ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান:
লেখার শুরুতেই আজ মনে পড়ে গেল সেই জালাল উদ্দিন মজুমদারের কথা। গেল ৩ মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে গাছের ডালে বসে যিনি মুক্তির অন্বেষায় অভিনব প্রতিবাদ করলেন।
হায়রে, এই পৃথিবী কত না বৈচিত্র্যময়! একবিংশ শতাব্দীর এই সভ্য সমাজেও মুক্তির অন্বেষায় ও দাবি আদায়ে আন্দোলন-সংগ্রাম-যুদ্ধবিগ্রহ থেকে শুরু করে মানুষকে কত কিছুই না করতে হচ্ছে। রাস্তায় প্রকাশ্যে নগ্ন, শিশুকে দুগ্ধপান, লেটুস পাতার অভিনব পোশাক পরে প্রতিবাদ, রাস্তায় হাজারো মানুষের সামনে চুমু, সমুদ্রের তীরে বালিতে মাথা ঢুকিয়ে, আকাশে বেলুন উড়িয়ে প্রতিবাদ কিংবা গাছে উঠে অনশন। এরপরও কী মানুষের মুক্তি মিলছে?
জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের চেয়ারম্যান দাবিদার ‘দার্শনিক’ জালাল উদ্দিন মজুমদার সেদিন হাতে-পায়ে শিকল পরে এবং মাথায় লাল-সবুজ পতাকা বেঁধে পেট্রলবোমা, ক্রসফায়ার, হরতাল, অবরোধ চিরতরে বন্ধের দাবিতে গাছে অবস্থান নেন। সেখান থেকেই লিফলেট বিতরণ করেন। তাঁর পাশের একটি প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল- ‘১৬ কোটি মানুষ এই মাটিতে দাঁড়িয়ে কথা বলার অধিকার হারিয়ে ফেলেছে। তাই গাছে উঠে দাবি আদায়ের কথা বলছি।’
সেদিন তাকে দেখার জন্য উৎসুক জনতা ভিড় করে । গাছের নিচে রাখা লগবইয়ে স্বাক্ষর করে তাঁর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন অনেকে। দুটি ব্যানার, একটি হারিকেন নিয়ে হ্যান্ড মাইকে জনতার উদ্দেশ্যে মজুমদার বলেন, ‘পেট্রলবোমার আগুনে পোড়া মানুষের চিৎকারে, হরতাল-অবরোধে ব্যবসায়ীদের চিৎকারে, ক্রসফায়ারে মৃত মানুষ ও তাদের স্বজনদের চিৎকারে এই ৫৬ বছর বয়সে এসে গাছের ওপর উঠে দাবি জানাতে বাধ্য হলাম।’
‘১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু মাটিতে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন এবং আমরা সাড়ে সাত কোটি মানুষ তা শুনেছিলাম। এখন স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও ১৬ কোটি মানুষ আর্তচিৎকার করছে। আগুনে পুড়ে মারা যাচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।নিরীহ মানুষের এই আর্তচিৎকার খালেদা-হাসিনা কেউ শুনছেন না।’
এই ব্যক্তি আরো বলেন, ‘সংলাপে বসার দাবি জানানোর কারণে বঙ্গবীরের মতো নেতার কাঁথা-বালিশ নিয়ে গেছে পুলিশ। মাহমুদুর রহমান মান্নাকে মাটি থেকে ধরে নিয়ে গেছে। তাই আমি গাছে উঠে কথা বলা ছাড়া কোনো উপায় দেখছি না।’ ‘পোড়া মানুষের গন্ধ নাকে আসছে, আমি তো ঘরে ঘুমাতে পারছি না, পোড়া মানুষের আর্তনাদ-চিৎকার কানে আসছে, আমি তো স্বাধীনতাযুদ্ধে এইভাবে মানুষ মরতে দেখি নাই, এর জন্য কি যুদ্ধ করেছি? এ জন্য কি গণতন্ত্র এনেছি? না না না, তা হতে পারে না’।
