১৮/০৬/২০১৫ইং তারিখ বৃহস্পতিবার খুলনার ঐতিহ্যবাহী বি.এল কলেজের সম্মুখে দৌলতপুর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্ত্বরে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী ও সমাজের সকল স্তরের বিবেকবান মানুষের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সকাল ১০.৩০ মিনিটে সম্প্রতি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ঘোষিত অনার্স প্রথম বর্ষে শুধুমাত্র জিপিএ’র মাধ্যমে ভর্তি বন্ধের দাবিতে এক বিশাল মানব বন্ধন কর্মসূচী পালিত হয়েছে।
শুধুমাত্র জিপিএ’র ভিত্তিতে অনার্স প্রথমবর্ষে ভর্তি বন্ধের দাবিতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে শুধুমাত্র জিপিএ’র ভিত্তিতে অনার্স প্রথমবর্ষে ভর্তি বন্ধের দাবিতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে মানববন্ধন কর্মসূচীতে বলা হয় এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এই মানব বন্ধন কর্মসূচীর মূখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রকৃত মেধার মূল্যায়নের মাধ্যমে সকলের জন্য উচ্চশিক্ষা গ্রহণ নিশ্চিত করা।
দেশনেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নিত করার লক্ষে বিবিধ উন্নয়নমূলক কর্মসূচী গ্রহণ করেছেন। এসকল উন্নয়ন পরিকল্পনার মধ্যে আন্যতম হচ্ছে শিক্ষা খাতকে উন্নত বিশ্বের ন্যায় যুগোপযোগী ও বাস্তবভিত্তিক করে ঢেলে সাজানো। আর এজন্যই শিক্ষা খাতকে তিনি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছেন।
১৯৯২ সালে সাধারণ মানুষের উচ্চশিক্ষা গ্রহনের সুবিধার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে আজ অবধি শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে কোন ধরনের উন্নয়ন ঘটাতে পারেনি এই বিশ্ববিদ্যালয়টি। সময়মত পরীক্ষা না নেওয়া, একাডেমিক ক্লাশ না হওয়া, সেশন জট তীব্র আকার ধারণ করাসহ বিবিধ প্রশাসনিক দূর্নীতি ও সেচ্ছাচারিতার জন্য উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সবথেকে বড় প্রবিষ্ঠানটির একাডেমিক কার্যক্রম এখন প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে এবং উচ্চশিক্ষার যথাযথ মান নিশ্চিত করার লক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিছুদিন আগে ঘোষণা দেন যে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধীনে থাকা সকল সরকারি কলেজসমূহকে আগামী তিন মাসের মধ্যে নিকটস্থ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর কাছে ছেড়ে দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা শোনার পরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীর মনে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার লাভ করে এবং তারা তাদের ভবিষ্যতকে ভিন্নভাবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।
কিন্তু বর্তমান সময়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অমান্য করে তাদের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার লক্ষে সেশন জট দূর করার নামে বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক সিদ্ধান্ত সাধারন ছাত্র-ছাত্রীদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন।
সম্প্রতি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিয়েছে ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে অনার্স প্রথমবর্ষে ভর্তির জন্য কোন ধরনের ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হবে না। শুধুমাত্র এসএসসি ও এইচএসসি’র জিপিএ’র ভিত্তিতেই ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা হবে। এটাকে একদিকে মেধার চরম অবমূল্যায়ন ও অপরদিকে গ্রামের ও মফস্বলের ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্চশিক্ষা লাভ করা থেকে বঞ্চিত করার গভীর ষড়যন্ত্র হিসেবেই মনে করেছে আন্দোলনকারীরা।
শুধুমাত্র জিপিএ’র ভিত্তিতে অনার্স কোর্সে ভর্তি সমাজের কোন স্তরেই কখনোই গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি। আমাদের দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদগণ বরাবরই এ পদ্ধতির বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছেন এবং তারা তাদের যুক্তির স্বপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ ও বাস্তবতার মূল্যায়ন পেশ করেছেন। আমরা সকলেই জানি গত বছরে মেডিকেল কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা দিয়েছিল যে, তারা শুধুমাত্র জিপিএ’র মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করবে। কিন্তু পরবর্তীতে তারা এই ভর্তি কাঠামো পর্যলোচনা করে দেখল যে এই পদ্ধতিতে কখনোই প্রকৃত মেধার মূল্যায়ন করা সম্ভবপর হবে না। তাই তারা এই পদ্ধতিটি অবিলম্বেই বাতিল বলে ঘোষণা করে। আর বাতিল একটি পদ্ধতিই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখন আকড়ে ধরতে চাচ্ছে যা তাদের অত্যন্ত দূরভিসন্ধিমূলক কাজ বলেই আন্দোলনকারীরা মনে করছে।
জিপিএ’র মাধ্যমে ভর্তির ক্ষেত্রে সাধারণত যে সকল প্রতিবন্ধকতাসমূহ তৈরি হতে পারে সেগুলো নিচে তুলে দেওয়া হলোঃ
১. জিপিএ’র মাধ্যমে ভর্তির ক্ষেত্রে সবথেকে বড় সমস্যা হচ্ছে এখানে কোন ছাত্র-ছাত্রী একাডেমিক রেজাল্টের বাইরে তার সৃজনশীলতা প্রকাশের কোন ধরণের সুযোগ পাবে না।
২. আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা হচ্ছে বহুমূখী অর্থাৎ সাধারণ, মাদ্রাসা, কারিগরি, উন্মুক্ত ও ইংরেজি মাধ্যম। তাই এই শিক্ষা ব্যবস্থায় কখনোই জিপিএ’র সমন্বয় সাধন সমানভাবে করা সম্ভব নয়। কারন এখানে মাদ্রাসা, কারিগরি ও উন্মুক্ত শিক্ষার মান নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
