আধুনিক
সমাজে বই
ছাড়া অন্য
কিছু
চিন্তা করা যায়
না।
কেননা,
বই-
ই
মানুষের
মনশ্চক্ষু
খুলে দেয়,
জ্ঞান
ও বুদ্ধিকে প্রসারিত ও বিকশিত
করে এবং ভেতরে আলো জ্বেলে দেয়।
মনুষ্যত্ব অর্জনেরও বড় পথ বই পাঠ। বই
পাঠ
আসলে মানুষের একটি অপরিহার্য
উপাদান। মূলত মানসিক উৎকর্ষ
সাধনে বই পাঠের কোনো বিকল্প
নেই।
বই পাঠের আলো মনে ও
মননে নানাদিক থেকেই বিচ্ছরিত
হতে পারে। উৎকর্ষের বিবেচনায় বই
পাঠ নানা রকম হতে পারে। কেউ
হয়তো প্রকৃতিবিষয়ক একটি বই পাঠ
করে যে জ্ঞান আহরণ করেন, অন্যজন
ধর্মবিষয়ক বই পাঠ করে অন্যতর জ্ঞান
সঞ্চয় করেন। আবার কেউ
হয়তো বিজ্ঞানবিষয়ক বই
পড়ে বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে পড়েন।
আবার
এসব বিষয় একসঙ্গেও পাঠ করা যায়।
কেননা, মানুষের জ্ঞান শুধু
প্রকৃতি কিংবা ধর্ম
কিংবা বিজ্ঞানবিষয়ক বই পাঠের
মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বস্তুত জ্ঞানের
কোনো কোনো সীমা নেই।
চৌহদ্দি নেই। জ্ঞান, অসীম অফুরন্ত
কোনো পাঠে বা দানে হ্রাস পায়
না বরং যতজ্ঞান লাভ করা যায় ততই
মনের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে।
জ্ঞান পাঠের বিষয়, বুদ্ধি চর্চার
বিষয়। আমরা প্রতিদিন যে নতুন নতুন
জ্ঞানের সন্ধান করি,
নিজেকে বিকশিত ও আলোকিত
করি-
তা বই পাঠেরই ফল। তাই বই
ছাড়া কি আমাদের একদিনও চলে?
যাদের মানসিক ক্ষুধা প্রবল, জ্বাল
অন্বেষায় উন্মুখ- তারা এক
বেলা কিংবা দু’বেলা অনাহারে থাকলেও
কিচ্ছু যায় আসে না, কিন্তু তাঁদের বই
না হলে চলে না। সে জন্যই বোধ
করি আল কোরআনে সব কিছুর
আগে মানুষকে লক্ষ্য
করে বলা হয়েছিল : ‘ইক্রা’ অর্থাৎ
পড়।
অর্থাৎ জ্ঞান অন্বেষণ কর। এই জন্যও বই
পাঠের আমরা আলাদা একটা গুরুত্ব
অনুধাবন করি। এই জ্ঞানই
পরবর্তীকালে নানা শাখা-
প্রশাখা বিস্তার
করে এবং মানুষকে নানা ধরনের
জ্ঞানে আলোকিত করে। আজকের
সেই জ্ঞানী মানুষের সেই আলোক
ধারারই উজ্জ্বল ফসল।
আমাদের সমাজে সবাই বই
পড়ে না অর্থাৎ বই পাঠে অভ্যস্ত নয়।
এর
কারণ জ্ঞানের
আলো এখনো তাদের
দুয়ারে পেঁৗছতে পারেনি।
কাজেই
বাংলাদেশের একটা বিশাল
জনগোষ্ঠী অশিক্ষিত থাকার
কারণে বই পড়া তাদের পক্ষে সম্ভব
হচ্ছে না। অথচ এ বিষয়টি আমাদের
গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার।
