বিশ্বের আর কোনো জনপদে মন্ত্রী কিংবা সচিব মহাশয়েরা কোনো পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করেন কি না, সে সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। তবে এই দেশে করেন। করার কথাও। কারণ, ১২ বছরের শিক্ষাজীবনে মাত্র চারটি পাবলিক পরীক্ষা দেওয়ার নজির আর কোনো দেশ চালু করতে পারেনি।
আমাদের দেশে পঞ্চম শ্রেণির কোমলমতি শিশুদেরও অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, অচেনা পরিবেশে গিয়ে যা যা মুখস্থ করেছে, তা উদ্গিরণ করে দিয়ে আসতে হয়। আর এই প্রস্তুতি শুরু হয় শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই। শিক্ষার্থীদের প্রকৃত পড়াশোনার পরিবর্তে শেখানো হয় বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় জিপিএ–৫ পাওয়ার তত্ত্ব।
আমাদের দেশের এই চারটি পাবলিক পরীক্ষা বড়ই অদ্ভুত। কারণ, এগুলোতে কেবল শিক্ষার্থীর মুখস্থবিদ্যার দৌড় দেখা হয় এবং তাও একটি পুরোনো পদ্ধতিতে। শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য কিন্তু কোনো কিছু লিখে প্রকাশ করার মধ্যে নিহিত নয়, যেমনটি এই পরীক্ষাগুলো করে থাকে। একজন শিক্ষার্থীকে পড়া, লেখা, বিশ্লেষণ, উপস্থাপনসহ নানা দক্ষতায় দক্ষ করে তোলাই কিন্তু শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু আমরা কেবল দেখি সে কিছু বিশেষ প্রশ্নের লিখিত উত্তর দিতে পারে কি না!
আমাদের জনপ্রিয় শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য এই লক্ষ্যে সাম্প্রতিক সময়ে প্রভূত উন্নতি করেছেন। এখন এসএসসি পরীক্ষায় প্রায় সবাই মনে হয় আগের প্রথম বিভাগের সমতুল্য গ্রেড পায়। নিঃসন্দেহে এটি এই পিছিয়ে পড়া জাতির জন্য এক দারুণ উত্তরণ। তবে কেবল মুখস্থবিদ্যার চর্চার ফলে যে শিক্ষার অন্যান্য উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে পারে, সেটি কিন্তু কেউ ভেবে দেখছেন না। এই যেমন ধরা যাক পড়ার অভ্যাস। আমাদের শিক্ষার্থীরা সেভাবে পড়ার দক্ষতা অর্জন করছে?
উত্তর নেতিবাচক। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক শিক্ষা সংগঠন ‘রুম টু রিড’ তাদের একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, আমাদের প্রথম শ্রেণির পড়ুয়ারা মিনিটে মাত্র ১৬টি শব্দ পড়তে পারে আর দ্বিতীয় শ্রেণির পড়ুয়ারা পারে ৩৩টি। অথচ কোনো একটি লেখা বুঝতে পারার জন্য একজন শিশুর এই পড়ার হার হওয়া দরকার মিনিটে কমপক্ষে ৪৫-৬০। গবেষণায় প্রাপ্ত পরের তথ্যটি আরও ভয়াবহ। দেখা যাচ্ছে, জরিপের আওতায় প্রথম শ্রেণির শতকরা ৩২ ভাগ এবং দ্বিতীয় শ্রেণির শতকরা ১৬ ভাগ শিক্ষার্থী একটি শব্দও পড়তে পারে না! দেশের ১১৪টি স্কুলের চার হাজার ৬৯৪ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে এই জরিপ চালানো হয়েছে। কে না জানে পড়ার সক্ষমতা হচ্ছে জ্ঞানান্বেষণের প্রথম ধাপ। (ডেইলি স্টার, ২৭ জুন, ২০১৪)
