জাঁতি/জাতা/যাতা/যাঁতি অঞ্চল ভেদে যে যাহায় বলে থাকি না কেন এটি আমাদের দেশের গ্রামীণ মহিলাদের কাছে খুব প্রয়োজনীয় একটি গৃহস্থলি পকরণ।
যা এই কিছু কাল আগেও মহিলাদের কাছে সংসারের বিভিন্ন কাজে ব্যবহার হয়ে আসা উপকরণ। কিন্তু সময়ের কাছে এবং আধুনিক যন্ত্রের কাছে মার খেয়ে আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। দৈনন্দিন জীবনে আমরা ছুরি, কাঁচি, সুপারি কাটা জাঁতি প্রভৃতি নানা রকম জিনিস ব্যবহার করে থাকি। ঐসব জিনিস প্রত্যেকটিই একেকটি সরলযন্ত্র। আধুনিক যন্ত্র নির্ভরর সভ্যতায় যন্ত্রপাতির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। তেমনি পুরাতন সব যন্ত্রের জায়গা দখল করে নিচ্ছে আধুনিক সব যন্ত্র। এতে যেমন সময় ও শ্রমের অপচয় হ্রাস হয়েছে তেমনি মানব জীবনে এসেছে গতিশীলতা। আজ হতে ১৫-২০ বছর আগে আমাদের
দেশে গ্রাম গুলিতে এমন সব জিনিস বা উপকরণ ব্যবহার করা হত যা আজ কল্পনা করা যায় না। আধুনিক যন্ত্রের কাছে সেই সব জিনিস টিকতে না পেরে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের জীবন হতে। তেমনি একটি যন্ত্র জাঁতি/জাতা/ যাতা/যাঁতি । গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ীতে দেখা যেত যাতা। বিয়ের সময় অনেকে বাবার বাড়ি হতে (নব বধূ) উপহার হিসেবে পেত এই জাঁতি/জাতা/যাতা/যাঁতি।
কি কি করা হতঃ এই জাঁতি/জাতা/যাতা/যাঁতি দিয়ে গ্রামীণ বধূরা এই কিছুদিন আগেও চাল/গম/জব হতে আটা/ময়দা করতে ব্যবহার করত( যদিও ঢেঁকির সাহায্যে তা করা হত, তবে অল্প পরিমাণে আটা করতে জাঁতি/জাতা/যাতা/যাঁতি ব্যবহার হত)। এছাড়া যাতা দিয়ে ভাঙ্গানো হতো মশারী, খেসারী, াশ কলাইসহ প্রভৃতি রকমের ডাউল।
কি দিয়ে তৈরিঃ
জাঁতি/জাতা/যাতা/যাঁতি তৈরির মূল উপাদান পাথর। মসৃণ দুই খণ্ড পাথরকে কেটে গোল করে জাঁতি/জাতা/যাতা/যাঁতি তৈরি করা হত। সেই খণ্ড দুটির ভেতরের ভাগ(যে দিক বা পাশ ভিতরের দিকে থাকবে) কে লোহার তৈরি বিশেষ বাটাল বা যন্ত্র দিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চটলা বা খাল করে এর ধার বাড়ানো হয় এবং উপরে এবং নিচের পাটের মাঝে গোল একটি ছিদ্র করা হয়। যা দিয়ে বিশেষ ভাবে কাঠের বা বাশ দিয়ে তৈরি হাতল লাগানো হয় যা দুই পাটকে এক জায়গায় থাকতে সাহায্য করে। দুই ছিদ্রের মাঝে বিশেষ খাজ কাটা দণ্ড থাকে যার সাহায্যে পাট দুটির মাঝে কতটুকু ফাঁক থাকবে তা নির্ধারণ করা হয়—অর্থাৎ আপনি কেমন আটা বা ডালের টুকরা চান তার উপর নির্ভর করে পাট দুটির মাঝে ফাঁক রাখা হয় ঐ ডন্ডের মাধ্যমে। শুধু উপরের পাটে আর
একটি ফুটো করা হয় যা দিয়ে শস্য কে ভিতরে পাঠানো হয় পিষার জন্য।
যে ভাবে পিষা হয়ঃ
গৃহবধূরা মাঝের ফুটো হাতল ধরে আরে কটি ফুটো দিয়ে শস্য ভিতরে দিয়ে হাতল ধরে জোরে ঘুরাতে থাকে । এতে শুধু উপরের পাট নিচের পাটের উপর ঘুরতে থাকে এবং দুই পাটের ঘর্ষণের ফলে উপর হতে দেওয়া শস্য ভেঙ্গে গুড়া হয়ে দুই পাটের চার সাইড ফাক দিয়ে দ্রুত গতিতে বের হয়ে আসে। অনেক সময় দেখা যায় ভাল করে গুড়া হয় না। ফলে আবার সেগুলিকে ভিতরে দিয়ে আবার জাঁতি/জাতা/যাতা/যাঁতি ঘুরিয়ে ভাল করে গুড়া করা হয়। দুই পাটের মাঝে থাকা খাজ কাটা ডন্ডের মাধ্যমে দু পাটের ফাঁক কম বেশি করে সশ্যের আটা বা ডালের টুকরা কেমন হবে তা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।
শেষ কথাঃ
পাথরের তৈরী যাতা দিয়ে যখন কাজ করা হয় তখন একটি মিষ্টি ধরনের শব্দ হয়। এখন আর চোখে পড়ে না সচারাচার যাতার ব্যবহার। উন্নত ধরনের মেশিন তৈরী হওয়ার কারনে সুখ প্রিয় বাঙ্গালী পরিবার আর কষ্ট করে জাঁতি/জাতা/যাতা/যাঁতি চালাতে চায় না। তারপরও গ্রামাঞ্চলের অনেক পরিবার যাতেকে ঐতিহ্য হিসাবে ধরে রেখেছেন। আমাদের বাড়িতে এখনো আছে পাথরের জাঁতি/জাতা/যাতা/যাঁতি। হয়ত আর কিছু দিন পর এ যাতা কালের আবর্তে হারিয়ে যাবে।
লেখক- সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
Leave a Reply