খোলা চিঠির পর এবার খোলা উত্তরের পালা!

মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী সমীপে‘ লেখাটি গেল ২১ জানুয়ারি ‘বাংলা ট্রিবিউনে’ প্রকাশিত হবার পর প্রায় আড়াই হাজার শেয়ার হয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে গেছে। রোজ অজস্র মেইল অার মেসেজ পাচ্ছি, কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা, কষ্ট, হতাশার কথা আছে তাতে! আরও আছে ভীষণভাবে উদ্দীপিত হবার মতো নিভৃতচারী মানুষের কাজের কথা।

সত্যিই ‘কত অজানারে জানাইলা তুমি…’ !

সবগুলো চিঠির জবাব দিতে পারছি না, ক্ষমাপ্রার্থী, তাই আবারও খোলা চিঠির আশ্রয় নিলাম।  মাননীয় মন্ত্রী নাহিদ স্যারকে লেখার জন্য এই চিঠি আমার মনে জমেছিল সেই পিএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁসের পরেই। ভীষণভাবে রক্তক্ষরণ হয়েছিল ভেতরে ভেতরে! বড় জনগোষ্ঠীর দৃষ্টিগোচর হবার তাড়নায় কলামে/ উপ-সম্পাদকীয়তেই দিতে চাইছিলাম যেন মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় অথবা তাঁর দপ্তরের কোনও কর্তা ব্যক্তির চোখে পড়বার সম্ভাবনা থাকে। বাংলা ট্রিবিউনকে সহযোগিতার জন্য বিশেষ ধন্যবাদ।

কেউ কেউ বিভিন্ন অ্যাপ্রোচে জানতে চেয়েছেন–‘কর্তা ব্যক্তিরা এর সবই জানেন, উন্নত প্রায় সব দেশেই নিজস্ব সংস্কৃতিভেদে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রায় এমনই, অনেকে আগেও এসব লিখেছেন, কাজেই এসব লিখে কী লাভ? মন্ত্রী মহোদয় বা তাঁর দপ্তরের কেউ কী এসব আমলে আনবেন?

উত্তর দেই, আমার একান্ত নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে, আমরা যারা পরদেশি মেঘ, তাদের মধ্যে দেশে ও পরবাসে যুগপৎ আশীর্বাদপুষ্ট যাপিত জীবনের অধিকারী, তাদের কারও দেশ নিয়ে কোনও উপদেশ খুব অনভিপ্রেত মনে হয়। মনে হয় আশীর্বাদপুষ্ট জীবনে দূরবীন দিয়ে দেশ দেখে অনধিকার চর্চা করছি- বাণী দিয়ে যাচ্ছি।
আমার ব্যক্তিগত অভিমত, দেশের অবহেলিত/কর্মহীনতার অক্ষম জীবন থেকে বাঁচতে ভাগ্যান্বেষণে বিদেশে গিয়ে মানবেতর কষ্টে অর্জিত অর্থের প্রায় সবটা নিয়মিত রেমিটেন্স পাঠিয়ে যারা দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রেখেছেন তারাই এই অভিযোগ করার দাবি রাখেন।

দেশে বিক্ষোভের কেন্দ্রে বাস করে প্রতিদিন ইয়া নফসি ইয়া নফসি করতে করতে ঘর হতে বের হয়ে ফিরে এসে একবারে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেওয়া survivor/ fighter দের টকশোতে টেবিল চাপড়ে কেবল সমস্যা উত্থাপন দিয়েই শেষ করাটা তাও মানা যায়, আমদেরটা যায় না! For us, it’s a sin simply pointing to a problem without proposing any solution.

