স্বশরীরে মিরাজ প্রিয়নবী দঃ এর অনন্য মুজিজা

হযরত জাবের রদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত , তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এরশাদ করতে শুনেছেন- যখন কোরাইশরা মি’রাজের ঘটনার ব্যাপারে আমাকে মিথ্যুক প্রমাণিত করতে চাইল তখন আমি মকামে হিজরে দাঁড়ালাম আর আল্লাহ পাক বায়তুল মুক্বাদ্দাসকে আমার সামনে উপস্থাপন করলেন। আর আমি সেই বায়তুল মুক্বদ্দাসের দিকে দেখে দেখে তাদের সকল প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলাম । [সহীহ বুখারী-মুসলিম শরীফ ও মিশকাত শরীফ ]

হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
মি’রাজ রসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র অন্যতম প্রধান মু’জিযা । এ মু’জিযা সংঘটিত হয়েছিল নবীজীর নুবুয়ত প্রকাশের ১১ বৎসর ৫ মাস ১৫ দিনের মাথায় ।

নুবুয়তের একাদশ বর্ষের পবিত্র রজব মাসের ২৭ তারিখ রাতের অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সৌরজগত, সিদরাতুল মুন্তাহা, আরশ-কুরসী, ভ্রমণ করে লা – মক্বানে খোদার সাথে দীদার করে নব্বই হাজার কথাবার্তা শেষে পুনরায় মক্কা শরীফে ফিরে এসে দেখলেন বিছানাও গরম রয়েছে আর ঘরের দরজার শিকলও নড়াচড়া করছে। পরের দিন নবীজী যখন এ বিস্ময়কর মি’রাজের ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন তখন কোরাইশ বংশের কাফিররা কোনমতে বিশ্বাস করতে পারছিল না, বরং সরাসরি তারা নবী করীমকে মিথ্যাবাদী আখ্যা দিয়ে মি’রাজের সত্যতাকে প্রত্যাখ্যান করল।

পক্ষান্তরে আবূ জাহেল হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব রদিয়াল্লাহু আনহুকে বলল-দেখো তোমাদের নবীর কাণ্ড । গত রাতেই নাকি তিনি সপ্ত আকাশ অতিক্রম করে আরশ – কুরসী ভ্রমণ করে আবার রাত শেষ হবার আগেই পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন। আসলে এটা কী করে সম্ভব? জবাবে সিদ্দীক্বে

আকবর বললেন-এ কথা কে বললেন? আবু জেহেল বলল-তোমাদের নবীই তো বললেন। এবার সিদ্দীক্বে আকবর জবাব দিলেন- নবী করীম যদি এ কথা বলে থাকেন , তাহলে আমিই সর্বপ্রথম বিশ্বাস করলাম মি’রাজুন্নবী সত্য। সুবহানাল্লাহ!!

মি’রাজের বর্ণনা পবিত্র কোরআনের সূরা বনী ইসরাঈলের শুরুতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন- “ পবিত্রতা তাঁরই জন্য , যিনি আপন ( মাহবুব ) বান্দাকে রাতারাতি নিয়ে গেছেন মসজিদে হারাম হতে মসজিদে আকসা পর্যন্ত , যার আশেপাশে আমি বরকত রেখেছি , যাতে আমি তাঁকে আপন মহান নিদর্শনসমূহ দেখাই , নিশ্চয় তিনি শুনেন , দেখেন । ”

মি’রাজকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে :
১. মক্কা শরীফ হতে বায়তুল মুক্বাদ্দাস পর্যন্ত এ অংশকে বলা হয় ‘ ইসরা ’ ।

২. বায়তুল মুক্বাদ্দাস হতে সিদরাতুল মুন্তাহা পর্যন্ত অংশকে বলা হয় ‘ মি’রাজ ‘ ।

৩. সিদরাতুল মুন্তাহা হতে লা – মকান পর্যন্ত অংশকে বলা হয় ‘ ই’রাজ ’ । আর সাধারণভাবে পূর্ণ ভ্রমণকে মি’রাজুন্নবী বলা হয় ।

অল্প সময়ে এ বিশাল জগত পরিভ্রমণ করে ফিরে আসা সত্যিই বিস্ময়কর । আল্লাহ’র কুদরত এবং নবীজীর মু’জিযা অর্থাৎ অলৌকিক ক্ষমতার সামনে এটা একেবারেই স্বাভাবিক । সাধারণ লোকের জন্য আশ্চর্যজনক মনে হবে বলেই আল্লাহ্ পাক কালামে মজীদে “ সুবহানা ‘ শব্দ দিয়ে মি’রাজের বর্ণনা দিয়েছেন । ঈমানদার মাত্র এই কুদরতী শক্তিকে মেনে নেয় । নবী করীমের মি’রাজ স্বপ্নের মাধ্যমে

