শিক্ষা কেন দরকার? মানুষ কেন শিক্ষিত হয়?

আজকাল প্রায় দেখি এখন কেউ অন্যায় করলে টু শব্দ করে প্রতিবাদ করার সাহস করে না। এমনকি প্রতিবাদ করতেও দেয় না। কেমন একটা ভয় আমাদের কে গ্রাস করেছে। কোন এক অজানা কুসংস্কারে আটকা পড়ে আছি আমরা। অথচ লেখাপড়া শিখেছি। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেছি। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, আচ্ছা কারো হাতে নিহত হলে, আমি কি বিচার পাবো? কেউ কি আমার হয়ে প্রতিবাদ করবে?Education

কয়েকদিন যাবৎ খেয়াল করছি, দিন দিন আমাদের দেশে শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটছে।, আর বিপরীত দিক দিয়ে পৃথিবীতে অনৈতিক কর্মকান্ডের বৃদ্ধি পাচ্ছে। অসভ্যতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু কেন? শিক্ষা পেলে মানুষ শিক্ষিত হয়, শিক্ষিত হলে মানুষ তো সভ্য হওয়ার কথা, নৈতিক গুণ থাকার কথা। সমাজটা সুন্দর হওয়ার কথা। কিন্তু সমাজে সেই নৈতিকতা কোথায়?

সমাজের সকল সম্পর্ক গুলো দুষিত হয়ে পড়েছে। আজ সামাজিক বন্ধনগুলো দিন দিন বিপর্যয়ের মুখে। কিন্তু কেন এই বিপর্যয়।?

আগে তো মানুষ খুব একটা শিক্ষিত ছিলো না, কিন্তু তাদের মাঝে মানবিকতা বা সামাজিকতা ছিলো। তাদের মাঝে সামাজিক বন্ধনটা অনেক মজবুত ছিলো। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বার বার পরিবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের কতটা নৈতিক শিক্ষা দিতে পারছে???????

আজ ৫ম শ্রেণীর পরীক্ষা দিয়ে শিশু মনে অনৈতিকতার পথ খুলে দেওয়া হয়েছে। অবুঝ শিশুমনগুলো পরীক্ষার জন্য পড়ার চিন্তা করেনা, তারা চিন্তা করে কখন প্রশ্নপত্র পাবো, কখন সেটা পড়ে পরীক্ষা দিতে যাবো। আজকাল প্রায়ই শুনি প্রশ্নপত্র নাকি ফাঁস হচ্ছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে পরীক্ষা নেওয়ার কোন প্রয়োজনীয়তা দেখতে পারছিনা। তার চেয়ে নকল করাটাই সর্বোত্তম। নকল বিদ্যাতে অন্তত বুদ্ধি আর চালাকি খেলাতে হয়, আত্নবিশ্বাস বাড়ানো যায়। কিন্তু প্রশ্ন পত্র ফাঁসে আত্নবিশ্বাস শূণ্যের নীচে নেমে পড়ে।

বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষাকে বাণিজ্যে পরিণত করেছে। শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয়গুলো এখন অন্যতম ব্যবসা। শিক্ষাকে কেন বাণিজ্যে পরিণত হচ্ছে সেটা হয়তো খুব একটা বুঝিয়ে বলতে পারবো না, তারপরও চেষ্টা করছি। আমাদের জেলা আমের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত, আমাদের অর্থনীতি অনেকটা আম কেন্দ্রিক। আমরা যে আম গুলো বাড়িতে খাওয়ার জন্য রাখি, সেগুলোতে সাধারণত কোন প্রকার ঔষুধ দেওয়া হয় না। শুধু ব্যবসার জন্য আমগুলোতেই বিষ প্রয়োগ করা হয়। দীর্ঘদিন আম গাছে রাখার জন্য আমে এক প্রকার শ্যাম্পু ব্যবহার করা হয়। এবং এগুলো আমাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর। ঠিক এমনই ভাবে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় বিষাক্ত শ্যাম্পু ব্যবহার করে শিক্ষিত করে বাজারে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে ।