নতুন করে আমার এই জরিপের কথা মনে পড়েছে সম্প্রতি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলে। উপাচার্য মহোদয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন এবং নিজে একজন উচ্চমানের বিজ্ঞানী। আমি জানি, তিনি নিশ্চিত না হলে কোনো মন্তব্য করেন না। তাঁর বক্তব্য, আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়ার অভ্যাস উদ্বেগজনকভাবে কমে যাচ্ছে। মুখস্থনির্ভর পরীক্ষাপদ্ধতির কারণে শিক্ষার্থীদের পড়ার ব্যাপারটাতে জোর না দিলেই হয়। গাইড এবং নোটের ব্যবহার এত বেড়েছে যে শিক্ষার্থীদের এক অংশ এখন আর লেখকের নাম বলতে পারে না। উপাচার্য মহোদয় লক্ষ করেছেন এসএসসি ও এইচএসসিতে সর্বোচ্চ জিপিএ পাওয়া শিক্ষার্থীরাও তাঁর এখানে খুবই হতাশাজনক পারফরম্যান্স করছে।
স্যারের দুঃখ এখানে যে মাত্র ১০ বছর আগেও পরিস্থিতি এতটা খারাপ ছিল না। তিনি আশঙ্কা করছেন, এমন চলতে থাকলে ভবিষ্যতে দেশ চালনার মতো প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তি আমাদের বাইরে থেকে নিয়ে আসতে হবে।
স্যারের এই আশঙ্কা যে কতটা সত্য হতে পারে তা আমার সাম্প্রতিক কিছু অভিজ্ঞতায় দেখেছি। গত কিছুদিন বেশ কিছু চাকরির নিয়োগ বোর্ডে থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত চাকরিপ্রার্থীদের অধিকাংশই তাঁদের পাঠ্যপুস্তকের রচয়িতার নাম বলতে পারেননি। পরে আমার এক সহকর্মী আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে ‘এখন আর পাঠ্যবই পড়তে হয় না। নোট পড়লেই হয়।’
আমাদের পূর্ব প্রজন্মের কথা না হয় বাদই দিলাম, আমাদের প্রজন্মেও শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশের মধ্যে পড়ার ব্যাপারটা ছিল। সেটি পাঠ্যপুস্তক হোক কিংবা অপাঠ্যপুস্তক হোক। নিজেদের মধ্যে গল্পের বই আদান-প্রদান করা ছিল আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে মাসুদ রানা আর কিরীটী রায়ের নতুন বই কেনায় আমাদের কোনো কার্পণ্য ছিল না। অথচ এখন ইন্টারনেট আর তথ্যপ্রযুক্তির কারণে বিশ্বের সব ধ্রুপদি বই পড়ার সুযোগ চলে এসেছে হাতের মুঠোয়। কিন্তু আমরা পড়ছি কই?
চার-চারটি পাবলিক পরীক্ষার ব্যবস্থাপনার কারণে এখন শিক্ষাবছরও সংকুচিত হয়ে পড়েছে। নভেম্বরের আগেই শিক্ষাবছরের সব কার্যক্রম শেষ করতে হয়। কারণ, ১–২ নভেম্বর থেকেই শুরু হয় জুনিয়র সার্টিফিকেট পরীক্ষা, তারপর প্রাথমিক সমাপনী। এ ছাড়া, কোনো কোনো বিদ্যালয়ে থাকে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা। এই সময়গুলোতে সেই স্কুল বন্ধ থাকে। ফলাফল হচ্ছে শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দেখা-সাক্ষাতের সময় কমে যাওয়া। শহরের এবং অবস্থাপন্ন পরিবারের শিক্ষার্থীরা এটি পুষিয়ে নিচ্ছে গৃহশিক্ষক বা কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে। কিন্তু অধিকাংশই সেটা পারে না।
অনেকের ধারণা, বেশি বেশি পরীক্ষা নেওয়া হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়ে। কিন্তু ব্যাপারটি মোটেই সত্য নয়। এ কারণে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাব্যবস্থা বলা হয় ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থাকে, সেখানে ১৮ বছর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কোনো পাবলিক পরীক্ষা দিতে হয় না।
আগামী দিনগুলোতে আমাদের শিক্ষার্থীদের বিশ্বমানের কর্মী, প্রশাসক এবং নেতা বানাতে হলে আমাদের এই পরীক্ষার জঞ্জাল থেকে বের হতেই হবে।
মুনির হাসান : যুব কর্মসূচি সমন্বয়কারী, প্রথম আলো ও সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি।
Leave a Reply