ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান: বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে এখানে নারী-পুরুষ সমযোগ্যতায় ও সমচিন্তায় বেড়ে উঠবে এটা আমাদের জাতীয় ভাবনা । এতদসত্ত্বেও শিক্ষায় পুরুষের তুলনায় নারীরা এখনো নানা দিক দিয়ে পিছিয়ে । সাম্প্রতিক সময়ে নারী শিক্ষার অবস্থার তুলনামূলক উন্নতি ঘটলেও সার্বিক বিবেচনায় নারীরা এখনো অনেক পিছনে । জাতীয়ভাবে নারী-পুরুষের যে সমতার কথা, শিক্ষাক্ষেত্রে সেই সমতা অর্জিত হতে এখনো অনেক পথ পারি দিতে হবে। ফলে এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে নানা উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
বর্তমানে আমাদের জনসংখ্যা ১৬ কোটির উপরে । দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক নারী। এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে নিরক্ষর, অবহেলিত ও অদক্ষ রেখে দেশের সার্বিক উন্নয়ন কোনোভাবেই যে সম্ভব নয় । ফলে সংবিধানেও নারী পুরুষের সমাধিকারের কথা বলা হয়েছে। তবে বাস্তব প্রেক্ষাপটে সমাজে নারী-পুরুষের বৈষম্য এখনও প্রকট ।
ফলে নারীদের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ সম্প্রসারনের লক্ষ্যে শিক্ষার বিকল্প নেই। এ চিন্তাকে সামনে রেখেই সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে । বলা যায়- নানা রাজনৈতিক বিতর্ক ও বিভাজনের মধ্যেও বর্তমান সরকার বেশ কিছু কার্যকর উদ্যোগের ফলে নারী শিক্ষায় এক নবযুগের সূচনা হয়েছে ।
আশির দশকে দেশের বিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রীদের উপস্থিতি ছিল মাত্র ৩৩ ভাগ এবং তাঁর মধ্যে মাত্র ৫ ভাগ ছাত্রী মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা সম্পন্ন করতে সক্ষম হত । সামাজিক কুসংস্কার, ধর্মীয় গোড়ামী, বাল্যবিবাহ, অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং দারিদ্রতার কারণে মেয়েরা শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রসর হতে পারেনি । তাই অর্ধেক নারী জনগোষ্ঠীকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত এবং সামাজিক উন্নয়নমুলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের উপযোগী করতে ১৯৯৪ সালের জানুয়ারি মাস থেকে দেশে ৪ টি প্রকল্পের মাধ্যমে মাধ্যমিক স্তরের ছাত্রীদের উপবৃত্তি কার্যক্রম চালু করা হয় । এতে মেয়েরা দল বেধে স্কুলগামী হতে থাকে । সেটার সুফল বর্তমানে মাধমিক পর্যায়ে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের উপস্থিতি বেশি।
২১ বছর আগে ১৯৯৪ সালে মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রীদের ভর্তির হার ছিল ৩৩ শতাংশ এবং ছাত্র ভর্তির হার ছিলো ৬৭ শতাংশ। বর্তমানে ছাত্রীদের ভর্তির হার বেড়ে হয়েছে ৫৪, আর ছাত্রদের ভর্তির হার ৪৬ শতাংশ। শুধু মাধ্যমিকেই নয়; প্রাথমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায়ও নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে।
২০০২ সালে যখন উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে উপবৃত্তি কার্যক্রম শুরু হয়, তখন এই স্তরে ছাত্রীদের ভর্তির হার ছিল ৩৩, আর এখন বেড়ে হয়েছে ৪৬ শতাংশ। ছাত্রদের হার হয়েছে ৫৪ শতাংশ। অর্থাৎ গত ১৩ বছরে ছাত্রীদের ভর্তির হার বেড়েছে ১৩ শতাংশ ।
তবে শিক্ষায় ছাত্রীদের ভর্তির হার বাড়লেও ঝরে পড়া ব্যপারটি এখনো উদ্বেগজনক । শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ডগুলোর এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৩ সালে মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে দুই বছর আগে নবম শ্রেণীতে নিবন্ধন করেও অংশ নেয়নি প্রায় সোয়া চার লাখ নিয়মিত শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ছাত্রীদের সংখ্যাই বেশি, অর্থাৎ দুই লাখ ৫৯ হাজার ৯৮৭ জন। আর ঝরে পড়া ছাত্র এক লাখ ৬৫ হাজার ৪৮৩ জন। ছাত্রীদের ঝরে পড়ার হার ৩৪ দশমিক ৬৭, আর ছাত্রদের এ হার ২৩ দশমিক ৪২ শতাংশ।
প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিকেও ঝরে পড়াদের মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা বেশি বলে গত কয়েকটি পরীক্ষায় প্রতীয়মান হয়েছে। শিক্ষা কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, মূলত: আর্থ-সামাজিক কারণেই তারা ঝরে পড়ছে।
এসব প্রেক্ষাপটে দেশের নারী শিক্ষার উন্নয়নে রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধিতে বর্তমান সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করছে । এক্ষেত্রে নারী শিক্ষায় পুনরায় নয়া যুগের সূচনা হয় ২০১৩ সালে। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির আলোকেই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার উন্নয়নে ৩০ জুন দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো স্নাতক ও সমমান পর্যায়ের ছাত্রীদের জন্য উপবৃত্তি চালু করেন।
