ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান:
অজোপাড়া গাঁয়ে জন্ম আমার, বাল্য-কৈশোরে ক্রিকেট খেলার সুযোগ হয়নি, ফলে ফুটবল-হাডুডুর মতো এ খেলা তেমন একটা বুঝি না। তাই অন্যদের মতো ক্রিকেটের খুঁটিনাটি তেমন খুব একটা জানি না। এবিষয়ে আমার জ্ঞান খুবই সামান্য। তবে বাঙালী ক্রিকেট টাইগারদের ক্রমাগত সাফল্য আর ক্রিকেটপ্রেমীদের উল্লাসে নিয়মিত না হলেও বাংলাদেশের খেলাগুলো দেখার চেষ্টা করি।
গত ৯ ও ১৯ মার্চের খেলা দুটি বেশ আগ্রহ নিয়েই দেখিছি। সেদিন অ্যাডিলেডে শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে ১৫ রানে ক্রিকেটের জনকদের হারিয়ে মাশরাফিদের ইতিহাস সৃষ্টি । প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশ! মাশরাফিদের সেই জয়ের আনন্দে ভাসে গোটা বাংলাদেশ।এই জয়ে বাঙালিদের নতুন উৎসবের আবহ এনে দেয় টাইগাররা। লাল-সবুজের দেশ মেতেছে অ্যাডিলেডের কীর্তি নিয়ে।এরই মধ্যে ১৯ মার্চের খেলা। ক্রিকেটের জনক ইংল্যাণ্ডকে হারানোর সুবাদে এদিনের খেলা নিয়ে বাঙালীর প্রত্যাশা অনেক বেড়ে যায় ।
আমাদের সবার প্রত্যাশা এতটাই আকাশচুম্বী হয় যে- বাধার পাহাড় ডিঙ্গিয়ে সেমিফাইনালে উঠা যেন হাতের মুঠোয়। আর সেই প্রত্যাশার প্রতিফলন না হওযায় খেলা শেষে পরাজয় যেন আমরা কোনো মতেই মেনে নিতে পারছি না।এমনটিই লক্ষ্য করা গেছে, রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধান থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের কথাবার্তায়। এমন কী এ নিয়ে আইসিসির প্রেসিডেন্ট ও কর্মকর্তাদের মধ্যেও বাকবিতন্ডা থেকে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। মামলায় গড়ানোর কথাও শোনা যাচ্ছে।
গত ৩দিন থেকে ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ নিয়ে চারিদিকে যে সমালোচনার ঝড় উঠেছে, এ নিয়ে যে বাকবিতণ্ডা চলছে, এতে সহজেই অনুমেয় যে, আমরা পুরো জাতি ক্রিকেটক্রেজি হয়ে উঠেছি। ফলে এ বিষয়ে কিছু না লিখে বসে থাকতে পারলাম না।
ক্রিকেটমোদীদের ভাষ্যমতে, ধরেই নিলাম আম্পায়াররা ‘ভারতকে যেভাবেই হোক, ম্যাচটি জিতানোর চেষ্টা করেছে।কিন্তু এতে পৃথিবীর প্রচলিত রীতিতে তারা কি বা বড় ধরনের অপরাধ করেছে! কেননা, গোটা পৃথিবীই তো সবলের পক্ষে থাকে, এতে আইসিসির আম্পায়ারদের কী দোষ?
কেননা, আইসিসি জানে, বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্দীপনা দীর্ঘ দিন ধরে রাখতে হলে ভারতকে সাথে রাখতে হবে। অন্যথা সম্ভব নয়। এই পর্বেই ভারত খেলা থেকে চলে গেলে এর জৌলুস হারাবে, ১২৭ কোটি দর্শক দেখবে না খেলা, বন্ধ হয়ে যাবে বিজ্ঞাপন আর স্পনসর বাণিজ্য, লাটে উঠবে ক্রিকেট টুরিজম বাণিজ্যও। যা ঘটেছিল ২০০৭ সালে। ফলে সবমিলেই যতটা পারা যায় ভারতকে সাথে রাখার চেষ্টা। এটা আবার দোষের কী হলো!
