিতে পারে। পুরো পরিবারটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কবে আমার জব হবে আর কবে আমি সংসারের হাল ধরব। গার্লফ্রেন্ডটাও চলে গেলো তাই একলা হয়ে পড়ায় হাতাসা যেন দিন দিন বেড়েই চলছে। দিন দিন বেচে থাকার ইচ্ছাটাও হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছিলাম। নিজের প্রতি রাগ, অপরাধবোধ আমাকে শেষ করে দিচ্ছিল। নিজের পরিবারকে কিভাবে পারলাম এমন বাবে ঠকাতে? ২০১৫ সালটা খুব অভাবের সাথে আমার পরিবার যুদ্ধ করেছিলো। লজ্জায় তাদের সামনে যেতেও পারতাম না। আর লজ্জা করেওবা কি লাভ, আমার মত অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেরা এমই করে। হেলায় ফেলায় নিজের পরিবারের অনেক বড় ক্ষতি করে ফেলে। আমিও তাদের মতই আদর্শবান একজন কাপুরুষ।
যাই হোক, জীবনের একটা সময় আত্নহত্যা করা সিদ্ধান্ত নেই, অনেকবার চেষ্টাও করেছিলাম, কিন্তু সাহস হয়নি। একদিন হঠাৎ বুঝতে পারি, আমার পুরো পরিবারটা তো আমার দিতে তাকিয়ে আছে, আমি আত্নহত্যা করলে তাদের কে দেখবে? দিন দিন যেন আমি একটু একটু করে বড় হচ্ছিলাম। অনেক কিছু বুঝতে শুরু করেছিলাম। তাই জেদ করি আমাকে একটা ভালো চাকরী জোগার করতেই হবে। অবশেষে ১২ হাজার টাকায় একটা ফ্যাক্টরীতে জয়েন করি।

এবার নিজের কিছু প্রসংশা করি, আমার রেজাল্ট খুব একটা ভালো ছিলো না, কারন আমি রেজাল্ট এ বিশ্বাসী ছিলাম না। আমার জীবনে আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি আমি কোন দিন নকল করি নাই, কারোটা দেখে লিখি নাই। নিজে যা পেরেছি তাই লিখেছি। আমার নতুন কিছু শেখার সব সময়ই খুব আগ্রহ। তাই কম্পিউটারে আমার বেশ দখল ছিলো সব সময়। এস ই ও, এইচ টি এম এল, সি এস এস, সি প্লাস, ওয়েব ডিজাইন ও ডেভলপমেন্ট সবই আমার জানা ছিলো। কম্পিউটারে আমার টাইপিং স্পিড, বাংলা ও ইংলিশ সমান, যা ৬৫ এর কাছাকাছি।

যাই হোক, ১২ হাজার টাকার ৭ হাজার বাড়িতে পাঠাতাম আর ৫ হাজার টাকা দিয়ে নিজে চলতাম। এক সময় ভাবলাম, যেহেতু আমার কম্পিউটারের নলেজ ভালো, তাই উপার্জনের জন্য তো তাকে কাজে লাগাতে পারি। আমার অফিস আওয়ার ছিলো সকাল ৮ থেকে রাত ৮ টা। ৮ টা ৩০ এ বাসায় এসে কম্পিউটার নিয়ে বসে পড়তাম। বর্তমানে এস ই ও এক্সপার্ট হিসেবে অনলাইনে কাজ করছি। উপার্জন ভালোই বলা চলে। আর হ্যা, প্রথম চাকরীর ৬ মাস পরে নতুন একটা চাকরীর অফার পাই। বেতন ভালো থাকায় সেখানে জয়েন করি। সাথে অনলাইনে কাজ করাকেও প্রফেশন হিসেবে দেখছি। যখন ভালো জব করছি , ভালো আয় করছি তখন হঠাৎ একদিন বাবা মারা যায়। আফসুস যেন আবার বেড়েই গেলো। কিছুই করতে পারলাম না বাবার জন্য। শুধু ঠকিয়েই গেছি।

এবার আমার জীবন থেকে যা শিখেছি তা সংক্ষেপে বলছি-

  • পরীক্ষায় এ+ পাওয়াটাই মুল বিষয় না, প্রকৃত মানুষ হওয়াটাই আসল।
  • ভালো চাকরী ভালো রেজাল্ট দিয়ে হয় না, ভালো চাকরী নির্ভর করে আপনার ভিতরে কি আছে তার উপর।
  • পড়াশুনা করে জীবনে চাকরী করতেই হবে এমন কোন কথা নেই, চাকরী ছাড়াও অনলাইনেই আপনি আপনার ক্যারিয়ার গড়তে পারেন তবে তার জন্য দরকার সঠিক গাইড লাইন। এই গাইড লাইন রাস্তার পাশের কোন কোচিং সেন্টার থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। গুগল দেখুন, ইউ টিউব দেখুন, নিজে নিজেই শিখতে পারবেন। চাইলে ইউটিউবে Jobayer Rahman লিখে সার্চ করুন, এ বিষয়ে আমার কিছু টিউটোরিয়াল আছে।
  • জীবনের কোন এক সময় প্রত্যেকেই তার জীবনের ভুল বুঝতে পারে কিন্তু তখন আর সংশোধনের উপায় থাকে না। তাই জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপ খুব হিসেব করে দিতে হয়।
  • মা বাবাকে ঠকিয়ে জীবনকে হয়তো উপভোগ করা যায় কিন্তু একটা সময়ে এসে আপনার অতীতের প্রতিটা সময় আপনাকে কুরে কুরে খাবে।
  • আত্নহত্যা জীবনের কোন সমাধান নয়, বরং যুদ্ধ করে ঠিকে থাকাটাই একজন প্রকৃত পুরুষের লক্ষন।
  • নেশা করে হয়তো সাময়ীক আনন্দ পাওয়া যায় কিন্তু এর ফলাফল বহন করতে হবে সারাজীবন।
  • সব শেষে একটা কথাই বলব, আপনি আপনার মা বাবার সাথে জীবনে যেমনটা করবেন, আপনার সন্তান ঠিক তেমনটাই উপহার দেবে। সহ্য করতে পারবেন তো?

কিছুদিনের ভিতরেই HSC Result 2018 দেবে। তাই নিজেকে প্রস্তুত করুন এখন থেকেই। শুভ কামনা সব সময়।





Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*