চৈত্র পেরিয়ে বৈশাখ চলছে অথচ ঠান্ডা হাওয়া গায়ে ছোয়া দিচ্ছে। প্রকৃতির এই বিরূপ আচরনের সাথে তাল মিলিয়ে ছেলে-মেয়ে দুটি এখনও নিদ্রা রাজ্যে বিচরণ করছে। ঘড়ির কাটা ৭টা ছুঁই ছুঁই। ওদের মা ওদেরকে ডাকছে, ‘ওঠো! পড়তে বসো।’ চোখে-মুখে বিরক্তের ছাপ। ঠান্ডা হাওয়া বহমান থাকলেও নিরূপায়, পড়তে বসা ছাড়া বিকল্প নাই। কারণ সামনে ওদের পরীক্ষা।
৫ম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ে পড়ার টেবিলে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে। চোখে ভয়-ভীতি ফুটে উঠছে। জিজ্ঞাসা করতেই ভয়ে ভয়ে উত্তর দিল ‘আমাকে কোচিং সেন্টারে ভর্তি করায়ে দাও। আমি অংক পারি না।’ পার না কেন মা মনি ? তুমি কি অংক বুঝ না? জিজ্ঞাসা করতেই চোখে জল এসে গেল। মেয়ের কথা শুণে আমার বাল্যকালের কথা মনে পড়ে গেল। আমি যখন ৫ম শ্রেণিতে পড়ি তখন আমাদের গণিত ক্লাস নিতেন পরম শ্রদ্ধেয় গৌর পদ দাস স্যার। আনন্দদায়ক পরিবেশে চমৎকার উপস্থাপন করতেন। ঐ সময়ে আমরা সরল, ঐকিক নিয়ম, শতকরা, সুদকষা অংক কষেছি। স্যার এমনভাবে ক্লাস নিতেন শ্রেণিকক্ষেই আমাদের অংক শিখা হয়ে যেত এবং একই নিয়মের অংক বাড়ীর কাজ দেয়া থাকতো বিধায় আমাদের কোনদিন প্রাইভেট/কোচিং করতে হয়নি। স্যার নিজেও কাউকে প্রাইভেট পড়াতেন না। কিন্তু আমাদের ক্লাসে গণিতে কেউ অকৃতকার্য হয়নি।
২য় সাময়িক পরীক্ষায় গণিতে আমি ৯৫ নম্বর পেয়েছিলাম। ৫ নম্বর কেন কম পেলাম স্যার এটা মেনে নিতে পারেনি। তখন আমাকে খুব বকাঝকা করেছিলেন। পরক্ষণে আমাকে আদর করে বলেছিলেন ‘তোমাকে ১০০ নম্বর পেতে হবে নয়তো আমি মনে কষ্ট পাই।’
আমাদের সময়ে কোচিং সেন্টার কি জিনিস আমরা জানতামই না অথচ আমরা এখন সন্তানদের শিক্ষা দিতে গিয়ে কোচিং সেন্টার নির্ভরতার রোগে ভুগছি। জিপিএ-৫ নামক অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলে আমাদের মাঝে। কে কত নামী-দামী কোচিং সেন্টারে সন্তানদের পড়াচ্ছে তার গর্ব আউরিয়ে বেড়ায় মুখে মুখে। একদিকে কোচিং সেন্টারকে আমরা উৎসাহিত করছি অন্যদিকে কোচিং সেন্টার বন্ধে সরকারের নিকট মিনতি করছি। সন্তানের মেধা থাকুক বা না থাকুক এ নিয়ে আমরা বিচলিত নই। ব্যাপারটি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে কোচিং-এ পড়লেই পরীক্ষায় পাস কিংবা জিপিএ-৫ পাওয়া যাবে। সন্তান কতটা মানসম্পন্ন শিক্ষা গ্রহণ করছে তা নিয়ে যেন কারো মাথা ব্যথা নেই। আমাদেরকে কোচিং নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জিপিএ-৫ নয়, মানসম্পন্ন শিক্ষাই সমাজ ও জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
Leave a Reply