চবির ছাত্রী হল এমন একটি জায়গা যার আশেপাশে কিছু পাওয়া যায় না। লেডিস হলের পাশে নেই কোন ফার্মেসী। নেই কোন টেইলার্স। নেই নাস্তার কোন ভাল দোকান। লেডিস হলের ঝুপড়িতে বাইরে থেকে কিনে আনা ঠাণ্ডা নাস্তা ছাড়া কিছুই মেলে না। মেয়েরা প্রায়ই রান্না করে। অথচ আশেপাশে দু’একটি খুপরিমার্কা সবজির দোকান থাকলেও নেই কোন মুরগীর দোকান, মাছের দোকান। এমনকি নেই ভাল কোন কসমেটিকসের দোকানও। রান্নার জন্য হলের স্টোরগুলোতে ডাল খুঁজুন। মসুর ডাল ছাড়া আর কোন ডাল খুঁজে পাবেন না। কর্ণফ্লাওয়ার কিংবা টেস্টিং সল্ট লাগবে? যেতে হবে বাইরে।
জিরো পয়েন্ট থেকে বামদিকে সামান্য হেঁটে গেলেই পড়ে দোলা সরণী। সেখানে সপ্তাহে দুদিন বাজার বসে। হাট বসলে মাছ, মুরগী তাও পাওয়া যায়। কিন্তু বাকি সব? দোলাতে ফলের দোকান আছে কেবল একটি। মুরগীর দোকান একটি। সেখানে গুটিকয়েক দোকানদারের একচ্ছত্র আধিপত্য চলে।
তাও সবাই মেনে নেয়। কিন্তু আরো অনেক জিনিসপত্র তো কেনা বাকি থাকে। সেগুলো?
ছাত্রী হলের কাছেই দাদুমার্কেট নামে ছোট ছোট কিছু ফুটপাত-দোকান আছে। সেখান থেকে বড়জোর ২০০ টাকা দরের পিস কাপড়, ১৫০ টাকা দামের স্যাণ্ডেল আর সস্তা কিছু কসমেটিকস পাওয়া যায়। এর বাইরে কিছুই নাই।
তবে? অনেক জিনিসপত্রই যে কেনা প্রয়োজন সেগুলো কিনবেন কোত্থেকে?
এখানেই এসে যায় ছাত্রহলের কথা। ওষুধ থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সবকিছুর জন্য ছুটতে হয় ছাত্রদের হলের দিকে। অর্থাৎ শাহজালাল হল, শাহ আমানত হল, কিংবা সোহরাওয়ার্দীর দিকে। সেখানে ভাল চা-নাস্তার দোকান থেকে শুরু করে ফার্মেসী বলুন আর বইয়ের দোকানই বলুন, ফটোকপির দোকান থেকে স্টুডিও পর্যন্ত মোটামুটি সবই আছে।
ক্যাম্পাসে একজন নতুন শিক্ষার্থী আসার পরপরই তার সর্বপ্রথম দরকার হয় বেড, বালিশ, লেপ, মগ, বালতি ইত্যাদি। এর সবই পাবেন ছাত্রদের হলের সামনে। ক্যাম্পাসে একটামাত্র মিষ্টির দোকান, ফাস্টফুডের দোকান আছে কেবল ওদিকেই। ছাত্রী হলের পাশে কোন লেডিস টেইলার্স নাই, আছে ছাত্রদের হলের সামনে। বেশিভাগ সুবিধাই আছে সেখানে। কাজেই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য থেকে শুরু করে বিলাসদ্রব্য সবকিছুর জন্যই ছাত্রদের হলের সামনে যেতে হয়।
এবং তখনই দেখা দেয় বিপত্তি।
ছাত্রদের হলের সামনের হোটেলগুলোতে নাস্তা করতে যেই মেয়েরা ঢুকছে, তখনই টিটকারি শোনা যায়। বাজে, অশ্লীল মন্তব্য যে কতরকম হতে পারে, না শুনলে বোঝা যাবে না। এছাড়া অন্য যেকোন কাজে যান না কেন, আপনি যদি নারী হয়ে থাকেন, তবে বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়াতে পারবেন না। পাশে যদি কোন পুরুষসঙ্গী থাকেও, টিটকারির মাত্রা কমবেশি হবে কিন্তু একেবারে থামবে না। আর যদি কেবল নারীরা যান তবেতো কথাই নেই। বাজে মন্তব্য যারা করতে পারছে না তাদের একেকজনদের চোখ নারীদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত সর্বাঙ্গ গিলে খায়।