তাই আমি কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতায় প্রচলিত ব্যবস্থাটার পুংখানুপুঙ্খ বিবরণসহ প্রতিটির কার্যকারণ, মানুষ গড়ে তোলায় এর উপযোগিতা এবং জীবনে এর ফলপ্রসূতা তুলে ধরতে চেয়েছি একেবারে ফার্স্ট হ্যান্ড অভিজ্ঞতার আলোকে; যা আমি আমার দুই ছেলের জীবনে দেখছি।

আমাদের প্রচলিত ব্যবস্থায় এর সংযোজন, প্রবর্তন কোথায় কীভাবে করবেন তা অবশ্যই শিক্ষা বিষয়ের বিশেষজ্ঞরাই ভাল জানবে। আমার পর্যবেক্ষণ আরও পূর্ণাঙ্গভাবে জানতে চাইলে আমি সানন্দে হাত বাড়াবো। কারণ, আমি জানি দেশে জাপানিদের চেয়ে মেধাবী মানুষের পরিমাণ কোনও অংশে কম নেই।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাইবো, রোজ পাওয়া চিঠিগুলোর ২/১ জন স্বপ্নদ্রষ্টার কথা যাদের কেউ কেউ স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য কতটা নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ করে যাচ্ছেন তা জানতে পারাটাও ছিল এক বিরাট অভিজ্ঞতা! বরিশালের ‘নীপবন’ একটা স্কুল যেটা মূলত একটি আন্দোলন, শিশুকে তার শৈশব ফিরিয়ে দেবার একটি ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে এই ব্যতিক্রমী স্কুল পরিচালনা  ছাড়াও গত ১১ বছর ধরে পরিচালক আবদুস সোভান বাচ্চু ভাই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি অভিভাভকদের মোটিভেশনের কাজও করে চলছেন।
নিঃসন্দেহে খুবই উপযোগী উদ্যোগ, কারণ প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে শিশুর জন্য উপযোগী যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হবে সেটার প্রয়োজনীয়তা এবং উপযোগিতা প্রথমে শিক্ষক এবং অভিভাবকেই উপলব্ধি করতে হবে। নইলে কখনই কাঙ্খিত ফল আসবে না। কারণ ‘আমার পাশের মানুষটা আমার প্রতিযোগী – কখনই সহযোগী নয়’ এই বিদ্বেষের জন্ম আমার ঘর থেকেই। বাসায় অভিভাবকে তুলনা ‘তুমি ভাইয়ার মতো হওনি কেন? ওমুক আংকেলের মেয়ে তমুকের মতো নও কেন?’ আর স্কুলে শিক্ষকের কাছে ফার্স্ট বয়/গার্ল ছাড়া সব গরু-গাধা-ছাগল এসব মানসিকতার শেকড় উৎত্পাটনও একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ। একজন শিশুকে সারাজীবন শেখানো হয় ‘তুমি কিছুতেই তোমার মতো হতে পারবে না, তোমাকে অবশ্যই অন্য একজনের মতো হতে হবে।’

তবে, আমার প্রস্তাবনা অনুযায়ী পরীক্ষাবিহীন পড়ালেখা ব্যবস্থায় এই তূলনাচর্চা আদতেই মিলিয়ে যাবে।

নীপবনের মত আরও কয়েকজনের মতো পড়ালেখা (এখানে স্কুলিং কথাটাতেই মূলত জোড় দিতে চাচ্ছি) যত বেশি তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর করা যায় ততই এটা বিশ্বমানের তথা উন্নত বিশ্বের সমমানের হওয়া সহজতর হবে, তরান্বিত হবে।

এক্ষেত্রে নীপবনের পরিচালক মহোদয়ের তাঁর প্রকাশিত আর্টিকেলে দাবি করেছিলেন, ‘আমাদের অনেক প্রাইমারি স্কুল, মাদ্রাসায় বেড়া না থাকলেও এখন মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর আছে, ল্যাপটপ আছে। আমাদের সব পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। মোবাইলফোনে নম্বর টিপলেই রেজাল্ট চোখের সামনে। কাজেই আমরা অনেক দূর এগুনো তাতে কোনও সন্দেহ নাই। এবার আর একটু আগাই- ফলাফলের মতো সব ক্লাসের সিলেবাস থাকবে ওয়েবসাইটে। ইন্টারনেটে থাকবে ই-বুক। স্যাটেলাইট চ্যানেলে থাকবে ক্লাস। শিক্ষার্থীরা ঘরে-বাইরে বনে-বাদারে বসে নিজেদের ইচ্ছা ও সময় অনুসারে পড়াশুনা করবে। কোনও বিষয়ে বিশেষ প্রয়োজন হলে, নির্দ্দিষ্ট টিচারকে ফোন বা মেইল করবে। টিচার সলিউশন দেবেন। শিক্ষার্থী বিকাশ বা পে-পালে তার সম্মানি পাঠিয়ে দেবে। পরীক্ষার সময় প্রশ্নপত্র ডাউনলোড করে উত্তরপত্র নোটপ্যাডে লিখে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বরাবরে মেইল করে দেবে। নির্ধারিত সময়ের ব্যবধানে রেজাল্ট বের হয়ে যাবে।’