হয়েছিল , না সশরীরে হয়েছিল ? এ বিষয়ে কিছু মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হলেও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকীদা – বিশ্বাস ও ফতোয়া হল- নবীজীর মি’রাজ সংঘটিত হয়েছিল সশরীরে । কেবল স্বপ্নের মাধ্যমে মি’রাজ হলে এতে আশ্চর্যের কিছু থাকত না । আর কাফির – বেদ্বীনরাও এর বিরোধিতা করত না । কারণ , স্বপ্নের মাধ্যমে সাধারণতঃ অনেক কিছু দেখা যায় । সুতরাং মি’রাজ স্বপ্নের মাধ্যমে হয়েছে বললে নবীজীর মু’জিযার প্রকাশ হয়না ।

‘ আশ্আতুল লুমআত ’ কিতাবের ৪ র্থ খণ্ড ৫২৭ পৃষ্ঠায় শায়খ মুহাক্কিক হযরত আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী রহমাতুল্লাহি আলায়হি লিখেন- “ মসজিদে হারাম হতে মসজিদে আকসা পর্যন্ত ইসরা এবং মসজিদে আকসা হতে আসমান পর্যন্ত মি’রাজ । পবিত্র কোরআনের দলিল দ্বারা প্রমাণিত ইসরা কেউ অস্বীকার করলে কাফির হয়ে যাবে আর হাদীসে মাশহূর দ্বারা প্রমাণিত মি’রাজ অস্বীকার করলে গোমরাহ হবে । ”

শরহে আক্বাইদে নাসাফী’র ১০০ পৃষ্ঠায় রয়েছে-
: রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র মি’রাজ স্বশরীরে জাগ্রত অবস্থায় আসমানে পরিভ্রমণ অতঃপর সেখান থেকে আল্লাহ’র ইচ্ছায় ঊর্ধ্বগমন পরিভ্রমণ করা

মাশহুর হাদীস দ্বারা প্রমাণিত । সুতরাং এটার অস্বীকারকারী বিদ’আতী হিসেবে গণ্য হবে ।

শায়খ আহমদ মোল্লা জীবন রহমাতুল্লাহি আলায়হি লিখেন-
অর্থাৎ : মসজিদে আকসা পর্যন্ত মি’রাজ পবিত্র কিতাবুল্লাহ দ্বারা প্রমাণিত আর আসমান পর্যন্ত ভ্রমণ হাদীসে মশহূর দ্বারা প্রমাণিত আর তারও উপরে পরিভ্রমণ খবরে আহাদ দ্বারা প্রমাণিত । সুতরাং প্রথমটাকে অস্বীকারকারী নিঃসন্দেহে কাফির , দ্বিতীয়টির অস্বীকারকারী বিদ’আতী আর তৃতীয়টির অস্বীকারকারী ফাসিক্ব । [ তাফসীরাতে আহমদিয়া , ৩২৮ পৃষ্ঠা । মোল্লা আহমদ জীবন রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাফসীরে আহমদিয়া’র ৩৩০ পৃষ্ঠায় আরো লিখেন-
অর্থাৎ- বিশুদ্ধতম মত হল মি’রাজ জিসমানী ( দৈহিক ) ও রূহানী ( আত্মিক ) উভয়দিক দিয়ে হয়েছিল এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকীদা এটিই । যারা মি’রাজকে কেবল রূহানী ( আত্মিক ) কিংবা স্বপ্নিল বলে আক্বীদা পোষণ করে তারা বিদ’আতী , পথভ্রষ্ট এবং ফাসিক্ব ।