৩. মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর-ই জিপিএ ৫.০০ থাকে। কিন্তু বিগত সালের ভর্তি পরীক্ষাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায় তারা মেধার ভিত্তিতে ভালো কোন বিষয়ে চান্সই পায় না। এর ফলে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা মেধা থাকা সত্বেও পিছিয়ে পড়বে।
৪. অধিকাংশ সময়ই লক্ষ করা যায় যে শুধু জিপিএ ৫.০০ দিয়েই মেধার মূল্যায়ন সঠিক হয় না। উদাহরণসরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাগুলোতে জিপিএ ৫.০০ না থাকা সত্বেও মেধা থাকার কারনে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
৫. মেধার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষার বদলে শুধুমাত্র জিপিএ’র ভিত্তিতে ভর্তির সুযোগ যদি বাস্তবসম্মতই হতো তাহলে মেডিকেল কলেজ, ইজ্ঞিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালগুলো শুধুমাত্র জিপিএ’র ভিত্তিতেই ভর্তি পরীক্ষা নিত যা গ্রহণযোগ্য কোন সমাধান নয়। এই বাস্তবতাকে উপলদ্ধি করেই গতবছর মেডিকেল কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জিপিএ’র ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েও পিছু হটেছে। কারণ তারা উপলদ্ধি করতে পেরেছে যে শুধুমাত্র জিপিএ’র মাধমে ভর্তি নেওয়া মেধা যাচাইয়ের কোন সঠিক পদ্ধতি হতে পারে না।
৬. পরিসংখানে দেখা যায় ভালোমানের সরকারি কলেজগুলোতে জিপিএ ৫.০০ নিয়েও অনেক ছাত্র-ছাত্রী চান্স পায় না। এর প্রধান কারন আসন সংখ্যার অপর্যাপ্ততা এবং শহরের কলেজগুলোর জিপিএ ৫.০০ এর আধিক্য। সুতরাং এই বাস্তবতায় মফস্বলের বা গ্রামের ছেলেমেয়েদের চান্স পাওয়ার প্রশ্নই আসে না।
৭. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১লা অক্টোবর থেকে ভর্তি কার্যক্রম শুরু করলে তখন অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরই ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন হবে না। এমতবস্থায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃষ্টি হবে নতুন সংকট। কারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কার্যক্রম শেষ না হওয়ার ফলে প্রাথমিকভাবে সকলেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে বাধ্য হবে কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফল ঘোষণার পর দেখা যাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি বাতিলের মিছিল। এর ফলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সমূহ রাতারাতি শূন্য হয়ে যাবে। এতেকরে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীরই দুই বা ততোধিকবার ভর্তি হতে হবে যা অনেকের পক্ষেই কষ্টসাধ্য হবে। এর ফলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে যাবে। কারন শূন্য আসন পূরণ করতে রিলিজ স্লিপের মাধ্যমে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত লেগে যাবে। তাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালের ভর্তি পরীক্ষার আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা কোনভাবেই বাস্তবসম্মত হতে পারেনা।
৮. জিপিএ’র মাধ্যমে ভর্তি করলে মেধাশূন্য একটি জাতি তৈরি হবে। প্রকৃতপক্ষে জিপিএ’র মাধ্যমে ভর্তি নেওয়া মেধা যাচাইয়ের কোন মাপকাঠি হতে পারে না, তাহলে উন্নত বিশ্বেও ভর্তি পরীক্ষার দরকার হতো না।
৯. এসএসসি ও এইচএসসির রেজাল্ট যদি মেধা মূল্যায়নের চূড়ান্ত মাপকাঠি হয়ে থাকে তাহলে এই দুটি সার্টিফিকেটের কল্যাণে অনার্স ও মাস্টার্সের রেজাল্ট দিয়ে দিন এবং পরবর্তীতে এর ভিত্তিতেই বিসিএস ক্যাডার নিয়োগ দিয়ে দিন।
১০. সর্বোপরি আমাদের দেশের পাবলিক পরীক্ষাগুলো এখনো শতভাগ সচ্ছভাবে সম্পন্ন হচ্ছে তা বলা যাবে না। সুতরাং এখানেও অনেক প্রশ্ন দেখা দিতে পারে।
আন্দোলনকারী সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা ও দেশের সচেতন নাগরিকগণ মনে করেন যে, নিজেদের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতাকে ধরে রাখার জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেশন জট দূর করার নামে বিভিন্ন ধরণের উচ্চশিক্ষা ধ্বংসকারী সিদ্ধান্ত প্রণয়ন করে চলেছে। যেটি জাতিকে মেধাশূন্য করার গোপন চক্রান্ত বলেই মনে হচ্ছে।
তাই আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিকট সাধারণ মানুষকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের শেষ আশ্রয়স্থল থেকে বঞ্চিত না করার জন্য আকূল আবেদনও করা হয়েছে এবং অবিলম্বে শুধুমাত্র জিপিএ’র মাধ্যমে অনার্স প্রথম বর্ষের ভর্তির সিদ্ধান্ত বাতিল করে পূর্বের ন্যায় জিপিএ এবং ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করে যাতে সাধারণ তথা গ্রাম এবং মফস্বলের ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষা লাভের শেষ সপ্নটুকুও বেঁচে থাকে সেই আহ্বান ও করা হয়েছে।
শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীকে দেখানোর জন্য এবং নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য এধরনের আইওয়াশ না করার জোর দাবি জানিয়েছে আন্দোলনকারীরা।
তাদের দাবি না মানলে পরবর্তীতে সারা দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে ভিসি পদত্যাগসহ আরও কঠোরতর আন্দোলনে যাওয়ার কথাও জানিয়েছে তারা।
Leave a Reply