বৈরী আবহাওয়ায় চাষ উপযোগী নুতন ইনব্রিড জাতের ধান উদ্ভাবন করলেন বাকৃবি’র গবেষক

ধান বিক্রি করে উৎপাদন খরচের অর্ধেকও মিলছে না কৃষকের। চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ধান চাষ করে দেনা পরিশোধ করতে না পারায় কৃষকের চোখে-মুখে এখন হতাশার গ্লানি। আবার প্রতিকূল আবহাওয়া বন্যা, খরায় ভাল ফলন না হওয়ায় কৃষকের মাথায় হাত, পোকার আক্রমণে ফলনহানি, উচ্চফলনশীল জাত চাষে করে কাঙ্খিত ফলন না হওয়ায় কৃষকের ক্ষতি এমন অসংখ্য শিরোনাাম পত্রিকার পাতায় আমরা প্রায়ই দেখে থাকি। সবসময় সবার হয়ত তেমন কিছু করার থাকে না। কিন্তু পত্রিকার এই শিরোনাম গুলোই তারিত করেছে কৃষিবিদ ড. মোঃ নাজমুল হক শাহিনকে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায়ই তিনি কৃষকের উন্নয়নে, দুর্দশা লাঘবে কিছু করার চেষ্টা করার প্রত্যয়ব্যক্ত করেন। তিনি কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিষয়ে জাপানের কচি ইউনির্ভাসিটি হতে পি এইচ ডি ডিগ্রী ও পোষ্ট ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি বাংলাদেশী ইন্ডিকা ধানের জাতের উৎপত্তি ও বিবর্তনের বিষয়ে মতবাদ প্রকাশ করেন যা আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃত। ফিলিপাইনের আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনষ্টিটিউট হতে দক্ষিণ এশিয়া ও এশিয়াতে বৈরী জলবায়ুতে চাষ উপযোগী ধান চাষ ও নতুন জাত উদ্ভাবনের বিষয়ে প্রশিক্ষণ লাভ করেন। তিনি নিত্য নতুন ধানের জাত উদ্ভাবনের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন ধান উৎপাদকারী দেশ সমূহের বিভিন্ন প্রশিক্ষণে অংশ গ্রহন করেন। দীর্ঘ ১৯ বছরের নিরলস সাধনায় তিনি দেশী ধানের জাত হতে ট্রান্সগ্রেসিভ সেগ্রিগেন্ট ব্রিডিং এর মাধ্যমে উচ্চ ফলনশীল, বৈরী আবহাওয়ায় চাষ উপযোগী ও পুষ্টিগুণ সম্পন্ন নুতন ইনব্রিড ৮৫০ জাতের ধান উদ্ভাবন করেছেন। Dhan
২৩ মে শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে তাঁর উদ্ভাবিত ধানের জাতগুলো সম্পর্কে বলেন তিনি। সংবাদ সম্মেলনে কৃষিবিজ্ঞানী ড. শাহিন জানান, ১৯৯৭ সনে তিনি হাইব্রীড ধানের জাত গবেষণা করার সময় লক্ষ করেন দেশী ধানের জাতকেও কৃত্রিম সংকরায়ণের মাধ্যমে উচ্চ ফলনশীল বানানো সম্ভব। দেশী ধানের জাতকে উচ্চফলনশীল করবার অন্যতম উপায় হলো কৃত্রিম সংকরায়নের পর মাতৃ ও পিতৃ গাছ অপেক্ষা গুণাগুণ বিচারে সকল দিক থেকেই উত্তম এমন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ট্রেইন খুঁজে বের করা। বাংলাদেশের কৃষকের জমিতে আমন মৌসুমে জন্মে এমন একটি জংলী (ডরষফ) ধানকে বেছে নিলেন গবেষণার বিষয় হিসেবে। নেত্রকোনা জেলার দূর্গাপুর উপজেলা হতে সংগৃহীত