শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের দাবীতে বিভিন্ন কর্মসূচী ঘোষনা মাঠে আন্দোলনে নেমেছে এদেশের বেসরকারী স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারীরা। জাতীয়করণের দাবী আজকের নতুন নয়। ২০০৫ সালে এই দাবীতে শিক্ষক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের মিছিলে পুলিশী হামলায় আমি, মহি হালদারসহ আমরা অনেকেই রক্তাত্ত আহত হয়েছিলাম। জাতীয়করণ ইস্যু এখন বেসরকারী শিক্ষকদের কাছে জনপ্রিয়। বেসরকারী শিক্ষকদের প্রতি অবহেলা বিভিন্ন বৈষম্যই শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের দাবীটি জনপ্রিয় হয়ে উঠে। বর্তমানে বাংলাদেশে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার প্রায় ৯৮% বেসরকারী খাতে পরিচালিত হয়ে থাকে। মাত্র ২% সরকারী । অথচ প্রশাসন থেকে শুরু করে বিভিন্ন বোর্ড, ডিজি অফিস সব ক্ষেত্রে সরকারী কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে বেসরকারী শিক্ষদের কোন প্রতিনিধিত্ব নেই। সরকারী কর্মকর্তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেসরকারী শিক্ষকদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন এবং অনেক সময় অসৌজন্য আচরনও করেন। বেসরকারী শিক্ষকরা বিভিন্ন অবহেলার শিকার হন (সব ক্ষেত্রে নয়)। এ ছাড়া মর্যাদার একটি ব্যাপার তো আছেই। বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটি অধিকাংশই পরিচালিত হয় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দ্বারা। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ব্যবস্থাপনা কমিটতে এমন এমন ব্যক্তি থাকেন যারা নিজের নাম ও স্বাক্ষর করতে পারেন না। অথচ তারা স্কুল কলেজের কমিটির সভাপতি। ফলে তাদের সাথে শিক্ষকদের সাথে একটি মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ফলে প্রতিষ্ঠান প্রধানগনের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কমিটি তোষনে ব্যস্ত থাকতে হয়। কারণ বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারীদের চাকুরী নির্ভর করে কমিটির কর্তা ব্যক্তিদের ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর। ফলে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারীরা অনেক ক্ষেত্রেই নিজস্ব স্বকীয়তা তাদের কাজ করতে বাধাগ্রস্থ হন। ফলে শুধু শিক্ষকরাই নন শিক্ষাও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
বেসরকারী শিক্ষকরা সরকারী অনুরূপ মুল বেতনের ১০০% পেয়ে থাকেন। অর্থাৎ সরকারী শিক্ষকরা যে বেতন প্রাপ্ত হন বেসরকারীও সমপরিমান বেতন পান। পার্থক্য হলো বাড়ী ভাড়া মেডিকেল, ইনক্রিমেন্ট, উৎসব ভাতা। বেসরকারী শিক্ষক কর্মচারীরা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন বার্ষিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে। ২০১৫ সালে ঘোষিত অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল প্রদানের সময় বলা হয়েছে পরবর্তীতে আর কোন পে-স্কেল প্রদান করা হবে না
তৎপরিবর্তে প্রতিবছর মূল বেতনের ৫% হারে প্রবৃদ্ধি প্রদান করা হবে। সরকারী শিক্ষক কর্মচারীরা ৫% প্রবৃদ্ধি পেলেও বেসরকারী শিক্ষক কর্মচারীদের এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। ফলে তারা ব্যাপক বেতন বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী স্ব-উদ্যোগে ‘বৈশাখী ভাতা’ চালু করলেও বেসরকারীদের তা দেওয়া হচ্ছে না। সরকারী বেসরকারী ব্যাপক আর্থিক ও মর্যাদার বৈষম্য, বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা কমিটির দৌরাত্ব, সরকারী কর্মকর্তাদের কর্তৃক বেসরকারী শিক্ষক কর্মচারীদের প্রতি চরম অবহেলা, স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব স্বকীয়তায় কাজ করতে না পারা । এই সব বিভিন্ন কারণে বেসরকারী শিক্ষক কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভও হতাশা বিরাজ করতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের এক দফা দাবীতে সোচ্চার হয়েছে। অনেকই মনে করেন এক সাথে দেশের সকল বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ অনেক অর্থ এবং জাতীয়করণ হওয়ার মত মান সম্পন্ন শিক্ষকের অভাব রয়েছে।