আজকে কেউ ‘অ আ– ক খ -১-২-৩ শিখলে টাকা দিয়ে শিখতে হয়। আজকে প্রত্যেকটা শিক্ষার্থীকে প্র তিটা বিষয়ের শিক্ষক দেওয়া হয়। অথচ আমার সমবয়সী অনেক শিক্ষার্থী আছেন যারা শুধু গণিত আর ইংরেজীর বাইরে কখনও শিক্ষক পায় নি। তাও আবার সেটা শুধু মাত্র কয়েক মাসের জন্য। আজ বর্তমান স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের যোগ্যতা হচ্ছে টাকা, তাদের পরিচিতি হয় অনেকটা এই রকম –এই ৭ লাখ টাকার শিক্ষক, এই ৫ লাখ টাকার। কিছুদিন পর তারা প্রাইভেট পড়ানোতে মনযোগী হয়ে পড়ে, কোচিং সেন্টার খুলে বসে। শিক্ষার্থীরা উপান্তর না দেখে কোচিং এ পড়তে যায়। এই ৭ লাখ, ৫লাখ টাকার শিক্ষকরা কি নৈতিকতা শিখাবে?

বাবা –মা তাদের উপার্জিত অর্থের অর্ধেকের বেশি ব্যয় করেন- ছেলেমেয়ের শিক্ষার জন্য। উচ্চ শিক্ষা মানুষকে মানুষ বানায় না, অহংকারী বানায়। অধিকাংশ উচ্চশিক্ষিত লোকের মাঝে অহংকার বাস করে। তারা কম শিক্ষিত মানুষদের গণনায় ধরতে চায় না। সব দিক থেকে খেয়াল করলে মাঝে মাঝে ভাবি এই রকম শিক্ষা ব্যবস্থা থাকার চেয়ে না থাকায় ভালো। এটা অপচয় ছাড়া আর কিছুই না।

আমাদের আদি শিক্ষা ব্যবস্থা যেটা ছিলো সেটা ইংরেজদের মত এত উন্নত না হলেও অনেক সুন্দর ছিলো। তখন পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ছিলো। এখনো কি নেই? আছে, তবে সেটা পরিবার থেকে শিক্ষা পেয়ে আসে। পরিবার থেকে শেখানো হয় শিক্ষককে সালাম দিতে হবে, তাদের কথা মানতে হবে। পিতা-মাতার পর তাদের স্থান। কিন্তু এখনকার শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠান গুলোকে সেই নৈতিক শিক্ষা দিচ্ছে? কতদিনই বা পরিবার এইসব নৈতিক শিক্ষা দিতে পারবে?

ব্রিটিশরা আমাদের শাসন করেছে। তারা তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে, তাদের লাভের কারণে। তারা কাদের টার্গেট করেছিলো? তারা সমাজের নবাব বা জমিদারদের টার্গেট করেছিলো। তাদের ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে উচ্চশিক্ষিত করা হলো। তাদের এলিট শ্রেণীর মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলো। কিন্তু সমাজের নিচু স্তরের মানুষের কাছে তারা শিক্ষা পৌছে দেয়নি। ব্রিটিশ আমলে নিচু স্তর থেকে উপরে উঠে কোন মানুষের কথা আমার জানা নেই। যদি থাকে সেটা খুব নগন্য।

আজ আমরা উচ্চশিক্ষিত বলতে বুঝি বিদেশে ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণ করাটাকেই। কিন্তু আমরা চীন, জাপানের দিকে তাকালে দেখি তাদের নিজস্ব শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। এভাবে তারা আত্ননির্ভরশীল হয়েছে। তারা উন্নত। উন্নতের উদাহরণ দিতে গেলে তারা সবার আগে অগ্রাধিকার পায়। কিন্তু আমরা প্রতিনিয়ত বিদেশী অর্থাৎ প্রতিটা মুহূর্তে ব্রিটিশ শিক্ষা ব্যবস্থাকে গ্রহণ করছি। আমরা আমাদের নিজস্বটাকে দিন দিন হারিয়ে ফেলছি। নিজস্বতা হারিয়ে গেলে পরিচয় দেবার কিছু থাকবেনা।

সামান্য বেতনের সরকারী কর্মচারী ছেলেকে এলিট শ্রেণীর মানুষ বানাতে ইংরেজী মিডিয়াম স্কুলে পড়াচ্ছেন। সেই পড়া পড়াতে গিয়ে তিনি দুর্নীতি করছেন, ঘুষ গ্রহণ করছেন। গোটা সমাজ ব্যবস্থা দুষিত হয়ে পড়ছে। যে শিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়ে নিজেকে অমানুষ হয়ে যেতে হচ্ছে, সেই শিক্ষার কি কোন মূল্য আছে? কি প্রয়োজন তার? শিক্ষা কেন দরকার? মানুষ কেন শিক্ষিত হয়? এই প্রশ্নের জবাব কি এই নির্বোধ সমাজ দিতে পারবে?