সবাই খারাপ নয় অবশ্যই। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই ঘটনা ঘটে।
অনেকে নারীদের পোশাকের দোষ দেবেন। কিন্তু কেউ অন্তত বিকিনি পরে ছাত্রহলের সামনে গিয়েছে বলে শুনিনি, দেখিনি। এমনকি বোরকা পরিহিতরাও যাদের টিটকিরি থেকে রেহাই পায় না, তাদের মুখে পোশাকী সমস্যা নিতান্তই ঠুনকো অজুহাত বৈ কিছু নয়।
আর এদের কারণে অতিপ্রয়োজনে ছাত্রহলের সামনে যাওয়া ছাত্রীরা অপ্রস্তুত, অসহায় বোধ করে। অস্বস্তি, জড়তা ক্রমাগত তাদের আঁকড়ে ধরে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুস্থ, স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করার অধিকার যে তাদের তাদের আছে, ক্রমশই তারা ভুলে যেতে থাকে।
দিনকয়েক আগে রুমমেটকে নিয়ে গিয়েছিলাম বিকাশ করতে। হলের বিকাশের দোকান তখন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তখনও রুমমেটের দিকে টার্গেট করে কে যেন আপেল ছুঁড়ে দেয়। আপেলটা যখন ওর পায়ের কাছে গড়িয়ে পড়ে তখন ছেলেগুলো চোখ টেপাটেপি করে। আর বলে, ‘লেগেছে রে!’
কী অদ্ভূত ব্যাপার!
আমরা এমন কেন! চায়ের দোকানে কাজ করা ছেলেগুলোও কত ভাল ব্যবহার করে। আর আপনারা তো দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোর একটির ছাত্র! তাহলে আপনারা কেন এসব বাজে আচরণ করবেন?
বাইরে থেকে যে কেউ ঘুরতে এসে বলতে বাধ্য হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অনেক সুন্দর। কি নির্মল এখানকার পরিবেশ, প্রকৃতি। স্বভাবে মাধুর্য্য তো স্বাভাবিকভাবেই চলে আসার কথা। তাহলে এত সৌন্দর্য্যের মাঝে থেকেও আপনার আচরণ এত খারাপ হয় কিভাবে? কিভাবে আপনাদেরই সহপাঠী, জ্যেষ্ঠ কিংবা কনিষ্ঠ ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে আপনারা বাজে, অশ্লীল ইঙ্গিত ছুঁড়ে দেন?
আর রাত দশটার পর লেডিস হলের সামনে এসে দলবেঁধে হেড়ে গলায় চেঁচিয়ে গানের নামে যা করেন তার কথা নাহয় বাদই দিলাম।
‘আপনাদের ঘরেও মা-বোন আছে’ এ ডায়লগ দেওয়ার সময় আর নেই। নিজের ঘরের মানুষ টিজড হলে তখন তো অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে ছুটে যাবেন ‘আমার অমুকের দিকে কে নজর দিল’ বলে। আর কিছু একটা হলেই চেঁচিয়ে উঠেন ’দেশটা রসাতলে গেল’ বলে।
আরে আগে নিজেরা বদলান।
মারামারি-হানাহানি করে, অন্যকে টিজ করে নিজেদের কুখ্যাত না বানিয়ে নিজেদের ভাল আচরণ দিয়ে, কর্ম দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে বিখ্যাত বানানোর চেষ্টা করুন। তবেই না দেশ বদলাবে।
আর প্রশাসনের উদ্দেশ্যে বলছি। লেডিস হলের পাশে প্রয়োজনীয় দোকানপাট বসানোর ব্যবস্থা করুন। আর তা যদি না পারেন, আপনার সুবোধ ছাত্রদের মুখ সামলানোর ব্যবস্থা করুন।
Leave a Reply