এ ক্ষেত্রে জাতীয়করণের জন্য অর্থের বিষয়টি অব্যশই গুরুত্বপূর্ণ। তবে অতিরিক্ত যে অর্থের প্রয়োজন তা মেঠানোর সক্ষমতা
সরকারের আছে। স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ প্রয়োজনে শর্ত স্বাপেক্ষে জাতীয়করণের প্রস্তাব করেছে। বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যে সম্পত্তি রয়েছে টাকার অংকে তা হাজার হাজার কোটি টাকা। দেশের বড় বড় শহর ছাড়াও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যার একেকটির সম্পত্তির পরিমান শত শত কোটি টাকা। এছাড়া প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে যে স্থায়ী আমানত রয়েছে তার পরিমানও নেহায়েত কম নয়। বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা সরকারী অনুরূপ মুল বেতন ১০০% পাচ্ছেন।
বাকী বাড়ী ভাড়া, মেডিকেল, চিকিৎসা ভাতা, অবসর সুবিধা। বর্তমানে বেসরকারী শিক্ষকদের কল্যাণ এবং অবসর বোর্ড সরকারী গত দুই বছরে ৮৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এ বরাদ্দের মাধ্যমে সরকার কিছুটা হলেও বেসরকারী শিক্ষক কর্মচারীদের অবসরকালীন সুবিধা প্রদানের দায় গ্রহন করেছে। বেসরকারী সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করলেও সরকারের যে অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হবে তার সক্ষমতা সরকারের আছে।
বর্তমানে বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে আদায়কৃত টিউশন ফি প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ তাদের মত ব্যয় করে থাকেন। সরকারী কোষাগারে কোন অর্থ জমা হয় না। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠান সমূহ তাদের ইচ্ছামত শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি নির্ধারণ করে থাকে। কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাসিক টিউশন ফি এক/দেড় হাজার টাকা। জাতীয়করণ করা হলে সর্বোচ্চ ৪০/৫০ টাকা বেতন নির্ধারণ করা হলেও প্রায় দুই কোটি শিক্ষার্থীর কাছে থেকে বাৎসরিক বিপুল পরিমান অর্থ সরকারী কোষাগারে জমা হবে। অন্য দিকে সাধারণ মানুষের
সন্তানেরা স্বল্প খরচে শিক্ষার সুযোগ পাবে। জাতীয় নির্বাচনেও প্রভাব পড়বে। শিক্ষক এবং শিক্ষার মান নিয়ে যে সংশয় আছে সরকার শর্ত সাপেক্ষে শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ করা হলে এবং শিক্ষক ও শিক্ষার জন্য যদি একটি নির্দিষ্ট মানদন্ড নির্ধারণ করে দেওয়া হয় তাহলে যে ঘাটতি পূরন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে শিক্ষার একটি সুনির্দিষ্ট মান নিধারণ করে পাঁচ বছর সময় বেধে দিয়ে ঐ টার্গেট পূরনের শর্তে দেশের সকল এমপিওভূক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা যেতে পারে । শর্ত অনুযায়ী এই সময়ের মধ্যে কোন প্রতিষ্ঠান সরকার নির্ধারিত মানে পৌছাতে না পারলে সে সব প্রতিষ্ঠান পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকরা যখন জাতীয়করণের মাধ্যমে তাদের চাকুরীর নিশ্চয়তা পাবে, আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধি পাবে, তারা তখন একাডেমিক কর্মকান্ডে আরো অধিক মনোযোগি হবে। সরকার যদি পর্যাপ্ত ট্রেনিং এবং অবকাঠামো উন্নয়ন করে তাহলে শিক্ষকদের মান ও শিক্ষার মান উভয়ই বৃদ্ধি পাবে।
