স্কুলগুলোয় ইংরেজী পড়ানোর দুরবস্থা সম্পর্কে একটি অভিজ্ঞতা সামনে তুলে ধরতে চাই। সম্প্রতি নারায়নগঞ্জ জেলার একটি মাধ্যমিক স্কুল পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে দশম শ্রেণীতে ইংরেজী বিষয়ে শিখানো পড়ানো দেখে আমি বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। ওই শ্রেণীতে একজন শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে আগে দেয়া ‘বাড়ির কাজ’ আদায় করছিলেন। বাড়ির কাজটি ছিল একটি প্যারাগ্রাফ। শিক্ষক শ্রেণীতে প্যারাগ্রাফটি স্যার লিখে দিয়েছিলেন আর ছাত্রছাত্রীরা সেটি মুখস্থ বলে যাচ্ছিল। ছাত্রছাত্রীদের বলার ঢং দেখে আমার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না যে, তারা সেটি মুখস্থ করে এসেছে। পরপর তিনজন ছাত্রছাত্রী একই ধরনের বাক্য উচ্চারণ করায় আমি অনেকখানি বিস্মিত হয়ে তাদের কাছ থেকে প্যারাগ্রাফ লেখা খাতা চেয়ে নিয়ে খাতার লেখা মিলিয়ে দেখলাম সবার ভাষা একই। আমার বিস্ময় খানিকটা বেড়ে গেল। আমি একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি এ.কে হাই স্কুলের ছাত্র ছিলে? তোমার বাবা কী করেন? ছেলেটি জবাব দিল, সে কখনও এ.কে হাই স্কুলের ছাত্র ছিল না এবং তার বাবা একজন কৃষক। আরও একজন ছাত্র ও একজন ছাত্রীকে ওই দুটো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে জানলাম, তাদের কেউই কখনও এ.কে হাই স্কুলের ছাত্রছাত্রী ছিল না এবং তাদের প্রত্যেকের বাবার পেশা কৃষিকাজ। আমার বিস্ময়ের মাত্রা আরও বেড়ে গেল। আমি মৃদুস্বরে তাদের কাছে জানতে চাইলাম, তোমরা কেউই এ.কে হাই স্কুলের ছাত্রছাত্রী ছিলে না। তাহলে খাতায় লিখেছ কেন এবং বলছ কেন? এ ছাড়া তোমাদের কারোরই বাবা সরকারি চাকরি করেন না; তাহলে কেন বলছ, তোমাদের বাবা সরকারি চাকরিজীবী? ওরা ত্বরিত একই উত্তর দিল, স্যার বই থেকে লিখে দিয়েছে। আমি তৎক্ষণাৎ তাদের হাত থেকে বই নিয়ে মিলিয়ে দেখলাম, সত্যিই তাই। বইয়ে যে হুবহু তা-ই লেখা রয়েছে! আমি শিক্ষকের কাছে জানতে চাইলাম, তারা যে স্কুলের ছাত্রছাত্রী ওই স্কুলের নাম লিখছে না এবং বলছে না? তাদের কারোরই বাবা সরকারি চাকরিজীবী না? কেন বলছে, বলা বাহুল্য, ওই শিক্ষকের কাছ থেকে আমি কোন জবাব পেলাম না। ওই পাঠদান পর্যবেক্ষণ করে আমার এই ধারণা জন্মেছে যে, আমাদের স্কুলশিক্ষার্থীরা এখনও মুখস্থবিদ্যার গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি বলা যায়, তারা সে সুযোগ পাচ্ছে না। অনেক শিক্ষকের অবস্থাও তথৈবচ!
প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের পাঠদানআমাদের ইংরেজী বিষয়ের শিক্ষকদের দুর্বলতাই প্রকাশ করছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যেও ইংরেজীভীতি সঞ্চারিত হচ্ছে। ইংরেজী পড়ানো নিয়ে শুধু ওই একটি স্কুলে এমনটি ঘটেছে, তা নয়। বরং আরও অনেক স্কুল পর্যবেক্ষণকালে শিক্ষকদের ইংরেজী পাঠদান দেখে আমি অবাক হয়েছি। কারণ শিক্ষকরা ইংরেজীতে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার পরও স্কুলগুলোয় ইংরেজী পড়ানোয় পদ্ধতিগত দিক থেকে তাদের তেমন কোন দৃশ্যমান উন্নতি হচ্ছে না। এর কারণ কী? তাহলে কি প্রশিক্ষণের কোন
ত্রুটি রয়েছে? অথবা শিক্ষকরা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অর্জিত দক্ষতা ও কৌশল নিজেদের পাঠদানে প্রয়োগ করছেন না?
সরকারি তরফ থেকে গুরুত্বের সঙ্গে সরাসরি স্কুল পর্যবেক্ষণ করে এসব প্রশ্নের সমাধান খুঁজে বের করা দরকার। কারণ আমরা জানি, শুধু ইংরেজী বিষয়ের শিক্ষকদের নানা রকমের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য বছরে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। ঋণ করে পাওয়া এসব টাকা ব্যয়ের উদ্দেশ্য পরিপূর্ণরূপে অর্জিত হচ্ছে কিনা, তা নিশ্চিত করা জরুরি।
একবার এক স্কুলে দেখলাম, ক্লাসে শিক্ষক খুব জোর করে ভাঙা ভাঙা ইংরেজীতে পড়াচ্ছেন। ছাত্রছাত্রীরা শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে শিক্ষকের মুখের দিকে তাকিয়ে শুনছে। পাঠের বিষয়বস্তু সম্পর্কে শিক্ষক যেসব নির্দেশনা দিচ্ছেন ছাত্রছাত্রীরা যে সেসবের কিছুই বুঝতে পারছে না, সেটি তাদের মুখ দেখে এবং শিক্ষকের নির্দেশনা অনুয়ায়ী কাজ করতে না পারা দেখেই আমি বুঝতে পেরেছি। ক্লাস শেষ হলে শিক্ষকের কাছে জানতে চাইলাম, বিভিন্ন ধরনের ইংরেজী বাক্য গঠনের নির্দেশনাগুলো কি ইংরেজীর পর বাংলায় বলে দেয়া যেত না? শিক্ষক বললেন, না। কারণ ইংরেজী ক্লাসে বাংলা না বলার জন্য প্রশিক্ষণে নিষেধ করা আছে। ওই ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, নির্দেশনাগুলো বাংলায় বললে তাদের বুঝতে সুবিধা হতো কি না? ওরা জবাব দিল, খুব ভালো হতো। ছাত্রছাত্রীরা আরও বলল, শিক্ষক সব সময় ইংরেজী বলার ফলে তারা কিছুই বুঝতে পারেনি।আমি জানি যে, ইংরেজী ক্লাসে কখনোই বাংলা বলা যাবে না, এমনটি নয়। তবে যথাসম্ভব বাংলা বলা পরিহার করতে হবে। এ তো গেল ইংরেজী শিক্ষায় আমাদের দুর্বলতার নানা কথা। কিন্তু ইংরেজী শিক্ষা নিয়ে এশিয়া অন্যান্য দেশ কী করছে সে বিষয়ে আমাদের ব্যাপক অনুসন্ধান চালানো দরকার বলে আমার মনে হয়। তারপর তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার এখনোই সময়।তাছাড়া অন্য কোন পথ নেই।
সাংবাদিক -মাসিক জাতীয় শিশু-কিশোর হাতেখড়ি।
Leave a Reply