ক্যাডারের রাজা “প্রশাসন ক্যাডার”

BCS

ক্লাসে স্যার একটা ঘটনা বলেছিলেন। একজন সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা গিয়েছেন বিসিএস প্রশাসন অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিতে। প্রথম দিন প্রশিক্ষণে রিসোর্স পারসন হিসেবে বক্তব্য দিচ্ছেন প্রশাসন ক্যাডারে একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। তিনি বক্তব্য শুরু করলেন এভাবে, “শুনেন, প্রশাসন ক্যাডার হচ্ছে ক্যাডারের রাজা। সুতরাং, আপনারা অন্য কোন ক্যাডারকে পুছবেননা।”

প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দোষারোপ করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। বরং আমাদের দেশের সিভিল সার্ভিসের কিছু অসঙ্গতি নিয়ে কথা বলাই আমার লক্ষ্য। মুনতাসীর মামুন এবং জয়ন্তকুমার রায় রচিত “প্রশাসনের অন্দরমহল” শীর্ষক গ্রন্থে সরকারি চাকরিতে স্পেশালিস্ট এবং জেনারালিস্ট নিয়ে অনেক কথা রয়েছে। প্রশাসনের গতিশীলতার জন্য রাষ্ট্রে জেনারালিস্টদের প্রয়োজন আছে। কিন্তু কীভাবে একটি দেশে জেনারালিস্টরা মোটামুটি একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে সে বর্ণনাও বইটিতে বিদ্যমান। একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই আমরা দেখতে পাই, বাংলাদেশের নির্বাহী বিভাগের সবগুলো প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদগুলোতে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদচারনা। তারা যে অবৈধভাবে সে পদগুলোতে নিযুক্ত আছেন তা কিন্তু নয়, বরং আইনই তাদেরকে সব জায়গায় শীর্ষ পদের অধিকার দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা পুলিশ বাহিনীর কথা বলতে পারি। এটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়াধীন একটি প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ, এটি তার কাজের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে দায়বদ্ধ। তাদের বেতন-ভাতা সব হয় এই মন্ত্রণালয় থেকেই। এই মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক প্রধান হলেন স্বরাষ্ট্র সচিব যিনি বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা। ফায়ার সার্ভিস, বর্ডার গার্ড, আনসার ও ভিডিপি, বহির্গমন পাসপোর্ট বিভাগ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, কারা অধিদপ্তর- এসব ক’টি প্রতিষ্ঠান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়াধীন। একজন পুলিশ কর্মকর্তা সর্বোচ্চ পদ হিসেবে পুলিশ বাহিনীর প্রধান হতে পারেন, একজন কারা কর্মকর্তা সর্বোচ্চ পদ হিসেবে কারা অধিদপ্তরের প্রধান (এটি আবার সামরিক কর্মকর্তাদের জন্য হয়ে গিয়েছে) হতে পারেন কিন্তু একজন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা তাদের সবার চেয়ে উপরে অর্থাৎ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান অর্থাৎ সচিব হতে পারেন। এক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাদে একই দৃশ্য সব মন্ত্রণালয়ে।

একজন চিকিৎসক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হতে পারেন কিন্তু স্বাস্থ্য সচিব হবেন প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা বা জেনারালিস্ট। শিক্ষা হোক আর অর্থই হোক- সব মন্ত্রণালয়ের প্রধান একজন সচিব। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, একজন জেনারালিস্ট বা প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা কি সব বিষয়ে পারদর্শী? তিনি কি সর্ব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ? ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা যেমন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধানও হন, জাতীয় জাদুঘরেরও প্রধান হন আবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রধানও হন। তিনি কি আইন থেকে শুরু করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের মত পুলিশি কাজ, স্বাস্থ্যসেবার মত চিকিৎসকের কাজ বা জাদুঘর পরিচালনার জন্য ইতিহাস বা প্রত্নতত্ত্ববিদ্যার কাজ সবই পারেন? একজন মানুষ এতকিছু কিভাবে পারেন? অনেকেই বলতে পারেন তিনি তো প্রশাসনিক কাজ করেন, আর প্রশাসনিক কাজ তো সব জায়গায় একই। তাহলে আমার প্রশ্ন, তিনি সব জায়গায় প্রশাসনিক কাজ করতে চান ভাল কথা কিন্তু সব জায়গায় তিনিই কেন সর্বোচ্চ পদের মালিক হবেন? সরকারি সব প্রতিষ্ঠান কোনো না কোনো মন্ত্রণালয়ের অধীন। মন্ত্রীর পরে সেই মন্ত্রণালয়ের বস হচ্ছেন একজন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। খুব অল্প ক্ষেত্রে আমরা বিশেষজ্ঞদের মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসেবে দেখেছি। পুলিশের সাবেক একজন মহাপরিদর্শক স্বরাষ্ট্র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কিন্তু এগুলো ব্যতিক্রম ঘটনা।