একটি মহল সবসময় শুধু সরকারের সমালোচনাই করে। তাদের মনে রাখতে হবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৮ বছর। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল মাত্র ১৭ বছর। আওয়ামী লীগ শাসনামলে ১৭ বছরে শিক্ষাক্ষেত্রে যে অর্জন সাধীত হয়েছে বাকী ৩১ বছরেও তা হয়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকারের শাসনামলে শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেক অর্জন আছে। শিক্ষানীতি প্রণয়ন, ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ, ২০% মহার্ঘ্য ভাতা, জাতীয় বেতন স্কেলে বেসরকারী শিক্ষক কর্মচারীদের অন্তভূর্ক্ত করায় বেতন দ্বিগুন বৃদ্ধি, বন্ধকৃত কলেজ শিক্ষকদের টাইমস্কেল চালু, অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক কর্মচারীদের কল্যাণ এবং অবসর বোর্ডের ৮৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ, বিনামূল্যে বই বিতরণ, বাড়ী এবং চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধি, মাদ্রাসার সুপার ও প্রিন্সিপালদের বেতন বৈষম্য দূরীকরন, প্রায় এগার হাজার আইসিটি, উৎপাদন ব্যবস্থাপনা, বিজ্ঞান ও তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিও প্রদান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক অব কাঠামো নির্মাণ, প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট ফান্ড গঠন, প্রাথমিক স্তরে প্রায় ৭৮ লক্ষ এবং মাধ্যমিক স্তরে প্রায় ৪০ লক্ষ শিক্ষার্থীকে উপ-বৃত্তি প্রদান, মাল্ডিমিডিয়া ডিজিটাল ক্লাশরুম ব্যাপক সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভবন নির্মাণসহ ঢাকায় টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং এদেশের আলেম ওলামাদের একশত বছরের দাবী ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও উচ্চ শিক্ষা প্রসারে ব্যাপক প্রদক্ষেপ গ্রহনসহ শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন করেছে।
সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে প্রশ্নত্তোর পূর্বে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে পর্যায়ক্রমে শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের ঘোষনা দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে বেসরকারী শিক্ষকদের জন্য এটি একটি সুখবর। জাতীয়করণ শুধু টাকার বিষয় নয়। এটা সরকারের রাজনৈতিক নীতি নির্ধারণী বিষয়। যেহেতু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে জাতীয়করণের বিষয়ে সরকারের অবস্থান পরিস্কার করেছেন, সেহেতু কোন হঠকারী কর্মসূচী না দিয়ে অত্যন্ত সুচিন্তিত ও গঠনমুলক কর্মসূচীর মাধ্যমে এই দাবী পূরনে এগিয়ে যেতে হবে। এ জন্য দরকার দেশের সকল শিক্ষক কর্মচারীদের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস। আন্দোলনের পাশাপাশি সরকারের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করে জাতীয়করণের নীতিমালা সহজতর করে সকল বেসরকারী শিক্ষক কর্মচারীরা যাতে এই সুবিধা পেতে পারে তার জন্য কাজ করা। কোন হঠকারী কিংবা অদূরদর্শী কর্মসূচীর নামে শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের এই উদ্যোগ যাতে ধুলিসাৎ না হয় সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক স্বার্থে যাতে শিক্ষকদের ব্যবহার করে কোন মহল যাতে গোলা পানিতে মাছ শিকার না করতে পারে এ ব্যাপারে সকল শিক্ষক কর্মচারীদের সজাগ থাকতে হবে।
(লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা, সাধারণ সম্পাদক, স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ এবং বেশ কয়েকটি গ্রন্থের রচয়িতা)
Leave a Reply