জ্ঞানের আলো সর্বত্রই
ছড়িয়ে দিতে পারলে বই
পড়া সার্থক
হবে। সম্ভব হবে।
দেশে মেলার সংখ্যাও বাড়বে।
এখন
তো শুধু শহরে বইমেলা হয়_ বিশেষ
দিনে কিংবা বিশেষ মাসে।
পহেলা বৈশাখে কিংবা একুশে ফেব্রুয়ারিতে কিংবা অন্য
কোনো বিশেষ
দিবসে মেলা অনুষ্ঠান তখন
একটি সাধারণ ব্যাপারে পরিণত
হবে।
মানুষকে উদ্বুদ্ধ করারও পথ গ্রন্থ পাঠ।
জ্ঞান তো এক রকম নয়। বইও এক রকম হয়
না। সুতরাং সাধারণ মানুষও অনবরত
পাঠ চর্চার
মাধ্যমে জ্ঞানী মানুষে পরিণত
হতে পারে। জ্ঞানের নব নব
আবিষ্কারেও উৎকর্ষ সাধনে তিনিও
প-িত হতে পারেন। বস্তুত স্বশিক্ষিত
মানুষই সুশিক্ষিত। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-
শেখ শাদী তারা বই পড়েই
জ্ঞানী হয়েছেন, কবি হয়েছেন_
এবং মনুষ্যত্বের অধিকারী হয়েছেন।
সব যুগেই বই পাঠের বিকল্প নেই।
সৃষ্টি উষালগ্ন থেকে শুরু আজ পর্যন্ত
মানুষ বই পড়ে। বই নির্জনে আমাদের
বন্ধু, কোলাহলেও। বই সর্বাবস্থায়ই
আমাদের সহায়ক শক্তি। বই
জীবনকে আলোকিত করে, বিকশিত
করে এবং পরিপূর্ণ করে। বই
কোনোদিন
মানুষের শত্রু হয় না। বরং বই
পাঠে আমরা শত্রুকে মিত্র
করতে পারি। এই আশ্চর্য গুণ কেবল বই
পাঠেই সম্ভব। বই একটি সাঁকো। সুদূর
অতীত থেকে বর্তমান_
এমনকি ভবিষ্যৎ
পর্যন্ত এর ডানা বিস্তার করে আছে।
আমরা এ সাঁকোতে চড়ে অতীত-
বর্তমান ও ভবিষ্যতেও
চলে যেতে পারি। রবীন্দ্রনাথের
সোনালি কথন : ‘মানুষ বই
দিয়ে অতীত
ও ভবিষ্যতের
মধ্যে সাঁকো বেঁধে দিয়েছে।’
অন্যপক্ষে ঠরহপবহঃ ইবহবঃ-এর কথা
দইড়ড়শং ধৎব হড়ঃ সবহ ুবঃ ঃযবু ধৎব ধষষ
ধষরাব
ঞযবু ধৎব ংড়সব সড়হবু ধহফ
যরং ধংঢ়বৎধঃরড়হ
ঞযব ষরহশ নবঃবিবহ
যরং ঢ়ৎবংবহঃ ধহফ
ঢ়ধংঃ,
ঞযব ঃড়ড়ষং নব নঁরষফং রিঃয’.
বই পাঠের
সঙ্গে লাইব্রেরি কিংবা পাঠাগারের
একটি সম্পর্ক আছে। দেশে যত
লাইব্রেরি বৃদ্ধি পাবে ততবেশি পাঠকসংখ্যাও
বৃদ্ধি পাবে।
ফলে দেশে জ্ঞানচর্চা বাড়বে।
মানুষ
বই পড়বে। আনন্দে, উল্লাসে। এর দল
হবে এই দেশে সংস্কৃতিবান মানুষের
জন্ম হবে। সংস্কৃতিবান মানুষের ধর্মই
হলো_ অন্যকে সহায়তা করা, মননশীল
সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করা। বস্তুত
যারা বই
পড়ে না কিংবা বই পাঠের আনন্দ
কিংবা রস যারা উপভোগ
করতে জানে না_ তারা এক
অর্থে ড.
মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতো মূর্খ। মূর্খদের
কাছে জ্ঞান, প্রজ্ঞা,
বিদ্যা অপেক্ষা প্রভাব
প্রতিপত্তি এবং মানবতাই অনেক বড়।
এসব বাস্তব কারণে সমাজে ও
রাষ্ট্রে অবক্ষয় দেখা দেয়।
ফলে সমাজে বাটপার, ধুরন্ধর,
ধড়িবাজ, সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের
দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। সুতরাং এসব
উৎপাত থেকেও
রক্ষা পেতে আমাদের বইয়ের
দ্বারস্থ
হওয়া উচিত।
জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য যেমন বই পাঠের
বিকল্প নেই, তেমনি মনের সুকুমার
বৃত্তিগুলোর বিকাশের জন্যও বই পাঠ
অপরিহার্য। বই থেকে আমরা যা গ্রহণ
করি তা জ্ঞান,
প্রজ্ঞা কিংবা বিদ্যা। বই
ছাড়া এর
কোনোটাই সম্ভব নয়। বর্তমান সভ্য
সমাজেও এর সমাধিক প্রয়োজন
রয়েছে।
বইয়ের ভেতর যত অজস্র জ্ঞান
লুকিয়ে আছে তেমন বোধ হয় আর
কোনো কিছুতে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
যে বই সংস্কৃতিবান মানুষ
সৃষ্টি করতে পারে, একটা জ্ঞানবান
সমাজ গড়ে তুলতে পারে, সমাজে ও
রাষ্ট্রে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারে-
সে বই-ই আমাদের নিত্য পাঠ
করা উচিত। সে জন্য সবাই সময়
করে একবার হলেও বইমেলায় যাবেন।
বই কিনবেন। কেননা, বই কিনে কেউ
দেউলিয়া হয় না। রফিক সৈয়দ
মুজতবা আলীর মতো আমিও বলি :
রুটি ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার
কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে;
কিন্তু বই অনন্ত যৌবনা। সে জন্যই এর
প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম,
উপযোগিতাও। কারণ
কখনো একটি ভালো বই জীবনের
মোড়
ঘুরিয়ে দিতে পারে। যেমন
রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’
আর্জেন্টিনা-
কন্যা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর
(১৮৯০-১৯৭৯)
জীবনকে বদলে দিয়েছিল।
ওকাম্পোর
নিজের কথায় : ‘১৯২৪ সালের
সেপ্টেম্বরে শোনা গেল, বুয়েনস্
আইরেস হয়ে লিমা যাচ্ছেন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার নিজের
ইংরেজি থেকে অথবা জিদের
ফরাসি অনুবাদ
থেকে আমরা যারা জানতাম তার
রচনা, আমাদের তখন শুরু
হলো প্রতীক্ষা। এখানে তার
আবির্ভাব সে বছরের সব
সেরা ব্যাপার। আমার
পক্ষে তো ওটা জীবনেরই
সবচেয়ে বড়
ঘটনা। গীতাঞ্জলি পড়ে কান্নায়
ভরে উঠেছিল চোখ। শুধু
ওকাম্পো কেন, একটি ভালো বই
আদর্শ
বাসগৃহের মতো, পদ্মদীঘির জলের
মতো সি্নগ্ধ এবং তৃপ্তিদায়ক।
যে কেউ এতে বসবাস করতে পারে,
যে কেউ এতে অবাধে স্নান
করতে পারে। বস্তুত বই জীবনেরই
প্রতীক। আনন্দের প্রতীক
এবং অনেকক্ষেত্রে জীবন
বদলে দেয়ারও প্রতীক। সে কারণেই
আমাদের নিত্য নতুন বই পড়া উচিত।
জ্ঞান আহরণ ছাড়াও
নিজেকে জানাও বই পাঠের অন্যতম
প্রধান উদ্দেশ্য। এটা ভারতীয়
দর্শনেরও
(শহড় িুড়ঁৎংবষভ) মূল কথা।
সুতরাং, আমরা বই পড়ব জ্ঞান বিকাশ
জ্ঞান-পিপাসা এবং জ্ঞান-
জিজ্ঞাসা মেটানোর জন্য।
আমরা বই
পড়ব ভদ্র, শালীন, মার্জিত
এবং সংস্কৃতিবান হওয়ার জন্য।
সর্বোপরি আমরা বই পড়ব পরিপূর্ণ
মানুষ
হওয়ার জন্য।
Leave a Reply