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে একবার উন্নত চিকিৎসার জন্য কোন এক যন্ত্র ক্রয় করা হয়। কোন এক উপলক্ষ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয় হাসপাতালে আসেন। সেখানে বক্তব্য দেয়ার সময় সদ্য ক্রয়কৃত যন্ত্রটি সম্পর্কেও বলতে হবে। বক্তৃতা দেয়ার আগে তিনি চিকিৎসকদের কাছে কোন রোগে উক্ত যন্ত্রটি ব্যবহৃত হয় তা জানতে চান। যেকোনো চিকিৎসকই ঐ যন্ত্র কোন রোগে ব্যবহৃত হয়, কীভাবে কেন ব্যবহৃত হয় বলতে পারেন। কিন্তু সচিব মহোদয় চিকিৎসাবিজ্ঞান তো দূরে থাক, বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীও নন। তাকে সেই যন্ত্রের কার্যকারিতা বোঝাতে গিয়ে চিকিৎসকদের খবর হয়ে গেল। এখানে সচিব মহোদয়ের দোষ দেখি না। এটা হল আমাদের সিস্টেমের দোষ। ডাক্তারদের বস যদি প্রশাসন ক্যাডারকে বানানো হয় তাহলে ফলাফল এমনই ঘটবে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কিংবা যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয়গণ কীভাবে প্রকৌশল বিষয়ক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন আমার জানা নাই। চিকিৎসকদের অনুষ্ঠানের মত কিছুই ঘটবার কথা সেখানেও।

আগেই বলেছিলাম, প্রশাসনিক কাজ চালানোর জন্য জেনারালিস্টদের দরকার আছে। একেক মন্ত্রণালয়ের একেক কাজ। মন্ত্রণালয়ের সহকারি সচিব, উপ-সচিব বা যুগ্ম- সচিবদের কাজ মূলত ঐ মন্ত্রণালয়াধীন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, পদন্নোতি, বদলি, পেনশন কিংবা অধীন প্রতিষ্ঠানের জন্য অর্থ বরাদ্দ, ফাইল তৈরি ও মেইনটেইন করা, অন্যান্য দপ্তরের সাথে যোগাযোগ করা ইত্যাদি। কিন্তু প্রশাসনিক পদের কর্মকর্তাদের জন্য কেন সকল মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদগুলো সংরক্ষিত থাকবে? একই যোগ্যতা এবং একই পরীক্ষায় প্রতিযোগিতা করে সাধারণ বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডার ব্যতীত আরও অনেক ক্যাডারে কর্মকর্তারা নিয়োগ পান। এক পররাষ্ট্র ক্যাডার ব্যতীত আর সব ক্যাডারদের বস কেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই হন? কেন তাদের হাতেই সব ক্যাডারদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের অধিকার সংরক্ষিত থাকে? কর বা শুল্ক আদায়ে কর ও শুল্ক ক্যাডার রয়েছে। কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান হলেন প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা। এটি কি কর ও শুল্ক ক্যাডারের কর্মকর্তাদের প্রতি বৈষম্য নয়? পরিবার পরিকল্পনার জন্য পৃথক ক্যাডার থাকলেও পরিবার কল্যাণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হলেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। ভাগ্য ভালো যে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক একজন চিকিৎসক এবং পুলিশের মহাপরিদর্শক একজন পুলিশ কর্মকর্তাই হন। সেখানে এখনও প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা বসে পড়েন নি।