ধানটি বিভিন্ন আমন ধানের জাতের সাথে সাদৃশ্য খোঁজা হয়। কিন্তু কোন জাতের সাথে মিল না পাওয়ায় মৌসুম ও সংগহকারী ড. নাজমুল হক শাহিন ও হোসনে আরা নার্গিস দোলার নাম অনুযায়ী নামকরণ করা হয় ‘দোলা আমন’ হিসাবে। গবেষণা মাঠে ধানের জাতটির বিঘা প্রতি ফলন ১১ মন, ঝড়ের ফলে গাছ হেলে পড়ে ও ধানের ছড়াতে ধানের সংখ্যা ১৪০-১৫৫টি। দোলা আমন ধানে কৃত্রিম সংকরায়ন ও প্রোজেনী নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি উদ্ভাবন করেছেন ৮৫০টি নতুন উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত, যা দেশী ধানের জাতের উন্নত রূপ। সুদীর্ঘ ১৯ বছর (১৯৯৭ সন হতে ২০১৫) পর তিনি তার গবেষণার সুফল পেলেন। উদ্ভাবিত ধানের জাত গুলির গড় ফলন বিঘা প্রতি ৩২-৪৪ মন যা দোলা আমন ধানের জাতের ফলন অপেক্ষা তিনগুনেরও বেশী।
উদ্ভাবিত জাতগুলোর বৈশিষ্ট সম্পর্কে তিনি বলেন, ধানের জাত গুলির মূল বৈশিষ্ট্য হল ধান গাছের কান্ড ও বায়োমাস বেশী হওয়াতে ৯৫ সে.মি. হতে ১৩৫ সে.মি. উচ্চতার হওয়ার পরও ৮০-৯৬ কি:মি: বেগে ঝড় হলেও জমিতে হেলে পরে না। রোপনকৃত একটি চারা হতে প্রতিটি গাছে সর্বনি¤œ ১০টি হতে সর্বোচ্চ ২৮টি কুশি উৎপন্ন হয়। প্রতিটি ধানের শীষের দৈর্ঘ্য ২৫ সে.মি. থেকে ৪০ সে.মি.। প্রতি শীষে পুষ্ট দানার সংখ্যা ২৫০টি হতে ৩৫০টি। ধানের জাতগুলো প্রচলিত ধানের জাত অপেক্ষা তিন ভাগের এক ভাগ কম সার প্রয়োগ করে চাষাবাদ করা সম্ভব। উদ্ভাবিত নতুন ধানের জাত গুলোতে রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমন নাই বললেই চলে। নতুন ধানের জাতগুলো আউশ, আমন এবং বোরো মৌসুমে চাষ উপযোগী হবে। ধানের জাতগুলো নিচু হতে উঁচু জমিতে চাষ করা যাবে। হাওরে চাষ উপযোগী অনেক গুলো ধানের জাত এতে অন্তর্ভূক্ত আছে। ধানের চাল সাদা, লম্বা চিকন, মাঝারি চিকন ও মাঝারি রকমের মোটা এবং খেতে সুস্বাদু। এই ৮৫০টি ধানের জাতের মধ্য বেশ কয়েকটি রপ্তানী যোগ্য সুগন্ধি ধানের জাতও রয়েছে। এই ধানের জীবনকাল ১০৫ হতে ১৪৫ দিন।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ব বিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব এবং কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগে ও দূর্গাপুর, নেত্রকোনা এবং খুলনা ফার্মের কৃষি স্বাস্থ্য সেবা ক্লিনিকে গবেষণা করে দেখা গেছে, উদ্ভাবিত ধানের জাতগুলো নাইট্রোজেন সার ব্যাবহারে সাশ্রয়ী। কোন প্রকার নাইট্রোজেন সার ব্যবহার না করে শুধুমাত্র গোবর, এমওপি ও টি.এস.পি সার প্রয়োগ করে ব্রি-ধান ২৯ অপেক্ষা হেক্টর প্রতি ১টন বেশী ফলন পাওয়া সম্ভব। ধানের জাতগুলো নি¤œ তাপমাত্রা, লবনাক্ততা ও জলবদ্ধতা সহনশীল। এছাড়া এই ধান গুলোর পুষ্টিমানও অনেক বেশি। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের পরীক্ষাগারে খাদ্যগুণ বিচারে উদ্ভাবিত ধানের নতুন জাতগুলোতে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের পরিমাণ পরীক্ষায় ধানগুলোর চালে সর্বোচ্চ আয়রনের পরিমান ৫৮.০৮ পি.পি.এম যা পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত বিদ্যামান আয়রন সমৃদ্ধ ধানের জাত অপেক্ষা ৭গুণ বেশী। অপরদিকে ধানের জাতগুলোর চালে সর্বোচ্চ জিংকের পরিমান ৪৬.৩৮ পি.পি.এম যা ব্রি-ধান ৬৪ অপেক্ষা দ্বিগুনেরও বেশী।
ড. শাহিন উদ্ভাবিত ধানের জাতগুলো গত বোরো মৌসুমে হেক্টর প্রতি ফলন পরীক্ষায় ৭.৫ টন হতে ১৩ টন পাওয়া যায়। চলতি বোরো মৌসুমে বগুড়ার জেলার গাবতলী উপজেলার হাতীবান্দা গ্রামে কৃষকের জামিতে ৮৫০টি ধানের জাত বিভিন্ন প্রকার ধানের জমিতে কৃষকের ব্যবস্থাপনায় চাষাবাদ করে এখন পর্যন্ত ২৫টি জাতের ফলন হেক্টর প্রতি ৯ থেকে ১২ টন অর্থাৎ বিঘা প্রতি ৩২ হতে ৪৪মন পাওয়া গেছে।
তিনি আরও বলেন, উদ্ভাবিত ধানর জাতগুলো পৃথিবীতে ধান সম্পর্কিত গবেষনায় এক নতুন মাত্র যোগ করবে। দেশী ধানের জাতে ফলন বৃদ্ধি করার এটি সবচেয়ে বড় ঘটনা। বাংলাদেশ এর মাধ্যমে অর্জন করবে সর্বোচ্চ ফলনশীল দেশী ধানের ইনব্রীড জাত উদ্ভাবনের কৃতিত্ব। যা বিজ্ঞানীদের এযাবৎ কালের ধান সম্পর্কিত অনেক ধারণাকেই পাল্টে দেবে। উদ্ভাবিত নতুন ধানের জাতগুলোর জেনোম সিকোয়েন্সিং এর মাধ্যমে প্যাটেন্ট করে বাংলাদেশ সরকার দেশের জাতীয় সম্পদে অন্তর্ভূক্ত করে ধান গবেষনাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। সর্বোপরি বাংলাদেশের কৃষি ও অর্থনীতির উন্নয়নে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করেন তিনি।
ড. নাজমুল হক শাহীন তাঁর নিজেস্ব ব্যয়ে সুদীর্ঘ ১৯ বছর গবেষনা কার্যক্রম চালিয়ে এসেছেন। গত দুই বছর যাবৎ বায়োটেকনোলজিষ্ট আনিছার রহমান তাঁকে গবেষণা কাজে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে আসছেন। বর্তমানে গবেষনার পরিধি বৃদ্ধি পাওয়ায় তাঁর পক্ষে গবেষনা কার্যক্রম পরিচালনা করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। এখন প্রয়োজন বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক গবেষণা মহলের সহযোগীতা। কৃষকদেরকে স্বল্পমূল্যে উদ্ভাবিত নতুন জাতের ধানের বীজ বিতরণ করাই তার মূল লক্ষ্য। তবেই কৃষক পাবে খাদ্যে নিরাপত্তা ও উন্নত জীবন যাপন এবং পৃথিবীতে সূচিত হবে “দ্বিতীয় সবুজ বিল্পব”।
সৌজন্যেঃ নয়া দিগন্ত





About লেখাপড়া বিডি ডেস্ক 1519 Articles
লেখাপড়া বিডি বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা বিষয়ক বাংলা কমিউনিটি ব্লগ।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*