প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার এ স্তরে উপবৃত্তি পাচ্ছে এক লাখ ৩৩ হাজার ৭২৬ ছাত্রী। এতে বছরে ৭৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ । সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, উপবৃত্তিসংক্রান্ত সকল প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও পর্যায়ক্রমে ট্রাস্ট বোর্ড তা চালিয়ে যাবে । কেবল তাই নয়, প্রথমে কেবল ছাত্রীদের উপবৃত্তি চালু হলেও পর্যায়ক্রমে এ ট্রাস্টের আওতায় আসবে মেধাবী ও দরিদ্র ছাত্ররাও। বর্তমানে প্রতি ছাত্রীকে বছরে উপবৃত্তি দুই হাজার ৪০০, পরীক্ষার ফি বাবদ এক হাজার, বই কেনার জন্য এক হাজার ৫০০, টিউশন ফি বাবদ ৭২০ সর্বমোট পাঁচ হাজার ৬২০ টাকা প্রদান করা হচ্ছে।
এদিকে সম্প্রতি দেশের ৫৩ জেলার ২১৭ উপজেলার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আরো ৪২ লাখ ৪৪ হাজার দরিদ্র শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির প্রদানের ঘোষণা দেয়া হয়েছে । এতে সেকেন্ডারি এডুকেশন স্টাইপেন্ড প্রজেক্ট ২য় পর্যায় (এসইএসপি) প্রকল্পে ব্যয় হবে ৭৯১ কোটি টাকা । সরকারের সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের জুন মেয়াদে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে । গত ১৭ ফেব্রুয়ারি একনেকের সভায় এ প্রকল্প অনুমোদন হয়।
ওইদিন প্রেস বিফিংয়ে বলা হয়, উপবৃত্তির অধীনে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে ১০০, অষ্টম শ্রেণীতে ১২০ এবং নবম ও দশম শ্রেণীতে ১৫০ টাকা মাসিক উপবৃত্তি দেয়া হবে । অপরদিকে, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত মাসিক ১৫ এবং নবম ও দশম শ্রেণীর ক্ষেত্রে ২০ টাকা হিসেবে টিউশন ফি পাবে । এছাড়াও এসএসসি পরীক্ষা ফি বাবদ বার্ষিক এককালীন ৭৫০ টাকা করে দেয়া হবে।
প্রতি শ্রেণীতে মোট ছাত্রীর ৩০ ভাগ এবং মোট ছাত্রের ১০ ভাগ এই উপবৃত্তি পাবে। অভিভাবকের জমির পরিমাণ ৭ ডেসিমেলের নিচে এবং বার্ষিক আয় ৫০ হাজার টাকার নিচে তাদের ক্ষেত্রে । সে সঙ্গে শিক্ষার্থীকে ন্যূনতম ৭৫ ভাগ ক্লাসে উপস্থিত থাকতে হবে। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীকে বার্ষিক পরীক্ষায় ন্যূনতম ৩৩ভাগ নম্বর পেতে হবে। অষ্টম ও নবম শ্রেণীর ক্ষেত্রে তা ৪০ ভাগ। আরেকটি শর্ত হলো এসএসসি অথবা দাখিল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা পর্যন্ত শিক্ষার্থীকে অবিবাহিত থাকতে হবে।
২০০৯ সালে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৬০৪জন, ২০১০ সালে ১ লাখ ৩২ হাজার ১৪২ জন এবং ২০১১ সালে ১ লাখ ৩৫ হাজার ৫৭৭ জন ছাত্রীকে উপবৃত্তি প্রদান করা হয় ।এর পাশাপাশি ২০১৩ সালের জুলাই থেকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের আওতায় উচ্চশিক্ষা স্তরে উপবৃত্তি পাচ্ছে এক লাখ ৩৩ হাজার ৭২৬ ছাত্রী।
সবমিলে বর্তমানে প্রথম শ্রেণী থেকে ডিগ্রী পর্যন্ত ১ কোটি ২১ লাখ ৭৮ হাজার ১২৯ জন শিক্ষার্থীকে বৃত্তি ও উপ-বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভাল হলে আগামীতে পুরোপুরি বিনা খরচে শিক্ষার ব্যবস্থার কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ।
এছাড়া বর্তমান সরকারের ২০০৮ সালে নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল ২০১৪ সালের মধ্যে দেশকে নিরক্ষরতামুক্ত করা। শিক্ষার মানোন্নয়নের মাধ্যমে একটি শিক্ষিত ভবিষ্যত্ প্রজন্ম গড়ে তোলা। এরই মধ্যে ৯৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ শিশুর বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত হয়েছে।
শিক্ষার হার ৪৪ শতাংশ থেকে ৬৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে । বর্তমান সরকার ৬ বছরে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে ১৫৯ কোটি বই বিতরণ করেছে। চলতি বছরে ৩২ কোটি ৬৩ লাখ ৪৭ হাজার ৯২৩টি বই শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ হয়েছে । দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুরাও ব্রেইল পদ্ধতির বই পাচ্ছে।
ব্যবস্থাপনায় কিছু ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও সার্বিক বিবেচনায় বলা যায়- শিক্ষা উপবৃত্তির মাধ্যমে সরকার দেশে নারী শিক্ষার উন্নয়নে বড় ধরনের সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে । তা অব্যাহত থাকলে জাতীয়ভাবে নারী-পুরুষের যে সমতার কথা, শিক্ষাক্ষেত্রে সেই সমতা অচিরেই আমরা অর্জন করতে সক্ষম হবো।
সবশেষে বলবো, সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিক মন-মানসিকতার পরিবর্তন ও নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার প্রেরণাই নারী শিক্ষার বর্তমান পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পারে।
লেখক: শিক্ষা ও সমাজ বিষয়ক গবেষক। ই-মেইল: sarderanis@gmail.com
Leave a Reply