প্রশাসন ক্যাডার বাদে অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা খুব বেশি হলে তাদের অধিদপ্তরের প্রধান হতে পারেন। কেন্দ্রীয়ভাবে অর্থাৎ মন্ত্রণালয়ে প্রধান থাকেন সেই অ্যাডমিন ক্যাডারই। সাধারণ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সর্বোচ্চ পদ যদি নিজ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকই পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে তাহলে সাধারণ বিসিএসে এতগুলো ক্যাডারের দরকার কী? শুধু প্রশাসন ক্যাডার থাকলেই হয়। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা যদি সব মন্ত্রণালয়ে কাজ করতে পারেন তাহলে তারা সব অধিদপ্তরেও কাজ করতে পারবেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান হতে পারলে করও আদায় করতে পারবেন, তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব হতে পারলে বাংলাদেশ টেলিভিশনের উপপরিচালকও হতে পারবেন। খামোখা আর তথ্য ক্যাডারের দরকার কী?

এক স্বশস্ত্র বাহিনী আর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাদে সব জায়গায়তে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই টপ লেভেল বস। সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব তো প্রশাসনিক। তিনি তো আর যুদ্ধ করেন না। সেনাবাহিনী প্রধানের পদটাও প্রশাসনে ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য সংরক্ষণ করা হয় না কেন? দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা সাধারণত পেশাজীবী (স্পেশালিস্ট) হয়। সরকারি চাকরিতে তাদের বদলি, নিয়োগ, পদোন্নতি, বেতনের হিসাব-নিকাশ রাখেন যারা, তারা কী করে তাদের বস হন? একই লোক যদি স্বাস্থ্য সচিব, যোগাযোগ সচিব, গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব কিংবা তথ্য ও যোগাযোগ সচিব- সবই হতে পারেন তাহলে তিনিই কেন চিকিৎসা, প্রকৌশলসহ অন্যান্য সব সেবা দিতে পারেন না?

আমাদের দেশ আজ আমলাতন্ত্রের হাতে বন্দী। এই আমলাতন্ত্র উপমহদেশে চালু করে দিয়ে গিয়েছে ব্রিটিশরা। তারা নিজেদের দেশে এই ব্যবস্থার অনেক সংস্কার সাধন করেছে। আমরা এখনও বের হয়ে আসতে পারি নি এই শোষণমূলক ব্যবস্থা থেকে। ভারতেও আমলাতন্ত্র রয়েছে তবে আমাদের মত হুবহু ব্রিটিশ সিস্টেম তারা ধরে রাখে নি। তারা প্রশাসন, পুলিশ এবং বনের ক্ষেত্রে আলাদা সার্ভিস গঠন করেছে। এক পরীক্ষা দিয়ে সবাইকে নিয়োগ দেয়ার সংস্কৃতি থেকেও তারা বের হয়েছে। সব পেশার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর থেকে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা বা আমলাদের হস্তক্ষেপ বন্ধ করেছে অনেকাংশে। কেননা প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সুবিধা-অসুবিধা কীভাবে বুঝবেন? তাদের হাতে সব জায়গার ক্ষমতা থাকলে ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ কি বৃদ্ধি পায় না? জেনারালিস্টরা কেন অল সাবজেক্ট স্পেশালিস্ট হয়ে উঠবেন?

বিচার বিভাগকে আমলাতন্ত্র থেকে আলাদা করে বাংলাদেশ একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেসি বা আইনি আদেশ জারির দায়িত্ব বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের কাছেই থাকা উচিৎ, আমলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নয়। যার যেটা কাজ তাকে দিয়েই সেটা করানো উচিৎ। সব জায়গায় এক লোক– এই চিন্তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। নইলে ফাইল টেবিল থেকে টেবিলেই ঘুরবে, ফাইল ঘুরতে ঘুরতে পদোন্নতি আটকে থাকবে আর পুলিশ সচিব রাতারাতি হয়ে যাবেন ইঞ্জিনিয়ার সচিব বা ডাক্তার সচিব।

লিখেছেনঃ আহ্‌মদ ইকরাম আনাম





About লেখাপড়া বিডি ডেস্ক 1519 Articles
লেখাপড়া বিডি বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা বিষয়ক বাংলা কমিউনিটি ব্লগ।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*