নবীজীর স্বশরীরে মি’রাজ আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের এ যুগে আরো বেশি প্রমাণিত । আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল । সূর্য পৃথিবী হতে নয় কোটি ত্রিশ লক্ষ মাইল দূরে । তাই সূর্য হতে আলো পৃথিবীতে আসতে সময় লাগে প্রায় আট মিনিট । পবিত্র হাদীস শরীফের আলোকে প্রমাণিত চন্দ্র , সূর্য , নক্ষত্র সবগুলো আমাদের প্রিয়নবীর নূর থেকে সৃষ্টি তথা নূরে মুহাম্মদীর একেকটি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম শাখা । ক্ষুদ্রতম শাখার গতি যদি এত বেশি হয় তাহলে মূল নূরের গতি কত হতে পারে তা অনুমেয় । তাই এক মুহূর্তে হাজার হাজার আলোকবর্ষ মাইল অতিক্রম করা নবী করীমের নূরানী সত্ত্বার জন্য একেবারেই সহজ । নবীজি স্বশরীরেই বিশাল নভোমণ্ডল পার হয়ে লা – মকানে মহান আল্লাহ’র সাথে দীদার ( সাক্ষাৎ ) করেছেন এবং নব্বই হাজার কালাম করেছেন । যেমন- মিশকাত শরীফ ৬৮ পৃষ্ঠায় রয়েছে হযরত আবদুর রাহমান রদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন-
অর্থাৎ- রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন , আমি আমার প্রভুকে অতি সুন্দর আকৃতিতে দেখেছি অতঃপর তিনি আমার দু’কাঁধের মধ্যখানে তাঁর কুদরতী হস্ত মুবারক রাখলেন এতে আমি আমার বুকে শীতলতা অনুভব করলাম এবং আসমান – যমীনের মধ্যে যত কিছু রয়েছে সবকিছুই জেনে নিলাম ।

এ হাদীস শরীফ থেকে দু’টি বিষয় পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে । প্রথমতঃ মি’রাজের রজনীতে নবীজী মহান আল্লাহ পাকের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন । আর ওলামা – ই কিরাম এ কথার উপর ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে , মি’রাজের রজনীতে নবীজী জাহেরী চক্ষু দ্বারাই মহান রব্বুল আলামীনের সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হয়েছিলেন ।
মি’রাজ হতে ফিরে নবীজী দেখতে পেলেন বিছানা এখনো গরম রয়েছে । ভোরে তিনি কাবাগৃহে তাশরীফ নিয়ে সকলের কাছে এ ঘটনা বর্ণনা করলেন । আবু জেহেল গং তথা কোরাইশ দলপতিরা এ কথা শুনে পরীক্ষার ছলে বায়তুল মুক্বাদ্দাসের দরজা , জানালা ইত্যাদির বিবরণ জানতে চাইল । তারা এ কথাও জানত যে , নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইতিপূর্বে কোনদিন বায়তুল মুক্বাদ্দাসে যাননি । আল্লাহ রব্বুল আলামীন সাথে সাথে জিব্রাঈল আমীনের মারফতে বায়তুল মুক্বাদ্দাসের পূর্ণ চিত্র নবীজীর সামনে তুলে ধরলেন আর তিনি দেখে দেখে দরজা , জানালা ইত্যাদির বর্ণনা বিস্তারিত দিয়ে দিলেন। এতেও হতভাগা কাফিররা নবীজীর মি’রাজকে বিশ্বাস করল না । পক্ষান্তরে হযরত আবূ

বকর রদিয়াল্লাহু আনহু কোন প্রকার দলিল – প্রমাণ তালাশ ব্যতীত নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করে নিলেন। নবীজী আবূ বকর রদিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞেস করলেন- হে আবূ বকর মি’রাজের ঘটনা অন্ধভাবে বিশ্বাস করলে কেন? উত্তরে আবৃ বকর রদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন , এয়া রসূলাল্লাহ্ ! এটাতো সহজ বিষয় । এর চাইতেও বরং অনেক বড় বিষয় না দেখে আপনার কথায় বিশ্বাস করেছি । যেমন মহান আল্লাহকে ও তো স্বচক্ষে দেখিনি । আপনার কথার উপর বিশ্বাস করেই মহান আল্লাহ’র উপর ঈমান এনেছি। সুতরাং আপনার কথায় বিশ্বাস রেখেই মি’রাজের সত্যতার উপর নিরঙ্কুশ সমর্থন দিলাম। উত্তর শুনে নবীজী খুশী হলেন , আর তাঁকে ‘ সিদ্দীক্ব – ই আকবর ’ উপাধীতে ভূষিত করলেন ।





About মাওলানা মুহাম্মদ বোরহান উদ্দীন 52 Articles
তিনি বর্তমানে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মহিলা কামিল মাদরাসা, ষোলশহর, চট্টগ্রামে শিক্ষকতা করছেন এবং মসজিদ- এ রহমানিয়া গাউসিয়া, শীতলঝর্ণা আ/এ, অক্সিজেন, বায়েজিদ, চট্টগ্রাম-এ সম্মানিত খতিব হিসেবে নিযুক্ত আছেন। এর আগে তিনি মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া তাহেরিয়া সুন্নিয়া দরসে নেযামী, মোহরা, চট্টগ্রামে ৫ বছর শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*