জালাল উদ্দিন বলেন, ‘স্বাধীনতা-গণতন্ত্র আজ গাছের ওপর, আমাকে ধরে নিতে দরজা ভাঙতে হবে না। আমি গাছের সঙ্গে শিকল দিয়ে নিজেকে বেঁধে রেখেছি। এতে অন্তত পেট্রলবোমা থেকে বাঁচতে পারব। যেহেতু গাছের ওপর আছি, তাই র্যাবের জন্য সহজ হবে, পাখির মতো গুলি করতে পারবে কিন্তু গোপন করতে পারবে না, জনতা দেখে ফেলবে। আমার সাথে গাছও আসামি হবে। যেহেতু গাছ আমাকে আশ্রয় দিয়েছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম নবগ্রামের জালাল উদ্দিন মজুমদার এর আগেও দেশপ্রেমিক নেতার খোঁজে হারিকেন হাতে যাত্রা করেছিলেন।
আমরা হয়তো জালাল উদ্দিনের এই অভিনব প্রতিবাদকে হাস্যরস করেই উড়িয়ে দিয়েছি। তার এমন প্রতিবাদে হয়তো অনেকে আবাক হয়েছি, কেউবা তাকে পাগল ভেবেছি। কিন্তু তার এই প্রতিবাদ ও প্রতিবাদের ভাষাগুলোই বলে দেয় আজ আমরা কতটা স্বাধীন ও আমাদের স্বাধীনতা কতটা অর্থবহ। আজও মানুষ কেমন করে মুক্তির অন্বেষায় তাড়িত হচ্ছে!
অথচ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল জাতীয় ঐক্য, ন্যায় ও গণতন্ত্র; মুক্তিসংগ্রামের মর্মকথা ছিল অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক সব ধরনের অন্যায়-অবিচার, বৈষম্য থেকে মানুষের মুক্তি। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরেও আমরা সেই মুক্তির সন্ধান করছি।
ফলে আমরা যে কতটা অগণতান্ত্রিক সমাজে বসবাস করছি, তা প্রমাণ করে আজকের এই সহিংস রাজনীতি, নিরপরাধ মানুষকে পেট্টোল বোমায় না হয় বন্দুকযুদ্ধের নামে ক্রসফায়ারে হত্যা, মুক্তচিন্তার মানুষ অভিজিৎ রায়কে প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাতে হত্যা, সাংবাদিক সাগর রুনি ও ধর্মীয় নেতা মোস্তফা ফারুকী বেডরুমে জবাই করে হত্যার ঘটনাই।
আমরা জানি, মানুষের সবচেয়ে প্রিয় ও কাঙিখত বিষয় স্বাধীনতা। কেননা, স্বাধীনতা মানুষকে উন্নততর জীবনের জন্য হাতছানি দেয়। পরাধীনতা মানুষের জীবনকে যেভাবে বেঁধে রাখে, তাতে মানুষের সম্ভাবনার বিকাশ হয় না। অন্যের তৈরি শোষণের পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতা মানুষকে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত করে আকাশের পাখির মতো জীবনদান করবে- এই প্রত্যাশাতেই মানুষ স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে।
এ দেশেও সে লড়াই হয়েছে। প্রথমে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীন হয়ে পাকিস্তান। তার ২৪ বছর পর পাকিস্তানি শাসন থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশ। দু’বার স্বাধীন হওয়া সত্ত্বেও স্বাধীনতার ধারণা অনুযায়ী এ দেশের জনগণের কী মুক্তি এসেছে? না স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ ভোগ করতে পেরেছে বিষয়গুলো আজ বেশ প্রশ্নবিদ্ধ।
গণতন্ত্র তো হলো সেই পরিবেশ- যেখানে সব মত-বিশ্বাসের মানুষ তাদের সব চিন্তা-চেতনার কথা মুক্তভাবে প্রকাশ ও চর্চা করতে পারে। কিন্তু সেটা কী আমাদের দেশে হচ্ছে?
আসলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল প্রত্যাশার যুদ্ধ, স্বপ্ন পূরণের যুদ্ধ। সংগ্রামটা ছিল মুক্তি ও গণতন্ত্রের জন্য। দেশ পেয়েছি, পতাকা পেয়েছি, পেয়েছি মানচিত্র।কিন্তু আজ আমাদের সেই মুক্তি ও গণতন্ত্র কোথায়?
আজ নিজেকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়- স্বাধীনতা তুমি কী পানির ট্যাংকে গলিত লাশের গন্ধ? স্বাধীনতা কী হরতাল-অবরোধে জীবন করা স্তব্ধ-দগ্ধ? স্বাধীনতা কী ক্ষমতা হরনে বন্দুকযুদ্ধ? স্বাধীনতা কী সন্ত্রাসীর হাতে মরণাস্ত্রের গর্জন? স্বাধীনতা কী অর্থের লোভে বিবেক বিসর্জন? স্বাধীনতা কী ৫ জানুয়ারির ভোটার বিহীন নির্বাচন? স্বাধীনতা কী চোরের গায়ে কালো মুজিব কোট কিংবা জিয়ার কোটসাফারী? স্বাধীনতা কী লিখতে গিয়েও আমার মনের ভয়? স্বাধীনতা কী ভোট ছাড়াই ১৫৩ এমপির জয়? স্বাধীনতা কী চুপটি করে সইবো সব অত্যাচার? স্বাধীনতা কী পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র ফাঁস? আজ নেই বর্গী, নেই ইংরেজ, নেই পাকিস্তানি .. এরপরও কেন আমরা আজও শোষিত হবো?
এমনই এক ক্রানিতকালে আজ জাতি উদযাপন করতে যাচ্ছে ৪৫তম স্বাধীনতা দিবস। যখন স্বাধীনতার মূল চেতনা গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক মুক্তি ও আইনের শাসন নির্বাসিত। স্বাধীনতা অর্জনের পর ৪৪ বছরের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছি আমরা। কিন্তু যে গণতান্ত্রিক চেতনা ও স্বাধিকার রক্ষার জন্য এদেশের আপামর জনতা অস্ত্র হাতে জীবনবাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো, ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর অসংখ্য মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা এত বছর পরও কেন তারা সেই চেতনাকেই হাতড়ে ফিরছে? এই প্রশ্ন আজ দেশের ১৬ কোটি জনতার। স্বাধীনতার মূল চেতনা বাস্তবায়নে দেশের সকল রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও সর্বস্তরের জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। এরজন্য সবার আগে প্রয়োজন যথার্থ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আমরা ব্যর্থ হলে যে আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বই হুমকির মুখে পড়বে এতে কোনো সন্দেহ নেই। আসুন, মহান স্বাধীনতা দিবসের এই দিনে শপথ নিই আমরা ব্যক্তি, দল, গোষ্ঠীর স্বার্থ পরিহার করে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জনগণের অধিকারকে সবার ওপরে স্থান দেবো। স্বাধীনতার মূল চেতনা রক্ষার নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যাবো। তাই যথার্থ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই হোক ২০১৫ সালের স্বাধীনতা দিবসের শপথ।
সবশেষে কবির ভাষায় বলতে হয়-
হে স্বাধীনতা তুমি লুকিয়ে আছো কোন অরণ্যে
জীবন যায় তোমার অন্বেষণে,
প্রতিটা মুহূর্ত কাটে তোমার প্রতীক্ষায়
কোথায় গেলে পাবো তোমায়?
লেখক: শিক্ষা ও সমাজ বিষয়ক গবেষক, ই-মেইল- sarderanis@gmail.com
Leave a Reply