পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ১০ অনিয়ম চিহ্নিত

ইউজিসি

একদিকে নানা অনিয়ম, অন্যদিকে শিক্ষক আন্দোলনে অস্থির অবস্থা একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের। প্রায় ১০ মাস আগে এইচএসসির ফল বেরোলেও এখনো ভর্তিপ্রক্রিয়া শেষ হয়নি। অথচ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ব্যাচের শিক্ষার্থীদের এরই মধ্যে তিনটি সেমিস্টার শেষ হয়ে গেছে।

বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষক আন্দোলন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এসব আন্দোলন মূলত উপাচার্যকে ঘিরে। এতে ব্যাহত হচ্ছে ক্লাস-পরীক্ষা, বাড়ছে সেশনজট। এ পরিস্থিতিতে সম্প্রতি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ১০টি অনিয়ম চিহ্নিত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো ক্ষমতা নেই বলে প্রতিবেদন জমা দিয়েই দায় সেরেছে ইউজিসি। আর এসব অনিয়ম ও আন্দোলনের ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তেমন কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করছে না।

 

ইউজিসি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অডিট করার সময় তাঁরা ১০টি অনিয়ম দেখতে পেয়েছেন। যেমন পূর্বানুমতি ছাড়া নতুন বিভাগ খোলা, অনুমোদন ছাড়াই বিজ্ঞপ্তির অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ, এক খাতের টাকা অন্য খাতে ব্যয়, টেন্ডার ছাড়া কেনাকাটা, উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্পের (হেকেপ) টাকা লুটপাট, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিভাগ, হলসহ বিভিন্ন পর্যায়ে নানা অদ্ভুত খাতে ফি আদায়, আদায় করা ফির সামান্য অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা দিয়ে বেশির ভাগই শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজেদের মধ্যে ভাটবাটোয়ারা, নিজস্ব আয় গোপন, আবাসিক শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিধিবহির্ভূতভাবে বাড়িভাড়া ও ভাতা দেওয়া, উচ্চতর ডিগ্রির জন্য ইনক্রিমেন্ট প্রদান এবং ইনক্রিমেন্টের ওপর ভিত্তি করে মহার্ঘ ভাতা, বাড়িভাড়া ভাতা, বিনোদন ও পেনশন প্রদান। এসব অনিয়মের ব্যাপারে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হলেও ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। তাই প্রশাসনিক ব্যবস্থার সুপারিশ করে গত সপ্তাহের শুরুতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়।

 

জানতে চাইলে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অডিট করার সময় নানা অনিয়ম ধরা পড়ে। এ ধারা অনেক দিনের। বারবার চিঠি দিলেও তার সাবধান হয়নি। তাই মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেব। আর কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন হয়। আসলে কারো কারো চেষ্টাই থাকে যেভাবেই হোক আন্দোলন জমিয়ে তোলা। এটা খুবই খারাপ প্র্যাকটিস। নতুনগুলোসহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া সম্ভব নয়। এটা শিক্ষকদের বোঝা উচিত।’

 

গত বছরের আগস্টে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিট আপত্তির ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের আর শ্রান্তি বিনোদন ভাতা দেওয়া যাবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়, এ ধরনের ভাতা দেওয়া আর্থিক বিধিমালা সমর্থন করে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ইউজিসিকে চিঠি দেয়। কিন্তু এখনো এ ভাতা চালু আছে। আর অডিট আপত্তির বিষয়ে মন্ত্রণালয় দুটি কমিটি করলেও গত ১০ মাসে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি।

 

এসব বিষয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘শ্রান্তি বিনোদন সেই ১৯৮৩ সাল থেকে চলে আসছে। এখন এটা বন্ধ করলে কী অবস্থা হবে তা সহজেই অনুমেয়। তবে সরকারের সিদ্ধান্ত আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জানিয়ে দিয়েছি। আমাদের তো আর বন্ধ করার ক্ষমতা নেই।’

 

ইউজিসির সর্বশেষ প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেতন ভাতাদি, বিদ্যুৎ খাতে ব্যয় বেড়েই চলেছে। বাজেটবহির্ভূত জনবল নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে ইউজিসির নীতিমালা অনুসরণ না করার কারণেই এ অবস্থা। বেতন, ভাতা ও পেনশনেই বাজেটের ৭৩ শতাংশ চলে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ, পরিবহন ও স্কুল খাতে ১৬ শতাংশ আর শিক্ষাসহ অন্যান্য খাতে খরচ হচ্ছে বাকি ১১ শতাংশ।

 

বিভিন্ন অনিয়ম আর অস্থিরতার অভিযোগে সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে ইউজিসি। বর্তমানে কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে তদন্ত চলছে।

 

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের ভিসিবিরোধী আন্দোলনে কয়েক মাস ক্লাস-পরীক্ষা হয়নি। মূলত শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া আদায় নিয়েই আন্দোলন শুরু। পরে তা ভিসির পদত্যাগে গিয়ে ঠেকে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো শেষ হয়নি অনার্সে ভর্তি পরীক্ষা। ৪ থেকে ৭ মে এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে চার মাস বন্ধ ছিল সব কার্যক্রম। গত ৩০ এপ্রিল সেখানে ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট প্রকট। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও বেশ কিছুদিন ধরে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন চলছে। সম্প্রতি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৫ জন শিক্ষক বিভিন্ন প্রশাসনিক পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। উপাচার্য দুই মাসের ছুটিতে গেছেন। এ ছাড়া রাজশাহী, কুমিল্লা, খুলনা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের পক্ষে-বিপক্ষে আন্দোলন-পাল্টা আন্দোলন চলছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে ক্লাস-পরীক্ষা।

 

এসব বিষয়ে ইউজিসির অতিরিক্ত পরিচালক ফেরদৌস জামান বলেন, ‘উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে অনেক সময় যৌক্তিক কিছু ইস্যুর সঙ্গে অযৌক্তিক বিষয় যোগ হয়। সাধারণত দেখা যায়, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক উপাচার্য পদে নিয়োগ পেলেই আন্দোলন শুরু হয়। যার যার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়োগ হলে পারস্পরিক বোঝাপড়া ভালো থাকে। আর বিভিন্ন অনিয়ম আর অস্থিরতার বিষয়ে আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না। কারণ ইউজিসির সে ক্ষমতা নেই। আমরা মন্ত্রণালয়কে জানাই। ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব তাদের।

তথ্য সূত্র: দৈনিক কালের কন্ঠ, ৪ মে ২০১৫।





About লেখাপড়া বিডি ডেস্ক 1519 Articles
লেখাপড়া বিডি বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা বিষয়ক বাংলা কমিউনিটি ব্লগ।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*