তবে আইসিসি কর্মকর্তারা যেভাবেই বিষয়টি ব্যাখা করুক না কেন, দৃশ্যত: ‘ভারত-বাংলাদেশ’ ম্যাচে যে কিছুটা ত্রুটি ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আম্পায়াররা একটু সতর্ক থাকলে যা সহজেই এড়িয়ে যাওয়া যেত।
কিন্তু ধরা যাক, আম্পায়াররা নিরপেক্ষ, যে আউটগুলো এবং ছক্কাগুলো নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, সেগুলো দিয়ে দিতেন, তবে কি ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ম্যাচ বের করে নিয়ে আসা সম্ভব ছিলো? এবিষয়ে আমার মতো অনেকেই সন্দিহান।
কিন্তু গত ৩দিন থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, মিডিয়া, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তা, আমাদের রাজনীতিবিদ, সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও টিমের ভক্তদের যে আস্ফালন চলছে তা কতটা বাস্তব, এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সবারই বক্তব্য বাংলাদেশ জিততো, আম্পায়ারদের পক্ষ পাতিত্বের কারণেই বাংলাদেশ জিততে পারেনি।
আসলেই কী তাই? কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখলাম, এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ যতগুলো ম্যাচ খেলেছে সবচেয়ে খারাপ যদি কোনো ম্যাচকে ধরে নেয়া যায় তা এই ম্যাচকেই ধরতে হবে। কেননা, এদিন বাংলাদেশ দল ফিল্ডিং-ব্যাটিংয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক খারাপ করেছে, অধিনায়কসহ টাইগারদের অবয়বে এক ধরনের নার্ভাস লক্ষ্য করা গেছে। এগুলো দৃশ্যত বাস্তবে ঘটেছে, তা কোনোভাবেই এড়িয়ে যাবার নয়।
তাই আমি মনে করি, আম্পায়ারদের সমালোচনা অনেক হয়েছে, এবার আমাদের আত্মসমালোচনা করার পালা। আমাদের প্রত্যাশা-প্রাপ্তির সাথে মিলাতে হবে ক্রিকেট জগতে আমাদের পদার্পণের সময়কাল, টাইগারদের যোগ্যতা-অভিজ্ঞতা, তাদের ম্যাচুয়েরিটি আর ওইদিনের তাদের খেলার বিষয়গুলো। তবেই আমরা বুঝতে পারবো আমাদের বাস্তবতা। আর এটা না করা হলে আমরা আগামী দিনে সামনে অগ্রসর হতে পারবো না। খেয়াল রাখতে হবে- ক্রিকেটমোদী ভক্তদের এই উন্মাদনা যেন খেলোয়াড়দের অহমিকা বাড়িয়ে না দেয়। আমাদের গঠনমূলক সমালোচনা করতে হবে যাতে তারা নিজেদের ভুল-ত্রুটিগুলো সংশোধন করার প্রয়োজনবোধ মনে করে, কিংবা সে সুযোগটুকু পায়। অন্যথা এই উন্মাদনা ভবিষ্যতে আমাদের ক্রিকেটের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সবশেষে আমাদের দেশের মন্ত্রী-এমপি ও ক্রিকেট বোর্ডের হর্তা-কর্তাদের প্রতিও আহবান রাখবো- ক্রিকেটমোদী ভক্তদের সাথে গা না ভাসিয়ে দায়িত্বশীলতার সাথে ভুমিকা রাখুন। কারণ আপনাদের প্রতিক্রিয়া, বক্তব্য-ভাষণে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি জড়িত। সেই সাথে ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ জড়িত। আপনাদের কাণ্ডজ্ঞানহীন বক্তব্য যাতে আমাদের এই সম্ভাবনাময় ক্রিকেটের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত না করে।ফলে অনেক হয়েছে, আর নয় বিতর্ক।এবার আমাদের সার্বিক বিষয়ে আত্মসমালোচনা করতে হবে। যাতে বর্তমানের ভুল-ত্রুটিগুলো শুধরিয়ে ভবিষ্যতে আরো সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারি।
Leave a Reply