জাতিসংঘেরও একটা বিশেষ উদ্যোগ দেশ, জাতি, সংস্কৃতিভেদে পড়ালেখাটা যতদ্রুত সম্ভব সার্বজনীন করা যায়।
তবে, আমি জানি না, আমাদের দেশের একেবারে সুদূর গ্রামের স্কুলেও ডিজিটাল পড়ালেখা সম্ভব কিনা। এছাড়া দেশভেদে যেমন কিছু নিজস্বতা, স্বাতন্ত্র থেকেই যায়- কাজেই সেই হিসেবে customization এর প্রয়োজনীয়তাটাও থেকে যায়। যেমন, আমাদের দেশে বর্তমানে মূলত তিনটি ধারা চলছে- বাংলা মাধ্যমে মাধ্যমিক- উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ইংরেজি মাধ্যম, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই তিন মাধ্যমকে একত্রিত করাই সময় সাপেক্ষ! কাজেই পাঠ্যপুস্তকের কন্টেন্ট মাধ্যম ভেদের মতোই দেশ-সমাজ-সংস্কৃতি ভেদে ভিন্ন হবেই।

তাই, আমার প্রস্তাবনা থাকছে শুধু শিক্ষা প্রয়োগের ব্যবস্থাটা নিয়ে, যেটা স্কুলজীবন থেকেই ডিজিটাল হতেই হবে তা নয়। কারণ, ডিজিটালাইজেশনের জন্য আমূল ব্যবস্থা পরিবর্তনের সময়ের ফেরে আরেকটা জেনেরেশন না ক্ষয়ে যায়! তাই আজ থেকেই যতটুকু আছে—তা নিয়েই শুরু করে দেই।

আমি জানি, বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য স্থানের তালিকায় থাকা একটা দেশ নিয়ে খিস্তি খেউড় করা খুবই সহজ। কিন্তু আঙ্গুলে গোনা যাবে তাদেরই- যারা জাহান্নামের আগুনে বসেও পুষ্পের হাসি হাসতে পারেন। দেশে ছোট ছোট গণ্ডিতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রচুর কাজ হচ্ছে। মানুষের চিঠিগুলোতেই জানতে পেলাম। নইলে এতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর ক্রমাগত রাজনৈতিক অচলাবস্থায় দেশের জিডিপি বাড়ার রেট consistently ৬% এর উপরে থাকতেই পারত না। যেখানে জনগণের ক্রয় সক্ষমতার ভিত্তিতে সর্ববৃহৎ অর্থনীতি চায়নার এই গ্রোথ রেইট ৭.৪%।

তাই, এসব ক্ষুদ্র উদ্যোগকেই ‘মুঠো চাল সংগ্রহ’ নীতির মতো সমষ্টিগত করি। নাই পড়লেন আমার চিঠি মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় – মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তি!

হাজার হাজার শেয়ারটা থেকে আরও হাজার হাজার শেয়ারে ছড়িয়ে জনমত সমষ্টিগত হোক। জনতার চাপেই কর্তাব্যক্তিরা শুনতে বাধ্য হবেন, তাই না!

‘আমরা যদি না জাগি মা, কেমনে সকাল হবে? তোমার ছেলে উঠলে মাগো সকাল হবে তবে!’





About তানজীনা ইয়াসমিন চৌধুরী 3 Articles
তিনি সাবেক রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়, ফুকুওকা, কিউশু, জাপান। বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, জাপান।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*