বাবা-মা চায় তার সন্তানের ভবিষ্যৎ উজ্জল হোক। কিন্তু কয়জন বাবা- মা চায় যে তার সন্তানের চরিত্র উজ্জল হোক। বাবা- মা তাদের অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণে সন্তানদের ব্যবহার করেন। সন্তানের ভূল ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে গিয়ে সন্তানকে দু:খে ফেলে দেয়। শিক্ষা এখন আর নিষ্পাপ হয়ে নেই। কুলষিত হয়ে গেছে। শিক্ষা মানেই বাণিজ্য। স্কুল টিচার হও, কলেজ টিচার হও লাভ। মাসের পর মাস লাখ লাখ টাকা ইনকাম।

কোচিং বাণিজ্য শুরু হয়েছে। বেকার ছেলেরা কোন কর্ম না পেয়ে কোচিং বাণিজ্য খুলে । আর প্রতি বছর মানব সন্তানকে বলদে পরিণত করে। ৫টা প্রশ্ন করলে ৪ টা কমন। এখন তো কোচিং সেন্টারগুলো প্রশ্নপত্রের বেচাকেনার দোকান। এই সব কোচিং ব্যবস্থা ছেলে-মেয়েদের আত্নবিশ্বাস নিয়ে খেলা করছে।

বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় কেউ নিজে পড়ে না, জন্মের পর থেকে পিঠে বই ভর্তি ব্যাগ নিয়ে কোচিং ভর্তি করে দেয়। গরুর বাচ্চারা সাধারণত একটু স্বাধীন থাকে, কিন্তু মানুষের বাচ্চার সেই স্বাধীনাটুকুও নেই।

আমার এক স্যার আছেন যিনি নিজে কষ্ট করে পড়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কিন্তু তিনি তার সন্তানদের জন্য প্রত্যেক বিষয়ে টিউটর রেখেছেন। কোথাও চান্স না পেয়ে, প্রাইভেট ইউনিতে পড়াচ্ছেন। আমার কাছে মনে হয় বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা বলদ বানানোর কারখানা।

ক্লাশ ফাইভ আর এইটের পরীক্ষা বাতিল করা হউক। ক্লাশ ফাইভ আর এইটের পর তাদের কিছু সামাজিক কাজে দেওয়া যেতে পারে। যেমন- বৃক্ষরোপণ হতে পারে………. ক্লাশ ফাইভ আর এইটের পরীক্ষায় কেউ এ প্লাস না পেলে হতাশায় ডুবে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে শুনি আত্নহত্যার চেষ্টা করছে। তাই তাদের জন্য প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রয়োজন হচ্ছে। এর জন্য পুরো ব্যবস্থায় ফেঁসে যাচ্ছে।

কার ছেলের রেজাল্ট কত ভালো, সেটা দেখা হয়, কিন্তু কার ছেলের চরিত্র কতটুকু ভালো সেটা দেখা হয় না। শুধু মন্ত্রাণলয়ের দোষ দিয়ে লাভ হবে না। সেই সব নিকৃষ্ট অভিভাবকেরও দোষ দেখা জরুরী। যারা তাদের সন্তানকে প্রশ্ন দিয়ে সন্তানের ভবিষ্যৎ ও চরিত্র কুলষিত করছে। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা মনকে উন্নত করে না, বরং কুলষিত করছে। যতদিন মন উন্নত না হবে, ততদিন সমাজ উন্নত হবে না।

আর হ্যা সন্তানকে শিক্ষিত করার আগে এখন সবার আগে বলদ আর নির্বোধ মার্কা অভিভাবককে শিক্ষিত করা প্রয়োজন। কথায় আছে দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিতাজ্য, কিন্তু সব বিদ্বান যদি দুর্জন হয়ে যায়, তবে কি সবাই পরিতাজ্য হবে? ভাবুন একটি বার।





About অরণ্য সৌরভ 47 Articles
আমি অরণ্য সৌরভ, লেখাপড়া করছি সরকারী সফর আলী কলেজ আড়াইহাজার, নারায়নগঞ্জ। পাশাপাশি কবি ও সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছি মাসিক "হাতেখড়ি"তে showrov2500@gmail.com

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*